মহামারী থেকে খাদ্যসংকট, অশনিসংকেতের মাঝেই বিশ্বের সামনে জয়ের হাতছানি

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রকো শেষ হয়নি, এর মধ্যেই বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে আরও একাধিক মহামারীর সম্মুখীন হতে পারে সারা বিশ্ব। আর তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্টেন্স বা সোজা কথায় ব্যাক্টিরিয়াদের এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার মত বিষয়। এমন দিন আসতেই পারে যখন গোটা বিশ্ব হয়তো কিছু বিশেষ শ্রেণির ব্যাক্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হচ্ছে, সেই অসুখ একজনের থেকে অপরজনের মধ্যে ছড়াচ্ছে, এদিকে সেই ব্যাক্টিরিয়াকে এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেও প্রতিহত করা যাচ্ছে না।

 এ তো গেল সাম্প্রতিক এবং আগামীদিনের সম্ভাব্য মহামারী নিয়ে আশঙ্কা। কিন্তু এর পাশাপাশি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের মত ভয়াবহ ঘটনা। জলবায়ু দূষণ কিন্তু ইতিমধ্যেই আঘাত হেনে ফেলেছে আপনার খাওয়ার থালায়। একদিকে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, অসময়ে বৃষ্টিপাত, ক্রমবর্দ্ধমান তাপমাত্রা চাষের ক্ষতি করছে বিপুল ভাবে। ফলে বিশ্বব্যপী খাদ্যসুরক্ষাও সঙ্কটের মুখে। সারা বিশ্বে চাষের ক্ষতি বেশী হলেও, এশিয়ার দেশগুলিতে এর প্রভাব পড়বে সর্বাধিক। শুধু তাই-ই নয় বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আর এক ডিগ্রি বাড়লেই ভারতের কৃষিকাজ এত ক্ষতিগ্রস্থ হবে, যে তা-তে  ভারতের জিডিপি তিন শতাংশ হ্রাস পাবে।

এখন এই পরিবর্তিত জলবায়ুর সামনে দাঁড়িয়ে, যেখানে খাদ্যসুরক্ষাও প্রশ্নের মুখে, সেখানে আমাদের কাছে একটাই উপায়: শষ্য উৎপাদনকারী গাছগুলিকে  ক্রম-পরিবর্তিত জলবায়ুতে টিকে থাকার উপযোগী বানানো, শুধু তাই-ই নয় তারা যাতে শষ্য উৎপাদন যথাযথ ভাবে কম সময়ের মধ্যে করতে পারে, সেই বিষয়ে নজর দেওয়া। তাও কী সম্ভব? বিজ্ঞানীরা ঘাড় নেড়ে মুচকি হাসছেন। বলছেন, এই ধরনের যাবতীয় সমস্যার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করার একটাই উপায়, তা হল জিন -এডিটিং।

ক্রিস্পার ক্যাসের জগতে পা রাখতে চলেছি আমরা

হ্যাঁ, ক্রিস্পার ক্যাসের জগতে আপনাকে স্বাগত। ক্রিস্পার-ক্যাস জিন-এডিটিং-এর জন্যে একটি কার্যকারী প্রযুক্তি, এ দিয়ে কেবল কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহে প্রয়োজনীয় জিন প্রবেশ করানো যায় এমনই নয়, ক্ষতিকারক বা অপ্রয়োজনীয় কোনও জিনও সরিয়ে ফেলা যায়। ঠিক এই কারণেই ক্রিস্পারকে বলা হয় মলিকিউলার-সিজা়র বা আণবিক কাঁচি। আর ঠিক এইখানেই ক্রিস্পার-ক্যাসের উপযোগিতা দেখা যায় অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়াদের প্রতিরোধ করতে। অথবা শষ্য উৎপাদনকারী কোনও গাছে নতুন জিন প্রবেশ করিয়ে তাদেরকে জলবায়ু পরিবর্তনের মত সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে লড়াই করার উপযোগী  করে তুলতে।

ব্যাক্টেরিয়াগুলি কেবল মাত্র একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে টিকে থাকতে, তাদের প্রতিরোধ করতে এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক- রোধী জিন গঠন করে শরীরে। এবং এই বিবর্তন খুব দ্রুত গতিতে ঘটে। এমনকী এই অ্যান্টিবায়োটিক- প্রতিরোধী জিনগুলি ব্যাক্টিরিয়ার জননের সময় (বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাক্টিরিয়ার জনন পদ্ধতিকে বলে কনজুগেশন), এক ব্যাক্টেরিয়ার কোষ থেকে আরেক ব্যাক্টিরিয়ার কোষেও বাহিত হতে পারে।

অন্য প্রতিবেদন পড়তে চাইলে-নাৎসিদের হাত থেকে ২৫০০ শিশুকে উদ্ধার করেছিলেন, জেদের অন্য নাম ইরিনা…

২০২০ সালে জেনিফার ডাওডনা এবং এম্যান্যুয়েল কার্পেন্টার নোবেল পুরষ্কার পান ক্রিস্পার-ক্যাস প্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্যে। আর তাঁদের অবিষ্কার কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানেই নতুন দিগন্ত খুলে দেয়নি, বা কঠিন জিনগত অসুখই সারাতে সাহায্য করেনি, বর্তমানে ক্রিস্পার-ক্যাস আশা দেখাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের মত কঠিন পরিস্থিতিতে শস্য এবং ফল উৎপাদন বৃদ্ধিতে, এমনকী অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়াদের প্রতিরোধ করে ভবিষ্যতে সাম্ভাব্য মহামারী থেকে মানবসমাজ এবং জীবজগৎ-কে বাঁচাতে।

ঠিক কী ভাবে কাজ করে ক্রিস্পার-ক্যাস?

ধরা যাক একটি বিশাল লাইব্রেরি থেকে আপনি একটি নির্দিষ্ট বই খুঁজে বের করতে চান, কিন্তু আপনি জানেন না এই হাজার-হাজার বইয়ের মাঝে আপনার বইটি কোথায়। আর সেখানেই আপনাকে লাইব্রেরির ডেটাবেসের সাহায্য নিতে হয়।

 ক্রিস্পার-ক্যাসে প্রযুক্তিতির সাহায্যে কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহে কিংবা ব্যাক্টিরিয়ার কোষে বিশাল সংখ্যক জিনের মধ্যে এক বা একাধিক নির্দিষ্ট জিনকে খুঁজে বের করা যায়। আর ঠিক সেখানেই গিয়ে বসে ক্যাস প্রোটিনটি কাঁচির মত করে কেটে ফেলে অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর জিনটিকে। ধরা যাক ব্যাক্টিরিয়ার কথাই, ক্রিস্পার্-ক্যাস দিয়ে কেটে ফেলা হল এই অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিনকে। আর তাতেই মুশকিল আসান। মহামারীর ভয় থেকে মুক্তি।

এদিকে  আবার শষ্য উৎপাদনকারী গাছের ক্ষেত্রে, জিন এডিটিং এবং নতুন জিন প্রবেশের মাধ্যমে তাদের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা কিংবা সীমিত জলের উপস্থিতিতে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই পর্যাপ্ত শষ্য উৎপাদনের জন্যে উপযোগী করে তোলা। হয়তো এমন জিন সেই সব গাছের শরীরে প্রবেশ করানো হল যার ফলে গাছের দেহ থেকে সহজে জল বেরিয়ে যায় না বা দেখা গেল গাছের শরীর থেকে জল বেরোনোর মূল পথ পত্ররন্ধ্রের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হল ক্রিস্পার-ক্যাসের সাহায্যে।

ঠিক এমনটা করাও হয়েছে ধানের বেশ কিছু ব্রিডের ক্ষেত্রে। কিংবা যেহেতু জলবায়ু এখন খামখেয়ালী, তাই শষ্য ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আগেই শষ্য যাতে কম সময়ে সম্পূর্ণ পরিপক্ক হতে পারে, তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে এই প্রযুক্তির সাহায্যে। ক্রিস্পার-ক্যাস পদ্ধতি কিন্তু জিএমও প্ল্যান্টের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ক্রিস্পারে-ক্যাসে জিএমও-র মত উদ্ভিদের শরীরে অন্য ভাইরাস, ব্যাক্টিরিয়া বা অন্য জীবের জিন প্রবেশ করানো হয় না; এক্ষেত্রে উদ্ভিদের জিনই প্রবেশ করানো হয়।

এখনই ক্রিসপার-ক্যাস হয়তো মানুষের হাতে মহামারীর বিরুদ্ধে সঞ্জীবনী তুলে দেয়নি। এখনই আমরা বলতে পারি না, নাহ খাদ্যসংকটের ভাবনা নেই। তবে হ্যাঁ, অজুত মানুষের মৃতের স্তুপ পেরিয়ে যখন আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাইছি আরও একবার, ক্রিসপার ক্যাস আমাদের জন্য অন্ধকারে আলোর ইশারা তো বটেই।

More Articles