এই বছরেই শেষ হচ্ছে না অতিমারী, মনে করছেন বিজ্ঞানীরা

তাত্ত্বিকভাবে কোভিড অতিমারী শেষ হতে পারে এবং ধীরে ধীরে তা অতিমারীর দিকেও এগোতে পারে। কিন্তু ড. এরিসের মতে আমরা এখনও জানি না, অতিমারীর পর্যায়ে পৌঁছলেও, কোভিডের রূপ কেমন হবে।

বিগত দুই বছর ধরে আমরা নভেল করোনাভাইরাসের মতো সম্পূর্ন নতুন একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছি।  এই দুই বছরে প্রায় পঞ্চান্ন কোটির কাছাকাছি মানুষ অসুস্থ হয়েছেন কোভিডে, পঁয়ষট্টি লাখের কাছাকাছি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তারই মাঝে একাধিকবার নভেল করোনাভাইরাসের জিন মিউটেশনের ফলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বেশ কিছু ভ্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ্যারিয়েন্ট।

বিগত দুই বছর ধরে যে আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়েছে, কেবল বিশ্বব্যপী অতিমারীর প্রভাবে, তাতে আমূল বদলেছে আমাদের জীবনযাপন।

আমরা বোধহয় গত দুই বছরে প্রতিদিন প্রশ্ন করেছি, এর শেষ কোথায়? সত্যি-ই তো, এইভাবে সংক্রমণের ভয়, ক্লেশের ভয়, মৃত্যুভয় নিয়ে ক'দিনই বা চলতে পারে? আমরা প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করেছি, সত্যি-ই কি কোনওদিনও এর শেষ হবে না? একের পর এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট নতুন রূপ নিয়ে আমাদের আক্রমণ করবে? আমরা এখনও প্রায়শই আতঙ্কে ভুগি এই ভ্যারিয়েন্টগুলি আরও শক্তিশালী হবে, না কি শক্তি হারিয়ে ক্রমেই সাধারণ সর্দি-কাশির ভাইরাসের রূপই ধারণ করবে? বা কোভিডের পরবর্তী ঢেউ যদি আসেও, সেই সময় কি সংক্রমণের হার কমবে? 

আরও পড়ুন: শ্বাসের মধ্যে ভরে নেওয়া করোনা ভ্যাকসিন বেশি কার্যকরী? এবার জানিয়ে দিলেন গবেষকরা

দেখা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডে ইতিমধ্যেই সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, ২০২১ সালের গ্রীষ্মকালের পর থেকে এই প্রথম সবচেয়ে কম সংক্রমণের হার দেখা গিয়েছে ইংল্যান্ডে।

তাহলে কি আমরা সত্যি-ই অতিমারীর শেষ দেখতে চলেছি খুব দ্রুত? ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের বিবর্তন এবং জেনোমিক্স-বিশেষজ্ঞ এরিস ক্যাটজো়কারিসের মতে, এটি অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু আর কিছু সময় না গেলে আমরা কিছুতেই  বলতে পারব না, আমরা অতিমারীর শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম কি না।

তবে আশা করা যাচ্ছে, কোভিড অতিমারী থেকে মহামারীতে পৌঁছবে। অর্থাৎ, তখন রোগটি বেশ কিছু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এবং রোগটি অতিমারী স্তরে পৌঁছলেই, জনসংখ্যার সার্বিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ভাইরাসের প্রজননের হারের মধ্যে সমতা আসবে। ফলে বাৎসরিকভাবে কোভিড রোগীর সংখ্যা একটা সময়ের পর আর বাড়বে না।

কত দ্রুত অতিমারীর শেষ আমরা দেখব এবং শেষ পর্যায়ে গিয়ে তার রূপ কী হবে, তা নির্ভর করছে দু'টি বিষয়ের ওপর। সেই দু'টি বিষয় হলো, আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী হবে? দ্বিতীয়ত, নভেল করোনাভাইরাস কত দ্রুত ও কীভাবে বিবর্তিত হয়ে নতুন রূপ ধারণ করবে, এবং আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসটির বিবর্তনকে কতটা প্রভাবিত করবে।

এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের আবার বিবেচনা করে দেখতে হবে, দীর্ঘ দুই বছরব্যপী অতিমারী থেকে আমরা কী শিক্ষা লাভ করেছি। সেখানেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রশ্নের উত্তর।

ড. এরিস জানাচ্ছেন, ২০২০ সালে যখন কোভিডের সবথেকে বেশি উৎপাত ছিল, আমরা খেয়াল করেছিলাম, কত দ্রুত সেই ভাইরাস এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির শরীরে সংক্রমিত হচ্ছে। অবশ্য ২০২১ সালের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমরা আলফা ভ্যারিয়েন্টের দাপট দেখেছি বিশ্বজুড়ে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাথমিক স্ট্রেনের জায়গা দখল করে আলফা ভ্যারিয়েন্ট এই সময়। প্রাথমিক স্ট্রেনের তুলনায়, এই ভ্যারিয়েন্টটির ফলে অনেক বেশি মানুষ অসুস্থ হয়েছে। এর প্রকোপে রোগের বীভৎসা যেমন মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল, মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। আলফা ভ্যারিয়েন্ট প্রাথমিক ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় পঞ্চাশ শতাংশরও বেশি সংক্রামক।

এদিকে যখন বিটা এবং গামা ভ্যারিয়েন্ট মাথা চাড়া দিল, দেখা গেল তারা খুব সহজেই ভ্যাকসিনের প্রভাবে তৈরি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমাদের শরীরে বাসা বাঁধছে। ধীরে ধীরে এল ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট, যা আবার আলফা ভ্যারিয়েন্টের থেকে পঞ্চাশ শতাংশর বেশি সংক্রামক।

পাশাপাশি এটাও সত্যি, ২০২১ সালের শেষ বা চলতি বছরের শুরুতে যখন নভেল করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টে, ওমিক্রনে পৃথিবীবাসী আক্রান্ত হচ্ছিল, রোগের ভয়াবহতা, মৃত্যুর হার এবং হাসপাতালে কোভিড রোগীকে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা অনেক কম হারে আমরা খেয়াল করেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোভিড সাধারণ সর্দি-কাশির রূপেই দেখা দিয়েছে। এযাবৎ ওমিক্রনই একমাত্র ভ্যারিয়েন্ট, যার চারটির কাছাকাছি সাব-ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গিয়েছে। তারাও অনেক বেশি সংক্রামক হলেও, কোনও সাব-ভ্যারিয়েন্টের ফলেই কিন্তু রোগের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেনি।

কিন্তু তারপরেও সেই ভাইরাস অন্যান্য আর.এন.এ. ভাইরাসের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম হারে বিবর্তিত হয়। অবশ্য হু-এর কোভিড ১৯ টেকনিক্যাল লিড ড. মারিয়া ভ্যান কারকোভ, একটি মাঙ্কিপক্স এবং অন্যান্য ভাইরাস-জনিত অসুখ সম্বন্ধীয় সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, নভেল করোনাভাইরাস কিন্তু বিবর্তিত হতে থাকবে। অর্থাৎ, একাধিক ভ্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতেই থাকবে নভেল করোনাভাইরাসের।

ড. এরিস জানাচ্ছেন, একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যার মানুষ কোভিডে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তারপরেও আমাদের অজানা, পরবর্তী কোভিড সংক্রমণের ফলে রোগের প্রকোপ আদৌ কমবে কি না। যদিও দেখা গেছে, যেহেতু প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরে দেহে নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে এমন অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েই যায়, ফলে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে রোগের প্রকোপ অল্পের ওপর দিয়েই যায়। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থেকেই যায়। যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিবডির সংখ্যা কমতে থাকে, আবার প্রাথমিক সংক্রমণের দীর্ঘদিন পর কোভিডে আক্রান্ত হলে কতটা ভুগতে হরে পারে রোগীকে? না কি ততদিনে, আমাদের চারপাশে সমস্ত মানুষ কোভিডের বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলায়, কোভিডে মাথাচাড়া দিলেও, তার প্রকোপ বেশি হবে না?

তাত্ত্বিকভাবে কোভিড অতিমারী শেষ হতে পারে এবং ধীরে ধীরে তা অতিমারীর দিকেও এগোতে পারে। কিন্তু ড. এরিসের মতে আমরা এখনও জানি না, অতিমারীর পর্যায়ে পৌঁছলেও, কোভিডের রূপ কেমন হবে। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, অতিমারী স্তরে পৌঁছলেও, সময়ে সময়ে কোভিড ঢেউয়ের আকারে ফিরে আসবে কি না।

অবশেষে ড. এরিস জানাচ্ছেন, কোভিড অতিমারী এই বছর কোনওভাবেই শেষ হচ্ছে না। কিন্তু উচ্চহারে টিকাকরণ হয়েছে, যে সমস্ত দেশে, সেই দেশগুলি থেকেই আন্দাজ করা যায় এই অতিমারীর ভবিষ‍্যৎ কী হতে চলেছে। আশার কথা হলো, ধীরে ধীরে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমবে। শুধু তাই নয়, পুনরায় কোভিডে আক্রান্ত হলে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমস্যার সমাধান করা যাবে, সেই ধারণাও আমাদের ইতিমধ্যেই আছে, জানাচ্ছেন ড. এরিস।

More Articles