রামপুরহাট থেকে ইউক্রেন, মানসিক আঘাত কতটা ছিন্নভিন্ন করে প্রত্যক্ষদর্শীদের

স্মৃতি বড় উদ্বায়ী, বাঙালি হলে তো কথাই নেই। আম বাঙালি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিভৎসতা ভুলে উৎসবের ভীড়ে গা ভাসায়। আম বাঙালি দিন কয়েক আগে ঘটা রামপুরহাট গণহত্যা ভুলে যায়। কিন্তু যারা কোভিডে প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের মনে শোকের স্মৃতি এখনও দগদগে, কিংবা যারা সামনে থেকে কোভিডের সাথে লড়েছেন তাঁরাও জানেন সেই লড়াইয়ের ক্ষত কতটা গভীর। যাঁরা চোখের সামনে থেকে রামপুরহাট দেখেছেন তাঁরা জানেন, এই জিঘাংসার দৃশ্য কতদিন তাঁদের বয়ে বেড়াতে হবে। কিংবা ধরুন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাসুল গুনছেন যে সাধারণ মানুষরা, গুলি-বোমার শব্দে রোজ ঘুম ভেঙেছে যাদের। বা ধ্বংসস্তুপ থেকে প্রিয়জনের প্রাণহীন দেহ  উদ্ধার হতে দেখেছেন, যাঁরা, সে রামপুরহাট হোক কিংবা ইউক্রেন, তাঁদের মানসিক ক্ষত কতটা?

যে বিষয় নিয়ে কেউ আলোচনা করছে না, কথা বলা যাক সেই বিষয় নিয়ে। তাছাড়া এপ্রিল হল স্ট্রেস অ্যাওয়ার্নেস মান্থ বা মানসিক চাপ সংক্রান্ত বিষয়ে সতর্কতার মাস। মানসিক চাপ ও তার প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্দ্যেশ্যেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৯২ সাল থেকে। সেই পরম্পরার সূত্রেই, চাপপাশের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই কথা বলা যাক সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো কী ভাবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, এবং ট্রমার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে একের পর এক ঘটা ভয়াবহ ঘটনাগুলি।

ট্রমা কী? কাদের মধ্যে ট্রমার স্বীকার হওয়ার প্রবণতা বেশি?

ট্রমা শুরু হওয়ার আগে মানুষ স্ট্রেসের স্বীকার হয়। নাহ্, কাজের চাপ বা দুঃশ্চিন্তা করা স্ট্রেসের সমার্থক শব্দ নয়, অন্তত নিউরোলজির ভাষায় তো নয়ই। শারিরীক, মানসিক, বা যৌন অত্যাচারও, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সমস্যা বা মহামারী, সবই স্ট্রেসের কারণ হতে পারে, আবার কাজের চাপ, বাড়িতে অশান্তি, নিত্যনৈমিত্তিক ভাবে খারাপ অভিজ্ঞতাও স্ট্রেসের কারণ হতে পারে।

সাইকোথেরাপিস্টদের মতে স্ট্রেসকে সহজ ভাষায় ব্যখ্যা করা যায় এই ভাবে - ধরা যাক, একটি সাঁকোর ওপর দিয়ে ছোটো-ছোটো গাড়ি যাচ্ছে, সাঁকোটার কিছু হচ্ছে না। কিন্তু একসময় বড় কোনো মালবাহী গাড়ি গেল সাঁকোটার উপর দিয়ে, সাঁকোটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো। এই ছোটো-ছোটো গাড়িগুলিকে ছোটোখাটো আঘাতের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু যে মুহুর্তে সাঁকোটি ভেঙে গেল, সেই মুহুর্ত থেকেই শুরু হল স্ট্রেসের।

স্ট্রেসের ফলে মানুষের মনে যখন বিরূপ প্রভাব পড়ে, তার যখন  মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হয় সেটাকেই আমরা ট্রমা বা মানসিক আঘাত হিসেবে ধরতে পারি।

কিন্তু সবাই কি স্ট্রেস বা ট্রমার স্বীকার হবে? নাহ, এমন কোনো কথা নেই। দুটি ভিন্ন মানুষ হয়তো একই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদের স্ট্রেসের প্রতি প্রতিক্রিয়া, তাঁদের উপর ট্রমার ফল ভিন্ন হতে পারে। এবং এই বিষয়গুলি পুরোপুরি নির্ভর করছে তাঁদের জিনের গঠন, তাঁদের বেড়ে ওঠা এবং জীবন-ধারণ, এমনকি অতীতে আদৌ তাঁদের সাথে কোনো বিরূপ ঘটনা ঘটেছে কিনা তার উপর। আবারও উদাহরণ দেওয়া যাক সাঁকোর - ধরা যাক সাঁকোর গঠন শক্তপোক্ত, ভারী গাড়ি এসেও তাকে ভাঙতে পারল না; কিংবা বারবার ভারী গাড়ির আঘাত পেতে সে একসময় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো। বা এমনও হতে পারে, সাঁকোর গঠন দুর্বল, ছোটোখাটো গাড়ি যেতেই সে ভেঙে পড়ল।

আরও পড়ুন-মেয়েদের শরীরে নিঃশব্দে হানা দিচ্ছে এই রোগ, উপসর্গ চিনে আজই সতর্ক হোন

ট্রমার শিকার হওয়া মানুষটি কি দুর্বল তাহলে?

মানুষটিকে এই ক্ষেত্রে দুর্বল বলে দেগে দেওয়া অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে। যা একটি মানুষের ক্ষেত্রে ট্রমার কারণ, সেই একই ঘটনার প্রতি আরেকটি মানুষ নির্বিকারও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুর্বল বলে দাগিয়ে না দিয়ে, তাঁদের সমস্যাগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত, তাঁদের অনুভূতিকে সম্মান দেওয়া উচিত।

ট্রমার ফলে সাধারণত কী ধরণের মানসিক পরিবর্তন আসতে পারে?

কলকাতার প্রখ্যাত সাইকোথেরাপিস্ট অভিরুচি চ্যাটার্জি বলছেন, "সাধারণত মানসিক অবসাদ, দুঃশ্চিন্তা, ভয়, রাগ ইত্যাদির মত মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বারেবারে মনে হতে পারে, কেন আমার সাথেই এমন হল? এর থেকে নিজের প্রতি ঘৃণা বা অবহেলার প্রবণতা বাড়তে পারে। নিজেকে এবং নিজের জীবন করে হঠাৎ করে মূল্যহীন মনে হয় যেন ভয়াবহ মুহুর্তগুলো পেরিয়ে আসার পরেও।"

উপসর্গগুলি ধরিয়ে দিচ্ছিলেন অভিরুচি। বলছিলেন, হয়তো সামান্য দরজার আওয়াজেও মনে হচ্ছে এই বুঝি বোমা পড়ল বা  সেই সামান্য আওয়াজেই যুদ্ধের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মনের মধ্যে ধীরে ধীরে ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করে, যার প্রভাব চলতে-ফিরতে জীবনের প্রতি পদে পড়ে। শান্ত ভাবে থাকতে থাকতে ভয়ে কেঁপে ওঠে মন, ঘুমের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে সেই সব স্মৃতি।

এমনকী খুব সুন্দর রোদ ঝলমলে দিনেও যেন মনে হয়, ঘন কালো মেঘ জমেছে মাথার উপর, সেই মেঘ ভেঙে বৃষ্টি যেন আমার উপরেই পড়ছে। যেন মনে হয়, এ ভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ, মৃত্যু বোধহয় এর থেকে ভালো। ট্রমা বা মানসিক আঘাত পেলে আত্মহত্যা বা নিজেকে শারীরিক ভাবে আঘাত করার প্রবণতা বাড়তে পারে।

এ সবের পিছনেই থাকে বিভিন্ন স্ট্রেস  হরমোনের ভূমিকা। যেগুলো অক্সিটোসিন, ডোপামাইন, সেরোটোনিন, অ্যাড্রিনালিন, নর-অ্যাড্রিনালিনের মত একাধিক নিউরোট্রান্সমিটারের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই হরমোনগুলি আবার আমাদের দুঃখ, আনন্দ, রাগ, ভয়ের মত সাধারণ অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে; আমাদের আচার-আচরণ, ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে।

শুধু মানসিক সমস্যাই নয়, শুরু হয় শারীরিক সমস্যাও। খাওয়ার ইচ্ছে, খাবার হজমের সমস্যা থেকে শুরু করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবই বিপর্যস্ত হয়। দেখা যায় হৃদরোগের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস।

মানসিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার রাস্তা কী?

কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে যখন ভয়াবহ দাবানলে বিস্তীর্ণ জঙ্গল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিলো, আমরা ভেবেছিলাম বুঝি সব শেষ। কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই সেই ছাইয়ের গাদা থেকে গোলাপী রঙের জংলি ফুল ওই ছারখার হওয়া বিস্তীর্ণ জমিকে রাঙিয়ে দিয়ে ফুটেছিল।

এই উদাহরণ আনার উদ্দ্যেশ্য - মানসিক আঘাত পাওয়া মানুষদের ভরসা জোগানো যে উঠে দাঁড়ানো যায়, ক্ষতগুলোকে সামলে নিয়ে। কিন্তু কী ভাবে? সাইকোথেরাপিস্টদের মতে, মনে রাখতে হবে যে এই বিধ্বংসী ঘটনার শিকার আপনি একা নন। যারা মানসিক আঘাতের সাথে লড়ছে তাঁদের সাথে একজোট হয়ে একে-অপরকে ভরসা যোগান, একে-অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। কিন্তু পাশাপাশি, এটাও আপনার নিজের মনকে বোঝাতে হবে আপনার সাথে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে, তবে তার দোষ আপনার নয়।

এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থার এগিয়ে আসা উচিত, মানসিক আঘাত পাওয়া মানুষগুলির মানসিক চিকিৎসার এবং কাউন্সেলিংয়ের জন্যে।

More Articles