প্রমাদ গুণছেন স্বয়ং অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়! এসএসসি মামলার ভবিষ্যৎও কি 'সারদা-নারদ'-এর মতোই?
Justice Abhijit Ganguly: সারদা কেলেঙ্কারির এক দশক পূর্ণ হতে চলেছে আগামী বছর। পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে নারদ মামলার। কিন্তু ওই দুই কেলেঙ্কারির তদন্ত এখনও ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে, সেটা কেউ জানেন না।
স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে গ্রুপ-ডি কর্মী নিয়োগ, সারা বাংলা জুড়ে আজকাল শুধুই দুর্নীতির খবর। বিশেষত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর গ্রেফতারি এবং টাকার পাহাড় উদ্ধারের চাঞ্চল্যকর ঘটনা মানুষকে একেবারে হতবাক করে দিয়েছে। এই ব্যাপক দুর্নীতি আসলে জনসাধারণের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ২০১১ সালে যাঁরা অনেক আশা নিয়ে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন পেতে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তাঁরাই আজ আশাহত। দুর্নীতির দায়ে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর গ্রেফতারির পর মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তাঁর গায়ে কালি লাগানোর চেষ্টা হলে তিনিও পাল্টা আলকাতরা ছুঁড়বেন। তিনি নিজেকে আহত সিংহ হিসেবে তুলে ধরছেন। অর্থাৎ সমালোচনার জবাবে অন্যদের দুর্নীতি তুলে ধরা এখন তাঁর প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা এই দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কী বলবেন?
মেধা তালিকায় জালিয়াতি থেকে শুরু করে অবৈধভাবে নম্বর বৃদ্ধি, ইন্টারভিউ না দিয়ে মন্ত্রীকন্যার চাকরি- তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। প্যানেলভুক্ত চাকরিপ্রার্থীরা এই অভিযোগগুলির সুরাহা চেয়ে বারবার সরকারের দরজায় কড়া নেড়েছেন। ৫০০ দিনের বেশি একটানা ধরণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হাইকোর্ট তদন্তের আদেশ দেওয়ার আগে পর্যন্ত সরকার এমন ভাব দেখিয়েছে যেন এই সমস্তই তাদের একেবারে অজানা ছিল। বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা দুর্নীতির প্রমাণ জোগাড় করে প্রথম থেকেই নিজেদের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু, স্কুল শিক্ষক নিয়োগের স্বচ্ছতার জন্য তৈরি নজরদারি কমিটি, আসলে যে কী কাজ করছিল, সেটা আজ সকলের কাছেই স্পষ্ট। কিন্তু এত বড় দুর্নীতি হয়ে গেল আর সরকারের উচ্চস্তরের কেউ কিছু টের পেলেন না? এটা কী করে সম্ভব? এত বড় দুর্নীতি দেখেও তাঁরা চুপ করে থাকলেন কেন? মন্ত্রী কন্যার চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়ার বিভিন্ন খবর আজ সংবাদমাধ্যমে পাতায়। এমনকী, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও এত বড় মাপের দুর্নীতি দেখে হতবাক।
আরও পড়ুন- দুঁদে গোয়েন্দা না বিচারপতি! অভিজিতের নতুন স্ট্র্যাটেজি হার মানাবে ফেলুদাকে
এই ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁরা সকলেই শাসকদলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এবং কর্মী। হাইকোর্ট নিযুক্ত বাগ কমিটির রিপোর্টে দুর্নীতির অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে বলার পর দেখা গেল, তদন্তের ভার কার হাতে থাকবে, সেটা নিয়েই সরকারের একমাত্র মাথাব্যথা। কিন্তু এতদিন ধরে চাকরিপ্রার্থীরা যে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন, কোনও মন্ত্রী কি ডেকে তাঁদের কথা শুনেছেন? সামান্য স্মারকলিপি দিতে গেলেও তা গ্রহণ করার সময় হয়নি। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, শুধু রাজ্য নয়, কেন্দ্রীয় সরকারও একইভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। যে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে মাথা পেতে নিতে হয় সকলকে, সেই সুপ্রিমকোর্টই একসময় সিবিআইকে ‘খাঁচার তোতা’ বলেছে। এই দুর্নীতিকে পুঁজি করে শাসক দল নিজের দলের বিরোধীদলগুলির নেতাদের সব সময় চাপে রাখতে কাজে লাগায়। আগে যেভাবে কংগ্রেস এই এজেন্সিকে ব্যবহার করেছিল, তেমনই এখন বিজেপি সরকার তাকে লাগাম ছাড়া জায়গায় নিয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, তাদের আমলে ইডির দায়ের করা মামলার মাত্র ০.৫ শতাংশের ফয়সালা হয়েছে। টাকা উদ্ধার হোক আর বিরোধী নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ, খবরা-খবর হওয়ার পরেই কিছুদিন পর তা পিছনে চলে যায়। আর যদি অভিযুক্তরা শাসক দলের শরণ নেন, তাহলে তো পুরো মামলাই ঠান্ডা ঘরে।
আর এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়। এর আগেও সারদা কেলেঙ্কারি এবং নারদ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায়, প্রচার যত হয়েছে, তদন্ত তার সামান্য ভগ্নাংশও এগোয়নি। এইজন্যই হয়তো গত শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিযোগ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু বললেন, “আমি চাইনা, এটা সারদা-নারদ হয়ে যাক।” তাঁরা দু’জনে ‘এটা’ বলতে যে এই নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের কথাই বুঝিয়েছেন, তা আর কারও জানতে বাকি নেই। ইতিমধ্যেই এই মামলার তদন্তের স্লথ গতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। সেই দুর্নীতির তদন্তের জন্য গঠিত সিবিআইয়ের সিট হোক বা বিশেষ কোনও তদন্ত দল, দুর্নীতির রহস্যের কিনারা এখনও পর্যন্ত করা যায়নি। এই রহস্য সুরাহা নিয়ে বিচারপতিরা সন্দিহান, আর তার মূলে রয়েছে রাজ্যের সাম্প্রতিক দুই বড় কেলেঙ্কারি- সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক নয়-ছয় কাণ্ড আর নারদ কাণ্ডে পশ্চিমবঙ্গের নামিদামি কয়েকজন নেতা মন্ত্রীর অতিরিক্ত ভেট নেওয়ার অভিযোগ।
সারদা কেলেঙ্কারির এক দশক পূর্ণ হতে চলেছে আগামী বছর। পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে নারদ মামলার। কিন্তু ওই দুই কেলেঙ্কারির তদন্ত এখনও ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে, সেটা কেউ জানেন না। আদালত থেকে আমজনতা, সকলেই এই বিষয়টি নিয়ে সংশয়ে। অনেকে সন্দেহ করছেন, সারদা এবং নারদ মামলার তদন্ত অতলে তলিয়ে গিয়েছে। আর এই সন্দেহ খুব একটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ এই মুহূর্তে এই দু’টি তদন্ত একেবারে দিশাহীন। দুর্নীতির ব্যাপকতা বোঝাতে গিয়ে সারদা এবং নারদ কাণ্ডের উদাহরণ টেনে আনলেও, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু এই মুহূর্তে যে স্কুল নিয়োগ দুর্নীতির মামলা দেখছেন, সেটিও কোনও অংশে কম নয়। স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআইয়ের সিটে রদবদল নিয়ে এসেছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, কারণ মামলার গতি প্রকৃতি এবং স্লথ তদন্ত নিয়ে আদালত সন্তুষ্ট নয়। তদন্তে বিলম্বের প্রসঙ্গ তুলে মামলাকারীদের আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্তের কথার রেশ টেনে, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, “আমি চাইনা, এটা সারদা-নারদ হয়ে যাক।”
আরও পড়ুন- মেয়াদ শেষ, তবু কেন আজও জেলের ভিতর সুদীপ্ত সেন
আইনজীবীরা ব্যাখ্যা করছেন, সারদা এবং নারদ কাণ্ডের মতো বড় মাপে দুর্নীতির তদন্ত কোথাও একটা খেই হারিয়ে ফেলেছে। তদন্ত শুরু হলেও, সারদা মামলায় সুদীপ্ত সেন এবং দেবযানী ছাড়া তেমন কাউকে কঠোর শাস্তি পেতে হয়নি। শুধু রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী কিংবা বিচারপতিরা নয়, সাধারণ মানুষের মনেও সারদা সহ বিভিন্ন বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখনও বহু মানুষ আছেন যাঁরা সারদা এবং রোজ ভ্যালিতে বিনিয়োগ করা টাকা পাওয়ার আশায় রয়েছেন।
স্কুল নিয়োগ দুর্নীতিতে যেমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে এসেছিল, তেমনই একই রকম প্রভাবশালী যোগের অভিযোগ ছিল সারদা এবং নারদ কেলেঙ্কারিতে। সেই সময় কিছু মন্ত্রী সাংসদ গ্রেফতার হলেও, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ভবিষ্যতে এই মামলার তদন্ত আদৌ শেষ হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। নারদ মামলাতেও রাজ্যের শাসক দলের কয়েকজন মন্ত্রী, বিধায়ক এবং সাংসদের নাম জড়িয়েছিল। নারদ মামলায় রাজ্যের চারজন নেতা মন্ত্রীকে গ্রেফতার করলেও তাঁরা সহজেই জামিন পেয়ে গিয়েছিলেন। নারদের অভিযুক্ত হিসেবে এমন অনেকের নাম উঠেছে যারা সেই সময় তৃণমূলে থাকলেও পরবর্তীতে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। তাদের ক্ষেত্রে সিবিআই বা ইডি নূন্যতম তৎপরতা দেখায়নি।
তাই এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন হল, যেকোনও মামলার তদন্তে কি রাজনৈতিক প্রভাবই আসল? গদিতে টিকে থাকার জন্য যে সমস্ত কাজ করেন নেতারা, তাতে এঁদের নীতি আর আদর্শের কোনও পার্থক্য বোঝা যায় কি? যদি এই পার্থক্যটা নাই থাকে তাহলে মানুষের স্বার্থরক্ষা কি আদৌ সম্ভব?