কলকাতা থেকে বিদায় বিতর্কিত ত্রিফলা আলোর! কেলেঙ্কারির যে ইতিহাস জড়িয়ে

Triphala Light: কয়েকদিন পর থেকে আর জ্বলবে না ত্রিফলা। কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে এই বাতিস্তম্ভ।

সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জঙ্গলমহল, মাওবাদী সমস্যা। পাহাড়-বাধা কাটিয়ে রাজ্য গুছিয়ে নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক সেই সময়েই মমতার স্বপ্নপূরণে কলকাতা শুনল এক নতুন নাম! আলোকের মায়াবী সাজে লন্ডনের মতো হয়ে উঠবে তিলোত্তমা। এই স্বপ্নেই মশগুল হলেন মমতা। ঘোষণা করলেন দিকে দিকে ত্রিফলার। তিনটি করে গোলাকার আলোর সমন্বয়ে যে বাতিস্তম্ভ নজর কাড়ল ফের। সুন্দরী কলকাতার রাজপথ তো বটেই গলিপথও সেজে উঠল নতুন আলোকের মালায়।

কিন্তু তারপর? প্রায় ১০ বছর কেটেছে। এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও কথা রাখেনি ত্রিফলা। প্রেমিকা তিলোত্তমাকে একা করে বিদায় নিচ্ছে সে। নয়া প্রেমিককে সরিয়ে তিলোত্তমাও খুঁজে নিতে চলেছে নতুন অথবা পুরনো কাউকে! কারণ, কয়েকদিন পর থেকে আর জ্বলবে না ত্রিফলা। কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে এই বাতিস্তম্ভ। নানা সমস্যায় জর্জরিত হতে হতে কলকাতা পুরসভার সিদ্ধান্তে অবশেষে সরছে এই আলো। মমতার স্বপ্নের ত্রিফলার বিদায় ঘটছে 'দিদির ভাই' ফিরহাদ হাকিমের নেতৃত্বে। যদিও এর পরিবর্তে নতুন আধুনিক আলোর চিন্তাভাবনা শুরু করেছে পুরসভা।

কেন সরছে ত্রিফলা?
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, একাধিক ক্ষেত্রেই খারাপ হয়েছে ত্রিফলা। রক্ষনাবেক্ষণের অভাব এবং চুরির ঘটনায় বারবার শোরগোল ফেলেছে এই ত্রিফলা। বর্ষাকালে কয়েকমাস বন্ধ থেকেছে বাতি। বহু ক্ষেত্রেই ঘটেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপদের ঘটনা। ত্রিফলাকে কেন্দ্র করে একাধিক অভিযোগ উঠেছে বারবার। দাবি, গত দু'বছরেই প্রায় ২০ শতাংশ ত্রিফলা চুরি হয়েছে কলকাতা থেকে! পুলিশকে জানিয়েও নাকি খোঁজ পাওয়া যায়নি প্রায় ১ হাজার বাতির। খারাপ হয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার বাতি। এই সমস্ত কারণের উপর নির্ভর করেই ত্রিফলার বিদায় নিশ্চিত করেছে কলকাতা পুরসভা।

আরও পড়ুন: আবারও গেরুয়া ঝড় দেখা যাবে রাজ্যে? প্রথম দফার পর অপেক্ষায় গুজরাতবাসী

ত্রিফলা-বিদায়ে নতুন কী?
জানা যাচ্ছে, বাতিস্তম্ভে ত্রিফলা না থাকলেও এখনই পোল তুলে ফেলা হবে না। খারাপ হয়ে যাওয়া পোলে খানিকটা প্রলেপ দিয়েও আধুনিক আলোর ব্যবস্থা করতে পারে পুরসভা। যা কলকাতাকে আলোর ঝলকানি দেবে নতুনভাবে। বিদ্যুৎ থেকে রক্ষণ, সব ক্ষেত্রে ওই অত্যাধুনিক আলো সুবিধা দেবে বলেই দাবি।

ত্রিফলা-ইতিহাস
কলকাতাকে লন্ডনের মতো বানানো হবে! গঙ্গা হবে টেমসের মতো সুন্দর! মমতা বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল তিলোত্তমা। আলোর ক্ষেত্রেও নতুনভাবে সেজে উঠেছিল সে। আর নতুন বন্ধু ত্রিফলা এসেছিল সেই সাজের উপকরণ হিসেবে। ২০১২ সাল নাগাদ প্রায় ২৭কোটি টাকা ব্যয় করে মহানগরে লাগানো হয় প্রায় ১২ হাজার বাতিস্তম্ভ।  বিভিন্ন রাস্তা থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায়, ওভার ব্রিজ থেকে পার্ক। সমস্ত জায়গায় গাঁট বাঁধে ত্রিফলা। আরও আলোকিত হয় কলকাতা।

ত্রিফলা-বিড়ম্বনা
এই আলোর নাচন শুরু হতেই প্রশ্ন ওঠে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিরোধীরা। কলকাতা পুরসভার সিদ্ধান্তে বিরক্তি প্রকাশ করেন অনেকেই। বিক্ষোভ শুরু হয়, বিরোধীদের তরফে আলোকিত কলকাতাকে নতুন করে আলোর ঝলকানি দেওয়ার বাজে নীতিতে সরব হন কেউ কেউ। কিন্তু দিদির ভাই কানন অর্থাৎ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সেজে ওঠে ত্রিফলা।

'ত্রিফলা ঢাকল দুর্নীতিতে'
আলোর পথে এগিয়ে যেতে যেতেই প্রশ্নের মুখে পড়ে কলকাতা পুরসভা। অভিযোগ ওঠে, দরপত্র ছাড়াই বাজারদরের তুলনায় বেশি টাকা খরচ করে ত্রিফলা বাতি কেনা হয়েছে। পুরসভার অভ্যন্তরীণ অডিটেও এই গরমিল ধরা পড়ে। সরিয়ে দেওয়া হয় তৎকালীন এক পুর অধিকর্তাকে। আলোর দায়িত্বে যিনি ছিলেন।

এই দুর্নীতি নিয়ে সমস্যা বাড়ে সরকারের। উত্তাল হয় কলকাতা। মমতার সাধের ত্রিফলা দুর্নীতি এবং টাকা নয়ছয়ের ঘটনায় তদন্তে নামে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা সিএজি। তাঁদের তরফে তদন্ত যায়। একটি রিপোর্টে বলা হয়, বাজারদরের তুলনায় বেশি টাকা খরচ করে ত্রিফলা কেন হয়েছে। প্রায় ৮ কোটি টাকা খরচ করেছে কলকাতা পুরসভা!

ত্রিফলায় শোভন-ভূমিকা
বর্তমানে বৈশাখী প্রেমিক, একদা কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন ওঠে সেদিন। বিরোধীরা সরব হন মেয়র শোভনের বিরুদ্ধে। ত্রিফলা বাতি নিয়ে প্রায় ৮ কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে শোভনের নেতৃত্বাধীন পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে। যদিও এই দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই কলকাতায় নতুন করে কোনও ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ লাগানো হয়নি। যদিও এই ঘটনার দায় যে তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড বা মেয়র শোভনের ছিল না, একথা বারবার বুঝিয়ে দেয় মমতার দল। তবুও প্রশ্নের মুখে পড়েন মেয়র। পরবর্তীতে ত্রিফলা নিয়ে বিতর্ক বারের আরও। রাজ্যজুড়ে একাধিক এলাকায় এই আলোর উপর ওঠে একাধিক প্রশ্ন। এদিকে অস্বস্তি আরও বাড়ে শোভনের।

ত্রিফলায় মমতা-অসন্তোষ
কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে ত্রিফলা প্রশ্নে, অস্বস্তিতে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও। প্রশ্ন ওঠে তাঁর সরকারের ভূমিকা নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের একটি প্রকল্প নিয়ে এই অভিযোগ খুব একটা স্বস্তি দেয়নি মমতাকে। প্রিয় কানন অর্থাৎ শোভনের ভূমিকাতেও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী।

ত্রিফলায় বিরোধী অবস্থান
কলকাতা পুরসভার ত্রিফলা বন্ধের সিদ্ধান্তে ফের সরব হয়েছেন বিরোধীরা। আগেও ত্রিফলা দুর্নীতিতে উত্তাল হয়েছিল পুরসভা। অধিবেশনে তৈরি হয়েছিল ধুন্ধুমার পরিস্থিতি। এবার এই সিদ্ধান্তের খবর প্রকাশ্যে আসতেই ফের কটাক্ষের শিকার হয়েছেন মমতা, ফিরহাদরা। বাম নেতাদের দাবি, "আগাগোড়া দু নম্বরি করেই এই সরকার চলছে। সেখানে ত্রিফলা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেটাও দুর্নীতিতে জড়িত। তাই বন্ধ হওয়ায় ভালো!'' বিজেপি বলছে, "ত্রিফলা! মমতা নিজেই তো কতগুলো ফলায় বিধ্বস্ত। ওটা বন্ধ হওয়ার আগে আগেই এই সরকারই না বন্ধ হয়ে যায়!" আর কংগ্রেসের দাবি, ''সবটাই গিমিক। নতুন কোন চুরির দিকে এগোচ্ছে কে জানে!"

More Articles