গন্ধ শুঁকে কোভিড চিনবে কুকুর, অবিশ্বাস্য প্রমাণ বিজ্ঞানীদের কাছে

আপনি বা আপনার আশেপাশে কেউ কোভিড আক্রান্ত কি না, তা-ও সারমেয় গন্ধ শুঁকে বলে দেবে? তা-ও পারে এই চতুষ্পদীরা। সম্প্রতি তা হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখালেন ফরাসি বিজ্ঞানীরা।

কুকুরের প্রখর ঘ্রাণশক্তির জন্য তাদের দিয়ে যে মাদক বা বিস্ফোরক শনাক্ত করা হয়, সেকথা তো সকলের জানা। কিন্তু কখনও শুনেছেন, আপনি বা আপনার আশেপাশে কেউ কোভিড আক্রান্ত কি না, তা-ও সারমেয় গন্ধ শুঁকে বলে দেবে?

তা-ও পারে এই চতুষ্পদীরা। সম্প্রতি তা হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখালেন ফরাসি বিজ্ঞানীরা। সেই গবেষণা প্লস ওয়ান (PLOS One) নামের বৈজ্ঞানিক জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে।

আরটি-পিসিআর (RT-PCR) বা অ্যান্টিজেন টেস্ট একটি সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি। তার থেকেও বড় কথা, ভিড়ে উপস্থিত কারও কোভিড আছে কি না, তা কোনওভাবেই শনাক্ত করা যায় না এই দুই পদ্ধতির সাহায্যে। যে-সমস্ত রোগী কোভিডের লক্ষণহীন বা অ্যাসিম্পটম্যাটিক, তাঁরা জানেনই না তাঁরাও যে কোভিডে ভুগছেন। আবার অনেক কোভিড রোগী জ্ঞাতসারেই ভিড়ে ঘুরে বেড়ান, অন্যের সংক্রমণের তোয়াক্কা না করে।

আরও পড়ুন: এই বছরেই শেষ হচ্ছে না অতিমারী, মনে করছেন বিজ্ঞানীরা

সারমেয়রা যদি গন্ধ শুঁকেই কোভিড শনাক্ত করতে পারে, তাহলে খুব সহজে রেল স্টেশন, এয়ারপোর্ট, স্কুল, কলেজ বা উৎসব-অনুষ্ঠানে উপস্থিত মানুষদের কোভিড আছে কি না তা সহজেই বোঝা যাবে ও উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা যাবে। এয়ারপোর্ট বা রেল স্টেশনের মতো জায়গা থেকেই দেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংক্রামক রোগগুলি ছড়িয়ে পড়ে। তার ব্যতিক্রম হয়নি কোভিড বা মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও।

পাশাপাশি, আরটি-পিসিআর করার জন্য নাক থেকে নমুনা সংগ্রহ করার পদ্ধতিটি রোগীর পক্ষে ভীষণ কষ্টদায়ক। অনেকেই সূচ ফোটানোর থেকেও বেশি ভয় পায় এই পদ্ধতিকে। এদিকে মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীদের শরীর থেকে কোভিড শনাক্তকরণের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বলা যেতে পারে, সমস্যাজনক এই পদ্ধতি থেকে মুক্তি দেবে সারমেয়দের এই গুণ।

পরীক্ষার সময় কিছু কোভিড রোগীর নাক (Nasopharyngeal Swab) থেকে এবং কিছু রোগীর লালারস (Saliva) থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বাকি রোগীদের ক্ষেত্রে ঘামের নমুনা সংগ্রহ করে, সেগুলি কুকুরদের সামনে রাখা হয় যাতে তারা ঘ্রাণ নিতে পারে। অবশ্য কোন নমুনাটি সারমেয়টি শুঁকছে, সে-ব্যাপারে সারমেয় বা তার মালিক, কাউকেই আগেভাগে ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সারমেয়রা কিন্তু আগে থেকেই মাদক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের গন্ধ শনাক্তকরণের প্রশিক্ষণ পেয়েছে।

এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনশো পঁয়ত্রিশ জন কোভিড-আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক রোগী। তাঁদের মধ্যে একশো তেতাল্লিশ জনের কোভিডের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, কিন্তু বাকি একশো বিরানব্বই জন কোভিড-আক্রান্ত হলেও, তাঁদের মধ্যে কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। দেখা গেল, কোনও রোগী কোভিডে আক্রান্ত কি না, তা সাতানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে সারমেয়রা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে। এমনকী, অ্যাসিম্পটম্যাটিক রোগীদের ক্ষেত্রে এই শনাক্তকরণ প্রায় একশো শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক ছিল।

কীভাবে সারমেয়রা গন্ধ শুঁকে রোগ শনাক্ত করে, সেই ব্যাখ্যায় আসা যাক।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার (ডেভিস) মেকানিক্যাল এবং এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষকরা ২০১২ ও ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় প্রমাণ করেন, কোনও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগে আক্রান্ত হলে উদ্বায়ী জৈব যৌগ (Volatile Organic Compound) বি-লিম্ফোসাইট থেকে উৎপন্ন হয়। বি-লিম্ফোসাইট রক্তে উপস্থিত এক ধরনের শ্বেতকণিকা, যা মানুষ-সহ বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে রোগপ্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-র এই গবেষকরা পাখি (Avian Influenza H9N2, Avian influenza H6N2) ও মানুষ (Human Influenza H1N1), উভয়ের ইনফ্লুয়েনজা়-র ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করে দেখেন। তবে মজার বিষয় এখানেই, ইনফ্লুয়েনজা়-র আলাদা আলাদা স্ট্রেনে, আলাদা আলাদা উদ্বায়ী জৈব যৌগ তৈরি হয়।

এই গবেষণাগুলির পরে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-র গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যে শরীরে ভাইরাসের প্রবেশের ফলে আমাদের জিনের কাজে সামান্য হলেও যে পরিবর্তন আসে, তার প্রভাব গিয়ে পড়ে শরীরের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়। যার ফলে বিভিন্ন উদ্বায়ী জৈব পদার্থ তৈরি হয়, যেগুলি ঘামের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগ ছাড়াও ক্যানসারের মতো রোগেও বিভিন্ন উদ্বায়ী জৈব পদার্থ তৈরি হয়। গবেষকদের মতে, এই পদার্থগুলির কোনও মানুষের শরীর থেকে নির্গত এই উদ্বায়ী জৈব পদার্থগুলিকে ক্যানসার শনাক্তকরণের কাজে লাগিয়ে, ক্যানসারের চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন আনা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতিতে ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য শরীরে অস্ত্রোপচার বা সামান্য সুঁচ প্রবেশ করানোরও প্রয়োজন পড়বে না।

বিভিন্ন মাদক, বিস্ফোরক দ্রব্যর মতোই সারমেয়রা তাদের ঘ্রাণশক্তি দিয়ে শনাক্ত করতে পারবে ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া এই উদ্বায়ী জৈব পদার্থগুলিকে।কোভিডের ক্ষেত্রেও যে একইভাবে উদ্বায়ী জৈব পদার্থগুলি ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, ২০২০ সালেই প্রমাণ করেছিলেন এই ফরাসি গবেষকরাই। পুরনো সেই গবেষণাকে মাথায় রেখে, আরও এক ধাপ এগোলেন তাঁরা।

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আরটি-পিসিআর টেস্টের থেকেও সারমেয়দের জানান দেওয়া ফলাফল অনেক বেশি ভরসাযোগ্য। কারণ গবেষকদের মতে, যদিও কোভিডের শনাক্তকরণের জন্য আরটিপিসিআর একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা, তবুও আরটি-পিসিআর কিংবা অ্যান্টিজেন টেস্ট, এই দুই ক্ষেত্রেই মাঝেমাঝে ভুল ফলাফল পাওয়া যায়। ঠিক তেমনই সারমেয়দের ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক ফলাফল পেয়েছেন গবেষকরা।

তবে সায়েন্স নিউজ় নামের একটি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম মারফৎ জানা যাচ্ছে, এই গবেষণার সঙ্গে নিযুক্ত নন, এমন অনেক গবেষকই আশঙ্কা করছেন বাস্তবে এই চতুষ্পদরা আদৌ গন্ধ শুঁকে কোভিড শনাক্ত করতে পারবে কি না। কারণ গবেষণাগারে অনেক সংরক্ষিত পরিবেশে এই পরীক্ষা করা হয়েছে, সেখানে রোগীর ঘামের নমুনা (স্যাম্পেল) ছাড়া অন্য কোনও গন্ধ যাতে না মেশে, সে-বিষয়ে নজর রাখা হয়েছিল। কিন্তু ভিড়ের মাঝে তো সব গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে।

আবার অনেক গবেষকের মতে, আমরা যদি সারমেয়দের সাহায্যে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মাদক বা বিস্ফোরক খুঁজে পেতে পারি, তাহলে কোভিড-আক্রান্ত রোগীকে কেন খুঁজে দেখতে পারব না?

 

 

More Articles