করোনামুক্তির স্বপ্ন থেকে মঙ্গলজয়ের হাতছানি- একুশে মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেও জ্বলেছিল যে অনির্বাণ আলো

দুঃখ-দুর্দশার ২০২১ শেষ হতে চলেছে । বিশ্বের কোনও জনগোষ্ঠীর কাছেই খুব সহজ ছিল না এই বছরটা। অনেকেই হারিয়েছি কাছের মানুষদের। যে বিজ্ঞান এক লহমায় ডায়াজিপাম থেকে আনবিক বোমা হাতে তুলে দিয়েছে আমাদের, অসহায় দিনগুলিতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে যেন সেই জ্ঞানকাণ্ডই। বিজ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য জয়রথ কি করোনার সামনে নতজানু হয়েই থাকবে, এই প্রশ্নটা ঘুরেছে আট থেকে আশির মনে। অজুত মৃত্যুর কালো দিনগুলি পেরিয়ে আজ যখন ক্যালেন্ডার বদলের সময় এল, তখন বিজ্ঞান-বিজ্ঞানসেবকরা এই বছরটায় কতটা লড়তে পারল, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে মন।

যখন ভ্যাকসিন হার মানছে কোভিড ভ্যারিয়েন্টের কাছে:

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আগামী সপ্তাহেই ভারতে গুরুতর ভাবে বাড়বে ওমিক্রন আক্রান্তদের সংখ্যা। এই মাঝেই উদয় হয়েছে ডায়ামাইক্রণের, যা নভেল করোনা ভাইরাসের আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট।  অনেক আগে, কোভিডের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের সাথে পরিচিত হয়েছি। আলফা, বিটা, গামা এবং ডেল্টা নামে এদের নামকরণও হয়েছে। ২০২১-এর শুরুতে ডেল্টার ভয়াবহ রূপ দেখেছিল ভারত। সেই দিনগুলি মনে করলে এখনও চোখে ভাসবে আমরা প্রিয়জনের জন্যে অক্সিজেন পাইনি, হাসপাতালে বেড পাইনি, একেরপর এক ডাক্তার-নার্স শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন পরিস্থিতির ভয়াবহতা সামাল দিতে। কিন্তু  ভারত কোভিড-ভ্যাকসিন পরিকল্পনায় বেশ পিছিয়ে তখনও। তবে ধাপে ধাপে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে সেরাম ইন্সটিটিউট-অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রোজেনেকার ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড বা ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে সঞ্জীবনী সুধা। নীলগ্রহ অবশ্য ততদিনে পেয়েছে স্পুটনিক, ফাইজারের মতো টিকাগুলি।

ভ্যাকসিন পেলেই তো হল না, একশো তিরিশ কোটির দেশে তাকে বন্টন করা কঠিন কাজ। ততদিনে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি আমাদের হাতেনাতে দেখিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ভাইরাস এবং তার ক্রমাগত মিউটেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কত তুচ্ছ, কত অসহায়। কারণ যে ভ্যাকসিনগুলি তখন নির্মাণ করা হয়েছিলো, সেগুলি সমস্ত কোভিড ভ্যারিয়েন্টকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও, ডেল্টার রীতিমত ক্ষমতা ছিল ভ্যাকসিন থেকে সৃষ্ট রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর। সেই স্মৃতি এই নভেম্বরে ফিরে এসেছে, যখন গবেষকরা ভ্যাকসিন দিয়ে ওমিক্রনকেও আটকাতে পারছিলেন না। অবশ্য শেষ হাসি হেসেছেন তারাই, বুস্টার ডোজ় দিয়ে তাকে আপাতত বশে আনা গেছে।

মঙ্গলের মাটি ছুঁল প্রিজা়র্ভেরেন্স রোভার - শুরু একটি নতুন অধ্যায়

২০২১-এর ১৮ই ফেব্রুয়ারি, নাসার প্রিজা়রভেরেন্সে রোভার ছুঁলো মঙ্গলের মাটিকে আর সেদিন থেকেই মঙ্গল অভিযানের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। সেপ্টেম্বর মাসে প্রিজা়রভেরেন্স রোভার মঙ্গলের গর্ভ থেকে প্রথম সংগ্রহ করল মঙ্গলের মাটি - উদ্দ্যেশ্য লাল গ্রহ সৃষ্টির ইতিহাসকে জানা, লাল গ্রহের ভৌগোলিক প্রকৃতিকে জানা। তার কিছুদিন পরে পৃথিবীর সাথে প্রিজা়রভেরেন্স রোভারের সমস্ত যোগাযোগ বিছিন্ন হলেও, খুব বেশিদিন সময় লাগেনি যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করতে, থেমে থাকেনি গবেষণাও।

প্রিজা়রভেরেন্স রোভার একাধিক ছবি পাঠাল মঙ্গলের দক্ষিণ গোলার্ধের, জানা গেল লাল গ্রহেও একদিন বয়ে চলেছিল কল্লোলিনী কোনও নদী। সেই সব ছবি দেখে গবেষকরা জানান, কোনোদিন মঙ্গলের জলবায়ুও পৃথিবীর মত ছিল। কিন্তু তা ধীরে ধীরে কী ভাবে শুষ্ক এক গ্রহে পরিণত হল, প্রিজা়রভেরেন্স রোভার যে তা জানতে সাহায্য করবে, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই।

মিউওন সম্পর্কে নতুন তথ্য বদলে দিল পদার্থবিদ্যার পুরোনো অনেক তত্ত্ব:

২০২১ সালের ৭ ই এপ্রিল মিউওন জি-২ এর গবেষণার সাথে নিযুক্ত ফার্মি ন্যাশালান এক্সেলেটর ল্যাবরেটরির গবেষকরা তাদের ওয়েবকাস্টে জানান, মিউওন কণা তাঁরা যা আভাস দিয়েছেলেন, তার থেকে  অনেক বেশি শক্তিশালী চুম্বকত্ব বিচারে। মিউওন ইলেকট্রনের মতো, আকারে বড়, অস্থিতিশীল  কণা। মিওয়ন সম্পর্কে নতুন এই অবিষ্কার বদলে দিতে পারে পদার্থবিদ্যার অজস্র সমীকরণ এবং তত্ত্ব।

অ্যালঝাইমার ড্রাগ এক নতুন দিগন্ত আনল (আর তার  সঙ্গে এল একাধিক বিতর্ক) :

আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) আঠেরো বছরে এই প্রথম অ্যালজাইমারের ওষুধ ব্যবহারের অনুমতি দিল। আর তাতে যারা অ্যালঝাইমার রোগে আক্রান্ত ছিলেন ভয়াবহ ভাবে, তারা যেন কিছুটা আলোর সন্ধান পেলেন। এটি কেম্ব্রিজের বায়োজেন নামের একটি সংস্থার তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ যা মস্তিষ্ক থেকে অ্যামাইলয়েড বিটা প্রোটিনকে সম্পূর্ণভাবে দূর করে। মনে করা হয় এই অ্যামাইলয়েড বিটা প্রোটিনই অ্যালঝাইমার রোগের মূল কারণ। যদিও দেখা যায় ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এই ওষুধ আশাপ্রদ ফল দেখায়নি বেশ কিছু ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন-আতঙ্কের একুশে দেশের ভাঙা হৃদয়টাকে জুড়েছিলেন ওঁরাই, কুর্ণিশ মীরাবাই, নীরজ…

ক্রিস্পারের সাহায্যে এডিট করা জিন, সরাসরি শরীরে প্রবেশ করানো হল:

ক্রিস্পার ত্রুটিবিহীন ভাবে জিন-এডিট করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি নিঃন্দেহে। কিন্তু তা বাস্তবে রূপায়ণ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। পাশাপাশি এটাও প্রমাণ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সম্পূর্ণ প্রযুক্তিটির সাহায্যে মানুষের জিন এডিট করলেও, পরবর্তীতে তার বিরূপ প্রভাব মানুষের উপর পড়বে না।

২০২১ সালের ২৬  শে জুন, কেম্ব্রিজ, ম্যাসাচ্যুসেটসের ইন্টেলিয়া থেরাপিউটিকস এবং নিউইয়র্কের রেজেনরন নামের দুটি সংস্থা ঠিক এই ভাবনাকে মানুষের দেহে প্রবেশ করিয়ে, বাস্তবে রূপায়ণ করে। এই দুই বায়োটেকনলি সংস্থার গবেষকরা ক্রিস্পার-ক্যাস ছয় জন ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করান। ছয়জনেরই ট্রান্সথাইরেটিন অ্যামাইলয়েডোসিস নামের একটি জিনগত অসুখ ছিলো।

এই অসুখে ভোগা রুগীদের শরীরে জিনের ত্রুটির কারণে ত্রুটিপূর্ণ গঠনযুক্ত প্রোটিন তৈরি হয় - বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে প্রোটিন মিসফোল্ডিং। এই প্রোটিনগুলি শরীরের বিভিন্ন কলা এবং অঙ্গকে গঠন করে। ক্রিস্পার-ক্যাস দিয়ে সেই ত্রুটিপূর্ণ জিনকে যখন এডিট (বা সারাই করানো) করানো হল, দেখা গেল এই সেই ছয়জন রুগীর শরীরেই সেই ত্রুটিপূর্ণ জিনের পরিমাণও কমে গেল।

More Articles