দৈনন্দিনের স্ট্রেস কমাতে পারে ভিডিও গেম! মানসিক স্বাস্থ্যোদ্ধারের পথে এক পা...

ভিডিও গেমে মনের শুশ্রুষা! হ্যাঁ এমনটাও সম্ভব। এমন ভিডিওগেম আছে গেমবাজারে  যা আমাদের দৈনন্দিন মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমাবে এবং আদতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করবে।  রোবলক্স, মাইনক্রাফট- এমন বেশ কয়েকটি ভিডিও গেমই এই তালিকায় রয়েছে।এই ভিডিও গেমগুলি কিন্তু শরীরচর্চা এবং মেডিটেশনের পরিপূরক নয়, বলতে পারি এগুলি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে সংযোজিত একটি পদ্ধতি মাত্র। 

ঠিক কী কী উপসর্গ থাকে স্ট্রেসের, যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়? শুরুতেই বলা ভালো সকলেই কিন্তু স্ট্রেসের মধ্যে গেলে একই রকম ভাবে শারীরিক বা মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখান না। কে কেমন ব্যবহার করবে এটা তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শারীরিক অবস্থা, এমনকী জিনের উপর নির্ভর করে। স্ট্রেসের প্রাথমিক এবং অত্যন্ত সাধারণ উপসর্গগুলির মধ্যে দুঃশ্চিন্তা, ঘুমের ব্যাঘাত, খিদে কমে যাওয়া বা অত্যন্ত খিদে বেড়ে যাওয়ার মত ঘটনা দেখা যায়। এর পরবর্তী ধাপে অকারণ বিরক্ত হয়ে থাকা, অবসাদ, অল্পেই রাগ হওয়া, পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার মত ঘটনা ঘটে।  স্ট্রেসের ফলে স্মৃতিভ্রংশ এবং মনোযোগের অভাব খুব স্বাভাবিক ঘটনা।

এই ভিডিও গেম দৈনন্দিন স্ট্রেস উপশমে কী ভাবে সাহায্য করে

জানা দরকার স্ট্রেসের স্বীকার আমরা কী ভাবে হই। প্রথমেই বলে রাখি স্ট্রেস মানেই সব সময়ে ক্ষতিকর নয়। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্ট্রেস বললে ক্ষতিকর বোঝানো হয়ে থাকে এবং এই প্রতিবেদনেও তাই-ই বোঝানো হচ্ছে। ধরা যাক, আপনাকে বলা হল দুই ঘন্টার মধ্যে আপনাকে একশোটা অঙ্কের সমাধান করতে হবে। এটি স্ট্রেস আপনার মস্তিষ্কের পক্ষে অবশ্যই, কিন্তু দেখা গেল আপনি ঘাবড়ে না গিয়ে অংকগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করার দিকে জোর দিলেন। এতে কিন্তু খুব দ্রুত ভাবনা-চিন্তা বা গাণিতিক সমাধানের ক্ষমতা বাড়লো আপনার।

অন্য দিকে দেখা গেল, আপনি রোজ এক বা একাধিক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন। শুরুতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে সেগুলি গ্রহণ করলেও, একদিন দেখলেন আপনারই ধৈর্যের সীমা হারাচ্ছে বা আপনার পক্ষে সেগুলো অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই আপনার খারাপ বা ‘ব্যাড’ স্ট্রেসের শুরু।

এবার আসা যাক এই বিশেষ ভিডিও গেমগুলি স্ট্রেস উপশম এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কী ভাবে সাহায্য করে সেই প্রসঙ্গে। এই ভিডিও গেমগুলি প্লেয়ারদেরকে বেশ কয়েক ঘন্টা যেহেতু খেলার মধ্যেই মশগুল রাখে, গেমগুলি নিজেই মেডিটেশন বা ধ্যানের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘদিন এই ভিডিও গেম অভ্যাস করলে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স আরও সক্রিয় হয়। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স মস্তিষ্কের একদম অগ্রভাগ, যা কপালের কাছাকাছি থাকে। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স আমাদের বৌদ্ধিক কাজকর্ম, ব্যক্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সামাজিক আচার-আচরণ, এমনকি সাম্প্রতিকতম স্মৃতি ধারণে সাহায্য করে। স্ট্রেসের সম্মুখীন হলে কিন্তু প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এর ফলে আচার-আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়।

এদিকে এই ভিডিও গেমগুলি সাময়িক খেললেই দেখা গেছে সেরোটোনিন এবং মেলাটোনিন নামের দুটি নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা বাড়তে থাকে। সেরোটোনিন আমাদের আচার-ব্যবহার, মানসিক অবস্থার উন্নতি, খিদে বাড়ানো ইত্যাদির সাথে সরাসরি যুক্ত। আর অন্যদিকে মেলাটোনিন আমাদের ঠিক সময় ঘুম হওয়া এবং জেগে ওঠার রুটিনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

আরও পড়ুন-মহামারী থেকে খাদ্যসংকট, অশনিসংকেতের মাঝেই বিশ্বের সামনে জয়ের হাতছানি

এদিকে এই ভিডিও গেমগুলিতে আপনি ছোটো-ছোটো লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারবেন নিজের জন্যে। দৈনন্দিনে এরকম অনেক লক্ষ্যমাত্রাই আমরা ঠিক করি নিজেদের জন্যে, কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি না সবসময়। এতে আত্মবিশ্বাস কমে, নিজেকে অনেক সময়ে নিজের কাছে ছোটো লাগে। কিন্তু এই বিশেষ ভিডিও গেমগুলিতে ছোটো ছোটো লক্ষ্যে পৌঁছলে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এদিকে এর ফলে বাড়তে থাকে ডোপামিন, যাকে চলতি কথায় বলে কি-না "হ্যাপি হরমোন"। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে ডোপামাইন বাড়লে যে আপনার মন ভালো হবে, আপনার সব কিছু আবার ভালো লাগবে।

দীর্ঘক্ষণ এক মনে ভিডিও গেমে ডুবে থাকায় সিঙ্গুলেটেড গাইরাস নামে কর্টেক্সের মধ্যবর্তী একটি অংশও বিশেষ ভাবে কার্যকরী হয়ে আমাদের স্মৃতিশক্তি এবং নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা  বাড়ায়। এর পাশাপাশি কার্যক্ষমতা বাড়তে থাকে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস, আমিগডালা, এবং ইন্টেরিয়র সিঙ্গুলেটারের; আর সেই কারণেই আবার বাড়তে থাকে স্মৃতিশক্তি ও অনুভূতি বাড়ায় এবং দৈনন্দিন জীবনে অণুপ্রেরণা জোগায়।

পাশাপাশি এই বিশেষ ভাবে তৈরি ভিডিও গেমগুলি খেলার ফলে আমাদের প্যারাসিম্প্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র আরও কার্যকরী হয়। আর এই স্নায়ুতন্ত্র সরাসরি যুক্ত থাকে হার্টরেট, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং অক্সিজেন সরবরাহে। ফলে স্ট্রেসের ফলে আমাদের হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হয় ও রক্তচাপ বাড়তে থাকে, সেই অবস্থার আবার উন্নতি হতে থাকে।

সবশেষে বলা যায়,  যে কোনো ধরণের ভিডিও গেম কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তার থেকেও বড় কথা, এই সমস্ত ভিডিও গেমের উদ্দ্যেশ্য কিন্তু কোনো ভাবেই আপনার স্ক্রিনটাইম বাড়ানো নয়। মহামারীর সময় যখন সারা পৃথিবী লকডাউনে কাটিয়ে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের বারোটা বাজাচ্ছিলো, বিশেষত সেই পরিস্থিতির কথা ভেবেই এই ভিডিও গেম তৈরি।

More Articles