চোখের রোগের চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন! কোন অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের দৌলতে?

মেলিসা বার্নেটের মতে, এরকম কনট্যাক্ট লেন্স, ভবিষ্যতেও বিভিন্ন চোখের রোগ নিরাময়ের পথ দেখাবে।

কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারকারীদের মধ্যে চল্লিশ শতাংশেরই চোখে অস্বস্তির (Itching) মতো সমস্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি অনেকেরই অ্যালার্জির কারণে চোখে চুলকানি জাতীয় সমস্যা হয়। তার ওপর তাঁদের যদি কনট্যাক্ট লেন্স পরতে হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এইবারে সেই সমস্যার সমাধান করল জনসন অ্যান্ড জনসন (Johnson & Johnson)।

 

বিখ্যাত এই সংস্থা এমনই এক ধরনের কনট্যাক্ট লেন্স বানিয়েছে, যাতে রয়েছে কিটোটিফেন (Kitotifen) নামের অ্যালার্জি-প্রতিরোধী ওষুধ (Anti-allergic drug)। এই কনট্যাক্ট লেন্স চোখে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই, চোখের মধ্যে ধীরে ধীরে গিয়ে মিশতে থাকবে অ্যালার্জি-প্রতিরোধী ওষুধটি। আবার বাজারে প্রচলিত সাধারণ কনট্যাক্ট লেন্সের মতো, চোখে দেখতেও সাহায্য করবে এই ধরণের কনট্যাক্ট লেন্স।

 

চলতি মাসের শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (Food and Drug Administration) জনসন অ্যান্ড জনসনকে নতুন ধরণের এই কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারে ছাড়পত্র দিয়েছে।আশা করা হচ্ছে, অ্যালার্জি-প্রতিরোধী ওষুধ সংযোজন করা গেলে, অদূর ভবিষ্যতে চোখের অন্যান্য অসুখের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধও সংযোজন করা যাবে কনট্যাক্ট লেন্সে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডেভিস) (University of California, Davis) চক্ষু বিশেষজ্ঞ (Optometrist) মেলিসা বার্নেটের (Melissa Barnett) মতে, এই ধরনের কনট্যাক্ট লেন্স বানানো এ-যাবৎ কেবল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার স্তরেই ছিল। এখন তা বাস্তবে সম্ভব করে দেখাল জনসন অ্যান্ড জনসন।

 

আরও পড়ুন: আতঙ্কের স্মৃতি কী ভাবে ধরে রাখে মস্তিষ্ক, হাতেকলমে দেখালেন বিজ্ঞানীরা

 

কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, কনট্যাক্ট লেন্সের মধ্যেই চক্ষুরোগের ওষুধ সংযোজন করার। এই অসুখগুলোর মধ্যে অন্যতম ক্যাটারাক্ট (Cataract) এবং গ্ল্যুকোমা (Glucoma)। সারা বিশ্বে অন্ধত্বের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী এই দুই অসুখ। ২০২০ সালে সারা বিশ্বে গ্লুকোমা রোগীর সংখ্যা ছিল ১.৫ মিলিয়ন। অন্যদিকে প্রতি বছর অন্তত এক মিলিয়ন মানুষ ক্যাটারাক্টে আক্রান্ত হন। হু-এর ২০১৮ সালের সমীক্ষা বলছে, বিশ্বজুড়ে ৫১ শতাংশ অন্ধত্বের পেছনে ক্যাটারাক্ট দায়ী।

 

এই দুই রোগের চিকিৎসার জন্যই রোগীদের চোখের ড্রপ ব্যবহার করতে বলা হলেও, অনেক রোগীই ভুলে যান, সময়মতো চোখে ড্রপ দিতে, জানাচ্ছেন ডাক্তাররা নিজেই। পাশাপাশি চোখে ড্রপ দেওয়ার পরে, সাধারণত চোখ থেকে জল বেরোয়। আর সেই জলের সঙ্গেই ওষুধের বেশিরভাগটাই চোখের বাইরে বেরিয়ে যায়। যার ফলে ওষুধ প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য আর সফল হয় না।

 

অন্যদিকে চোখের রেটিনা-সংক্রান্ত বেশ কিছু অসুখ, যেমন ধরা যাক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (Diabetic Retinopathy) কিংবা ওয়েটেজ রিলেটেড ম্যাক্যুলার ডিজেনারেশনের (Wet Age-related Macular Degeneration) চিকিৎসার জন্য চোখে সরাসরি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। সেই প্রক্রিয়া যে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তা-ই নয়, এর ফলে চোখ থেকে রক্তপাত, এমনকী ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা থাকে।

 

লেন্সের সাহায্যে সরাসরি চোখে ওষুধ প্রয়োগ করার জন্য এই ধরনের বেদনাদায়ক পদ্ধতির প্রয়োজন হয় না। বাদবাকি আশঙ্কাও একেবারেই নেই। উপরন্তু, পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ চোখের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে দীর্ঘ সময় ধরে।

 

তবে কনট্যাক্ট লেন্সে প্রয়োজনীয় ওষুধ মেশানো খুব সোজা ছিল না গবেষকদের কাছে । যথেষ্ট প্রযুক্তিগত বাধার শিকার হতে হয়েছে তাঁদের।

 

কনট্যাক্ট লেন্স তৈরি হয় হাইড্রোজেল (Hydrogel) দিয়ে। হাইড্রোজেল অত্যন্ত মোলায়েম, জল-শোষণকারী (Water-absorbent), স্বচ্ছ জেলের মত পদার্থ। জল শোষণ করলেও, এরা জলে দ্রবীভূত হয় না কিংবা এদের গঠনের কোনও পরিবর্তন হয় না।

 

রাসায়নিক গঠনের নিরিখে ব্যাখ্যা করলে, হাইড্রোজেল হলো প্রাকৃতিক পলিমার (Natural Polymer)। 'পলি' কথার অর্থ বহু। একই ধরনের পলিস্যাকারাইড এবং প্রোটিন অণু, বহুবার একইভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেল পলিমার গঠন করে।

 

শুধু তাই নয়, হাইড্রোজেলে খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র (Pore) থাকায়, তার মধ্য দিয়ে অক্সিজেন সহজে প্রবেশ করে, চোখের লেন্সে ঢাকা অংশের সংস্পর্শে আসতে পারে। পুরনো প্রযুক্তিতে তৈরি কাচের কনট্যাক্ট লেন্সে কিন্তু সেই সুযোগ ছিল না।

 

তবে লেন্সের সঙ্গে কোন ওষুধ মেশানো হবে, তার (ওষুধের) রাসায়নিক গঠনের ওপর ভিত্তি করে হাইড্রোজেলে গঠনে সামান্য পরিবর্তন আনতে হতে পারে।

 

ধরা যাক কোনও লেন্সে মেশানো হবে অ্যালার্জি-প্রতিরোধী ড্রাগ (যেমন অ্যান্টিহিস্টামাইন), কোথাও মেশানো হবে অ্যান্টিবায়োটিক, কোথাও বা প্রদাহ-উপশমকারী (বা অ্যান্টি-ইনফ্লামেটারি) ড্রাগ। এই সমস্ত প্রকার ড্রাগের রাসায়নিক গঠন আলাদা। তাদের হাইড্রোজেলের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ধরনও আলাদা। স্বাভাবিকভাবেই, ড্রাগগুলো যাতে সংযুক্ত হতে পারে, তার জন্য সামান্য পরিবর্তন আনতে হয় হাইড্রোজেলে।

 

সোজা কথায় বলতে গেলে, পরখ করে নিতে হয় হাইড্রোজেলের সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি ড্রাগ সংযুক্ত হওয়ার জন্য আদৌ রাসায়নিকভাবে উপযুক্ত কি না। আর তার ওপর ভিত্তি করেই বদল আনতে হয় হাইড্রোজেলের গঠনে।

 

দেখা গেছে, কিছু কিছু সংস্থার বানানো লেন্সের হাইড্রোজেলের সঙ্গে, বেশ কিছু ধরনের ওষুধ বেশিক্ষণ একসঙ্গে থাকতে পারে না। তার আগেই তারা লেন্স থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে লেন্সের হাইড্রোজেল এবং ওষুধ, রাসায়নিকভাবে পরস্পরের উপযুক্ত হলে খুব ভালোভাবে পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে ওষুধগুলো সহজে লেন্স থেকে বেরিয়েও যায় না। এবং চোখে এই ধরনের কনট্যাক্ট লেন্স লাগানোর পরে, দীর্ঘক্ষণ ধরে ওষুধটি চোখে মিশতে থাকে। ফলে এক্ষেত্রে ওষুধের কার্যকারিতা আই ড্রপের সাহায্যে প্রয়োগ করা ওষুধের তুলনায় অনেকাংশে বেশি হয়।

 

লেন্স থেকে যদি খুব দ্রুত ওষুধগুলো বেরিয়ে যায়, তাহলে হয়তো দ্রুত তাদের কার্যক্ষমতাও প্রকাশ পায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে ওষুধের কার্যক্ষমতার স্থায়িত্ব কয়েক ঘণ্টার বেশি হয় না। কিন্তু জনসন অ্যান্ড জনসনের বানানো লেন্স থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ওষুধগুলি নির্গত হচ্ছে। ফলে তাদের প্রভাব থাকছে দীর্ঘক্ষণ।

 

লেন্সগুলোকে ড্রাগ বা ওষুধগুলোর সঙ্গে রাসায়নিকভাবে উপযুক্ত করে তোলার জন্য এই সংস্থার গবেষকরা ন্যানো টেকনোলজি এবং মলিকিউলার ইমপ্রিন্টিং-এর ব্যবহার করেছেন। ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাইড্রোজেল ন্যানো পার্টিকলকে পাশাপাশি বসিয়ে লেন্স তৈরি করা হয়েছে‌।ন্যানো পার্টিকল ব্যবহারের অন্যতম সুবিধে হল, এদের উপরিতলের মোট আয়তন, এদের আকারের অনুপাতে অনেক হয়। ফলে ওষুধগুলো লেগে থাকার জন্যে অনেক বেশি আয়তনের পৃষ্ঠতল পায়।

 

অন্যদিকে, মলিকিউলার ইমপ্রিন্টিং (Molecular Imprinting) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে আগে থেকেই হাইড্রোজেল পলিমারের একটি ধাঁচ বা ইমপ্রিন্ট বানিয়ে রাখা হয়। উপযুক্ত ধাঁচ বানিয়ে, সেই ধাঁচে ফেলেই হাইড্রোজেল লেন্সগুলোকে বানিয়েছে জনসন অ্যান্ড জনসন। হাইড্রোজেলে কয়েক ন্যানোমিটার ব্যাসের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে। হাইড্রোজেল পলিমারের ধাঁচগুলিকে প্রয়োজন বুঝে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে সেই ছিদ্রগুলো দিয়ে ওষুধ খুব দ্রুত বেরিয়ে যেতে না পারে।

 

তৃতীয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, চোখে লাগানোর তিন মিনিটের মধ্যেই ওষুধের কাজ শুরু হয়ে যায়। এবং টানা বারো ঘণ্টা থাকে এদের কার্যক্ষমতা। গবেষকদের মতে, এত দীর্ঘ সময় ধরে আগে কোনও কনট্যাক্ট লেন্স থেকে ক্রমাগত ওষুধ নির্গত হয়ে চোখে মিশতে দেখা যায়নি। তবে লেন্সগুলো একদিনের বেশি ব্যবহার করা যাবে না।

 

মেলিসা বার্নেটের মতে, এরকম কনট্যাক্ট লেন্স, ভবিষ্যতেও বিভিন্ন চোখের রোগ নিরাময়ের পথ দেখাবে। স্বাভাবিকভাবেই চক্ষুরোগের চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন মেলিসা।

 

 

More Articles