আতঙ্কের স্মৃতি কী ভাবে ধরে রাখে মস্তিষ্ক, হাতেকলমে দেখালেন বিজ্ঞানীরা
স্মৃতি কী ভাবে মস্তিষ্কের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে রয়ে যাচ্ছে, তা হাতেকলমে এতদিন দেখেননি বিজ্ঞানীরা কখনও।
কথায় বলে,"ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়"। যে কথা ব্যখ্যা করলে দাঁড়ায়, আতঙ্কের অভিজ্ঞতার সাথে জড়িয়ে থাকা কোনো বস্তু, বর্ণ, গন্ধ, এমনকী শব্দও পরবর্তীকালে চোখে দেখলে বা কানে শুনলে, সেই আতঙ্কের স্মৃতি আবার আমাদের মনের কোনে হানা দেয়। কিন্তু কী ভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে সেই স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে রয়ে যায়, সেই প্রশ্ন বোধহয় আমাদের সবাইকেই কম-বেশি ভাবিয়েছে । স্মৃতি কী ভাবে তৈরি হয় মানুষের মস্তিষ্কে, তা বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা ছিল না। কিন্তু স্মৃতি কী ভাবে মস্তিষ্কের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে রয়ে যাচ্ছে, তা হাতেকলমে দেখেননি বিজ্ঞানীরা কখনও।
এবার গবেষকরা চোখের সামনে ছবির মতো দেখলেন, ঠিক এই রকম অনুভূতির স্মৃতি মস্তিষ্কে কী ভাবে রীতিমতো বসে যাচ্ছে। দ্য প্রসেডিং অফ দ্য ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস নামের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হল সেরকমই এক গবেষণা, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখা জে়ব্রা ফিশের মস্তিষ্কের দিকে নজর রাখতে, স্মৃতি তৈরির প্রক্রিয়া যেন সাক্ষাৎ দেখা দিল তাঁদের। যখনই জেব্রা ফিশের মস্তিষ্কে স্মৃতি তৈরি হল, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশ চকমকে সবুজ রঙে আলোকিত হয়ে উঠল।
স্মৃতি কী ভাবে তৈরি হয়
আদতে স্মৃতি যখন তৈরি হয়, তখন সাধারণত দুটি নার্ভ কোশ বা নিউরোনের সংযোগস্থল অর্থাৎ সাইন্যাপসের গঠনগত পরিবর্তন হয়। নিউরোসায়েন্টিস্টরা সাধারণত মনে করেন মস্তিষ্কে স্মৃতি জমা হয় যখন দুটি নিউরোনের মধ্যবর্তী অংশ অর্থাৎ সাইন্যাপসে পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু বেশিরভাগ নিউরোসায়েন্টিস্টই মনে করেন একটি নিউরোন পরবর্তী নিউরোনকে কত বেশি উদ্দীপ্ত করল বা তার সঙ্গে নিজের যোগাযোগ কতটা দৃঢ় করল তার উপর নির্ভর করে স্মৃতির তৈরি হওয়া ।
হ্যাঁ, স্মৃতি এই ভাবেই তৈরি হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমেই মস্তিষ্কে স্মৃতি গঠিত হয়, আর সেই অদ্ভুত সুন্দর পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করলেন গবেষকরা।
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা আশা করছিলেন, স্মৃতি গঠনের সময়ে মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ গঠন হয়তো বদলে যাবে। কিন্তু তাঁরা দেখলেন দুটি নিউরোনের মাঝখানে অবস্থিত কয়েক ন্যানোমিটারের ফাঁক, যাকে সাইন্যাপস বলে, তার গঠন যেন পুরো বদকে গেল চোখের সামনে। প্রত্যাশার থেকে বেশি কিছুই দেখতে পেলেন তাঁরা যেন।
গবেষকরা এই অসাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে একটি সিদ্ধান্তে এলেন - সব ধরণের স্মৃতি একই ভাবে তৈরি হয় না। স্মৃতির ধরণ বদলের সাথে সাথে, মস্তিষ্কে তাদের গেঁথে যাওয়ার প্রকৃতিও বদলে যাবে। অর্থাৎ সুখস্মৃতি যে ভাবে মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয়, কষ্ট বা ভয়ের স্মৃতি সেই ভাবে আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি হয় না এবং সংরক্ষিত হয় না।
এই ঘটনা কিছুটা হলেও যেন ইঙ্গিত দেয়, কিছু কিছু আতঙ্কের স্মৃতি বা দুঃখের ক্ষত কেন গভীর ভাবে আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যায়, কেন তাদের ভোলা খুব কঠিন হয়ে ওঠে।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত গবেষক স্কট ফ্রেজা়র জানাচ্ছেন, কিছু স্মৃতি মস্তিষ্ক এমনভাবেই সংরক্ষণ করে, যেগুলো খুব সহজেই ভোলা যায়। কিন্তু আতঙ্কের স্মৃতি মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয় সম্পূর্ণ অন্যভাবে। সুগভীর ভাবে যেন গেঁথে যায় সেই স্মৃতিগুলো। এবং সেই জন্যেই কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, ঘটনা ঘটার কয়েক বছর পরেও, আতঙ্কের স্মৃতি এমন ভাবে হানা দেয়, যেন সে আবার সেই একই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
স্মৃতি বিষয়ক গবেষণা করার জন্যে, সাধারণত মস্তিষ্কের কর্টেক্সকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কর্টেক্স থাকে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কের উপরের ভাগে। কিন্তু মস্তিষ্কের যে অংশ থেকে ভয়ের অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয় - অর্থাৎ মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশটি - সেই অংশকে কিন্তু এর আগে এত খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।
কিন্তু কী ভাবে এই ধরনের স্মৃতি তৈরি হয় মানুষের ক্ষেত্রে, তা কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনও খুব ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। আর তার অন্যতম কারণ মানুষের মস্তিষ্কের জটিল গঠন। মানুষের মস্তিষ্কের এরকম অনেক অঞ্চলই আছে, যা সহজে পর্যবেক্ষণ করা যায় না, যতক্ষণ না মস্তিষ্ক ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে। আর স্মৃতি কী ভাবে তৈরি হচ্ছে, তা প্রত্যক্ষ করতে হয় একজন জীবন্ত মানুষের মস্তিষ্ককে পর্যবেক্ষণ করে। সেখানে মস্তিষ্ক ব্যবচ্ছেদের প্রশ্নই অবান্তর।
আরও পড়ুন-অভাবের সংসারে রবি ঠাকুরের জন্য চাদর আর পার্থ-গৌরী ঘোষের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ
সেক্ষেত্রে ভরসা জে়ব্রা ফিশ। কারণ এদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং মস্তিষ্কের কেন্দ্রভাগ সহজেই চোখে দেখা যায়। মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধির মূল ধাপে স্তন্যপায়ীদের মত এদের মস্তিষ্ক বেলুনের মত বড় আকার ধারণ করে না। তার থেকেও মজার বিষয় জে়ব্রা ফিশের লার্ভা স্বচ্ছ, আরোই সুবিধে তার মস্তিষ্ককে চোখ দিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখা।
স্মৃতি তৈরি হওয়ার সময় মস্তিষ্কে কিন্তু এমন সবুজ আলো আসলে জ্বলে ওঠে না। খানিকটা কৃত্রিম ভাবেই জেব্রা ফিশের মস্তিষ্কে এই সবুজ আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন ব্যবস্থা করেছিল গবেষকরা। অর্থাৎ এই প্রোটিনগুলি সবুজ রঙে জ্বলে উঠে জানান দেবে সাইন্যাপসে পরিবর্তন ঘটল। স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণের হওয়ার জন্যে যে পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।
প্রোটিনও জ্বলে ওঠে? তা-ও সবুজ রঙে? বুজরুকি মনে হতেই পারে পাঠকের। জোনাকির আলোও কিন্তু দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনের জ্বলে ওঠার ফলেই । শুধু জোনাকির ক্ষেত্রে দায়ী এই প্রোটিনটির নাম লুসিফারিন, আর এই গবেষণায় ব্যবহৃত প্রোটিনটির নাম গ্রিন ফ্ল্যুরেসেন্ট প্রোটিন।
স্বাভাবিক অবস্থায় জে়ব্রা ফিশের শরীরে গ্রিন ফ্ল্যুরেসেন্ট প্রোটিন থাকে না। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমেই এটি সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জে়ব্রা ফিশের শরীরে প্রবেশ করিয়েছিলেন, স্রেফ গবেষণার স্বার্থে।
জে়ব্রা ফিশের স্মৃতি তৈরি করার জন্যে তাদের কী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করলেন বিজ্ঞানীরা? মাছগুলিকে তীব্র আলোর সামনে ফেলা হল, যে আলো থেকে এত তাপ বেরোতে থাকলো যা জে়ব্রা ফিশের জন্যে অস্বাভাবিক। আতঙ্ক সৃষ্টি হল তাদের মধ্যে। আর তারপরেই মাইক্রোস্কোপের নীচে গ্রিন ফ্ল্যুরসেন্ট প্রোটিন জ্বলে উঠতে দেখা গেল - যা জানান দিল স্মৃতি তৈরি হয়েছে।
গবেষক ফ্রেজা়র জানাচ্ছেন, সব ধরনের আতঙ্কের স্মৃতি-ই যে এই ভাবে তৈরি হবে, তা এই গবেষণা থেকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। কারণ একই ঘটনায় দুই ব্যক্তি আলাদা আলাদা স্তরে আতঙ্কিত হতে পারে। একই ঘটনায় দুটি প্রাণী আলাদা ভাবে আতঙ্কিত হতে পারে। সেই অনুযায়ী মস্তিষ্ক ভিন্ন ভাবে স্মৃতি সংরক্ষণ করবে। তবে গবেষণা থেকে বেশ খানিকটা স্পষ্ট ধারণা করা যায়, আতঙ্কের স্মৃতি মস্তিষ্কে কী ভাবে তৈরি হয়।