ধেয়ে আসছে ভয়ানক সৌরঝড়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দৈনন্দিন জীবন?

বৃহস্পতিবারই পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সৌরঝড়। আজ থেকেই তার প্রভাব শুরু হতে পারে। ‘দ্য সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ইন স্পেস সায়েন্সেস ইন্ডিয়া’-র তরফ থেকে জানানো হয়েছে, সেই সৌরঝড় ধেয়ে আসছে ঘণ্টায় ২০,৬৯,৭৮৪ কিলোমিটার বেগে। এই সৌরঝড়ের প্রভাবে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে জনজীবন।

কিন্তু কেন ঘটে সৌরঝড়? কীভাবেই বা এতে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? কী বলছেন বিজ্ঞানীরা? দেখে নেওয়া যাক।

বেশ কিছুদিন ধরেই ঘন ঘন সৌরঝড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? প্রথমত, এই মুহূর্তে সূর্য তার এগারোতম সৌর চক্র সম্পূর্ণ করছে, আর সেই কারণেই তার বাইরের প্লাজ়মার মতো অংশ বা করোনায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যাকে বলে করোনাল মাস ইজেকশন। এই করোনাল মাস ইজেকশনের মধ্যে থাকে প্রোটন এবং ইলেকট্রন কণা। এই দুইটি কণা আয়নিত বা চার্জড অবস্থায় থাকে, ফলে এদের শক্তিও প্রচুর। বিপুল শক্তিসম্পন্ন, আয়নিত এই দুই কণাই সৌরঝড়ের সঙ্গে ধেয়ে আসছে নীল গ্রহের দিকে। এবং যার ফলে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে জনজীবন। ব্যহত হতে পারে স্বাভাবিক কাজকর্ম ও জীবনযাত্রা।

আরও পড়ুন: দৃষ্টি ফিরে পাবে অন্ধ! অসাধ্যসাধন থেকে একহাত দূরে দাড়িয়ে ওঁরা

এই ঝড় কীভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবন?

সৌরঝড়ের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পরিষেবা। তার পাশাপাশি সৌরঝড়ে ধাক্কা লাগে বৈদ্যুতিক গ্রিডগুলিতেও। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।

আয়নিত প্রোটন এবং ইলেক্ট্রন আছড়ে পড়ে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের ওপর। আর তার ফলেই ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় শুরু হয়। পৃথিবীর চৌম্বকত্ব দেখা যায়, পৃথিবীকে বেষ্টন করে চৌম্বক ক্ষেত্র আছে বলেই। ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় তখনই হয়, যখন এই চৌম্বক ক্ষেত্র সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয় আয়নিত এই দুই কণা, অর্থাৎ ইলেকট্রন ও প্রোটনের প্রভাবে।

ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ে  ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্টারনেট  এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিষেবা। কারণ ইন্টারনেট সরবরাহের জন্যে ব্যবহৃত টাওয়ার, স্যাটেলাইট ইত্যাদি থেকে তৈরি হয় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ। ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ের কারণে তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতেই বিপর্যস্ত হয় ইন্টারনেট।

ইন্টারনেট পরিষেবা এবং স্যাটেলাইটগুলি সৌরঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে জিপিএস সিস্টেম। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ। নিরাপত্তা রক্ষার কাজে যুক্ত এই পেশার মানুষগুলিকে সবসময় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়। আর তা করতে হয় চলমান, তারহীন ব্যবস্থার মাধ্যমে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ও আর্থিক লেনদেন। সার্ভার ঠিকমতো কাজ না করার সম্ভাবনাই বেশি, ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যহত হলে।

সৌরঝড়ে কেন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিদ্যুৎ সরবরাহ?

জিওম্যাগনেটিক স্টর্ম বা ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ের ফলে ইনডিউসড কারেন্ট তৈরি হয়, যা প্রবাহিত হতে শুরু করে বৈদ্যুতিক গ্রিডের মধ্যে দিয়ে। আর ভূ-চৌম্বকত্বের জন্য তৈরি কারেন্টের শক্তি একশো অ্যাম্পিয়ারকেও ছাড়িয়ে যায়। সহজ কথায় বললে, একশো অ্যাম্পিয়ার বেশ কিছু বাড়িতে সরবরাহ করা সামগ্রিক বিদ্যুৎ প্রবাহের সমান। আর এই কারেন্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে বৈদ্যুতিক গ্রিড,  ট্রান্সফরমার, রিলে এবং সেন্সরের মধ্য দিয়ে। এত বৈদ্যুতিক শক্তি, এত দ্রুত বেগে প্রবাহিত হলে বিপর্যস্ত হয় বিদ্যুৎ পরিষেবা।

আর কী কী হতে পারে সৌরঝড়ের প্রভাবে?

আগেও বেশ কয়েকবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রাতের আকাশজুড়ে সবুজ, বেগুনি বা গোলাপি রঙের আলো, অর্থাৎ নর্দার্ন লাইট দেখা গেছে সৌরঝড়ের কারণে। নর্দার্ন লাইট বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখা যায় উত্তর মেরুর দেশগুলিতে। যার মধ্যে পড়ছে আলাস্কা, কানাডা, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন দেশ।

 কেন তা দেখা যায়? কারণ সৌরঝড় না হলেও সূর্যের প্লাজমা থেকে সবসময়েই কিছু পরিমাণ ইলেকট্রন ধেয়ে আসে পৃথিবীর দিকে। এই ইলেকট্রন এসে ধাক্কা খায় পৃথিবীর  চৌম্বকক্ষেত্রে। পৃথিবীর অন্যান্য অংশে  ছুটে আসা এই ইলেকট্রনগুলিকে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ছিটকে সরিয়ে দিলেও, মেরু অঞ্চলে তা সম্ভব হয় না। কারণ দুই মেরুতেই ম্যাগনেটিক ফিল্ড দুর্বল। এই সুযোগে ছুটে আসা ইলেকট্রনগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে এই ধরনের আলো তৈরি করে আকাশের বুকে।

কিন্তু সৌরঝড়ে বিপর্যস্ত হয় পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, বেশ দুর্বলও হয়ে পড়ে তা পৃথিবীর সমস্ত পরিসরজুড়ে। তার আর ক্ষমতা থাকে না তখন, প্রবল শক্তিশালী আয়নিত এই ইলেকট্রন কণাগুলিকে ছিটকে সরিয়ে দেওয়ার। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে, যেখানে দেখা যাওয়ার কথা নয় নর্দার্ন লাইট, সেখানেও আকাশ রঙিন আলোয় ভরে ওঠে। এর কোনও ক্ষতিকর প্রভাব নেই যদিও।

হয়তো দেখা গেল, বৃহস্পতিবার সন্ধেতে কলকাতার আকাশজুড়ে আপনি নর্দার্ন লাইট দেখতে পেলেন! মন্দ কী?

More Articles