কত শিশু ঘুরছে ভারতের রাস্তায়? পৃথিবীর বৃহত্তম শিক্ষাব্যবস্থায় অবাক করবে যে তথ্য
Drop Out in India: একাধিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, সারা ভারতে ১ কোটি ৮০ লক্ষ শিশু প্রাথমিক শিক্ষালাভ করা তো দূরের কথা, বিভিন্ন শহরের রাস্তায় রাস্তায় অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের ভিত তৈরি করে। আর ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো সারা পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম। ভারতজুড়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলের সংখ্যা ১০ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি। কেবলমাত্র স্বীকৃত প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যাই ৮ লক্ষের বেশি। সরকার দাবি করছে, ভারতে প্রাথমিক শিক্ষালাভের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো আছে। এছাড়া আইন-কানুন তো আছেই। যেমন, ২০০৯ সালে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করতে চালু করা হয়েছে 'রাইটস অফ চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কম্পালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট'।
এর চার বছরের মাথায় ২০১৪ সালে চালু হয়েছে 'চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকে্শন অ্যাক্ট'। অন্য আইনগুলির মতো এই আইনগুলিও কিন্তু শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষালাভের অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারেনি। বরং প্রতি বছরই লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে যাচ্ছে ছেলেমেয়েকে বাবা-মায়ের পড়ানোর সঙ্গতি না থাকায়। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়টাই অতি স্পর্শকাতর। শিশুর পাঁচ বছর বয়স থেকে প্রাথমিক স্কুলশিক্ষা লাভের আদর্শ বয়স। ১০ থেকে ১১ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে সে। ভারতে বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে মুসলমান শাসকদের আমল পেরিয়ে ব্রিটিশ আমলেও প্রাথমিক শিক্ষা জীবন গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। স্বাধীন দেশে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা আনুষ্ঠানিক ধ্যানধারণা থাকলেও কার্যত তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
এর কারণগুলি খতিয়ে দেখে বিভিন্ন গবেষণায় একই তথ্য উঠে এসেছে। অপরিসীম দারিদ্র্য বহু শিশুকে প্রাথমিক স্কুলের পাঠ থেকে বঞ্চিত করছে। এছাড়া স্কুলগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পঠনপাঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নেই। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকাও। বলাবাহুল্য, এই দায়িত্ব পালন করা সরকারেরই চিরকালের কর্তব্য।
আরও পড়ুন- বেলঘড়িয়ায় বসেই নাসাকে নতুন গ্রহাণুর সন্ধান! কে এই তরুণ?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চিন, জাপান, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে প্রাথমিক স্কুলগুলি সারাদিনে দু'দফায় চলছে। কৃষিজীবী এবং শ্রমিকদের সন্তানসন্ততিরা যাতে প্রাথমিক শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত না হতে পারে এজন্য স্কুলের সময় সাজানো হয়েছে দু'দফায়। কিছুক্ষেত্রে স্কুল চালু থাকে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। বাকি ক্ষেত্রে স্কুল চালু থাকে বেলা একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এ ধরনের ব্যবস্থা অবশ্য ভারতে নেই। ভারতে তফশিলি জাতির অন্তর্গত মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি। এছাড়া ৫ কোটিরও বেশি আদিবাসী নাগরিক রয়েছেন এদেশে। পরাধীন ভারতেও এই দুই 'নিম্নবর্গীয়' সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে যেমন বঞ্চিত ছিল, আজও সেই বঞ্চনার অবসান হয়নি। বলা যেতে পারে, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
এদিকে আজ যারা শিশু আগামী দিনেই তারা দেশের ভবিষ্যতের আশা। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রের খবর, ২০৩০ সালে সারা দুনিয়ার নিরিখে ভারতে যুব সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে সবচেয়ে বেশি। একদিকে শিশুরা দারিদ্র্যের কারণে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে যেমন বঞ্চিত, অন্যদিকে শিক্ষাখাতে জিডিপির পরিমাণ মোটে ৩.৫ শতাংশ। ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশনের দেওয়া তথ্যানুসারে, প্রাথমিক স্কুলে প্রতি ২৪জন পড়ুয়া পিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা মোটে একজন। ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে পড়ুয়ারা ড্রপ আউটের শিকার হচ্ছে বলে স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন।
এই পরিস্থিতি স্বাধীনতার পর এতগুলি দশক পেরিয়েও! তবে সকলের শিক্ষালাভের সুযোগের জন্য সরকার কাগজে-কলমে নানা প্রকল্প রচনা করে চলেছে। ১৯৬৮ সাল এবং ১৯৮৬ সালের পরে ২০২০ সালেও জাতীয় শিক্ষানীতি চালু হয়েছে।
একদিকে শিক্ষানীতি সম্পর্কে সরকারি ঢক্কানিনাদ, অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে স্কুল ড্রপ আউটের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে- ৫ অনুসারে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েরা বহুক্ষেত্রেই লেখাপড়া ছেড়ে দিচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির আগে পরে, হাল একই।
ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিস্থিতি এর ফলে খুবই করুণ। সংবিধানে শিক্ষা স্বীকৃত অধিকার হলেও ২৫ শতাংশ ভারতীয় এখন নিজের নাম পর্যন্ত সই করতে পারেন না। নিজের নাম সই করতে না পারা মহিলার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি। বিশেষত, গ্রামীণ এলাকাগুলির বাসিন্দারা ছোটবেলায় প্রাথমিক স্কুলে পাঠের সুযোগ না পাওয়ায় সেখানে অশিক্ষিত মহিলাদের সংখ্যা শহরাঞ্চলের তুলায় বেশি।
ব্রিটিশ আমলে সেই ১৮৮২ সালেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল। সেইসময়ে প্রথমে গঠিত হয় হান্টার কমিশন। এই কমিশন স্থাপিত হয়েছিল লর্ড রিপনের আমলে। এরপর ১৯১১ সালে সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিকার সুনিশ্চিত করতে কম্পালসারি এডুকেশন বিল আনা হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে একই উদ্দেশ্যে চালু করা হয় সার্জেন্ট প্ল্যান। ব্রিটিশ আমলেও এই পরিকল্পনাগুলি যেমন কাগজ-কলমে ছিল, স্বাধীন ভারতেও এই পরিস্থিতির গুণগত কোনও পরিবর্তন হয়নি।
আরও পড়ুন- জমি কেড়ে নেওয়া, পরের পর যুদ্ধ! পৃথিবী শাসন করা আমেরিকার ইতিহাস তাক লাগাবে
প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগেও প্রাথমিক শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন প্রান্তজনেরা। সে যুগেও উচ্চবর্ণের অন্তর্গত পরিবারগুলির পড়ুয়ারা বছরের পর বছর গুরুগৃহে থেকে্ প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতেন। এই ব্যবস্থা গুরুকুল হিসেবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। গুরুকুল আদতে গুরু-শিষ্য পরম্পরার অন্তর্গত শিক্ষালাভের পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে গুরুর মুখ থেকে শিক্ষালাভ করে তা মনন করতেন পড়ুয়ারা। মুসলমান আমলে এধরনের শিক্ষাব্যবস্থা মক্তব হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, মক্তবগুলিতে মূলত ধর্মশিক্ষা দেওয়া হত, যে ব্যবস্থা বৈজ্ঞানিক ছিল না। তবে গুরুকুল ব্যবস্থা, মুসলমান নবাবদের সময় এবং ব্রিটিশ আমলেও উচ্চবর্ণের অন্তর্গত মেয়েদের একটা সময় পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বেরিয়ে শিক্ষালাভের অধিকার ছিল না। মেয়েরা বাড়িতে বসেই লেখাপড়া করতেন।
এখন সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কিশোর-কিশোরীর বসবাস ভারতে। এসত্ত্বেও প্রাথমিক অধিকারলাভের সুযোগ থেকে আজও বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ শিশু। একাধিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, সারা ভারতে ১ কোটি ৮০ লক্ষ শিশু প্রাথমিক শিক্ষালাভ করা তো দূরের কথা, বিভিন্ন শহরের রাস্তায় রাস্তায় অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজধানী দিল্লিতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শিশুর সংখ্যা সর্বাধিক। প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি। ফলে পরিস্থিতি যে শোচনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ভারতে শৈশব থেকেই শুরু হয় বঞ্চনার পর্ব। এরপর বহুক্ষেত্রেই আমৃত্যু মৌলিক অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে।