দৃষ্টি ফিরে পাবে অন্ধ! অসাধ্যসাধন থেকে একহাত দূরে দাড়িয়ে ওঁরা

এজ- রিলেটেড ম্যাক্যুলার ডিজেনারেশন বা এ.এম.ডি. ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের  দৃষ্টিহীনতার একটি অন্যতম কারণ। এটি ঘটে যখন চোখের রেটিনার ম্যাক্যুলার নামের স্তরের কোশগুলি বয়সের সাথে নষ্ট হতে শুরু করে। আর যেহেতু রেটিনার মূল কাজই হল আলোর উপস্থিতি অনুভব করা, এর এই ম্যাক্যুলার অংশটি নষ্ট হতে শুরু করলে মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করে।

এ.এম.ডি. আবার দুই ধরনের  - ড্রাই এবং ওয়েট। প্রথমটির ক্ষেত্রে, চোখে দেখা দৃশ্যগুলির মাঝের অংশটিতে একটি ব্লাইন্ড স্পট তৈরি হয়। সহজ ভাবে বোঝানো যাক - ধরুন আপনি টিভি দেখছেন, কিন্তু টিভিতে ফুটে ওঠা দৃশ্যগুলির মাঝখানটা ধূসর বা ঝাপসা। ড্রাই এ.এম.ডি.-তে ভোগা রোগীদের দৃষ্টিতে ঠিক এই ভাবেই সব কিছু ধরা পড়ে। আর ড্রাই এ.এম.ডির চিকিৎসার জন্যে সেল থেরাপির পথ দেখাল আইস্টেম নামে ব্যাঙ্গালোরের একটি সংস্থা। গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে সুস্থ রেটিনাল এপিথেলিয়াল কোশ । নষ্ট হওয়া ম্যাক্যুলার অংশে সেই কোশ প্রবেশ করিয়ে, অন্ধজনে আলো দেওয়ার কয়েক পা দূরেই দাঁড়িয়ে আইস্টেম।

আমরা কথা বলেছিলাম আইস্টেমের প্রতিষ্ঠাতা ড: যোগীন দেশাই ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড: রাজর্ষি পালের সঙ্গে, তাঁদের অসাধ্যসাধনের গল্প শুনতে। রইল সেই কথোপকথন।

 কী ভাবে শুরু হল আইস্টেমের যাত্রা, একটু যদি বলেন ...

ড: যোগীন দেশাই: আইস্টেমের আইডিয়া মাথায় আসে ২০১৫ সালে। তখন প্রফেসর এস. রামস্বামীর সাথে দেখা হয়েছে, উনি ব্যাঙ্গালোরের ইনস্টিটিউট ফর স্টেম সেল অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন বা ইনস্টেমের তৎকালীন ডিন। আমাদের উদ্দ্যেশ্য শুরুর থেকেই খুব স্পষ্ট ছিলো - সেল থেরাপির ক্ষেত্রে বিপ্লব আনবো, যার প্রভাব সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে আগামী পনেরো-কুড়ি বছরেই। ভেবে দেখলাম সেল থেরাপি কেবল বানিজ্যের জন্যেই নয়, দেশের মঙ্গলের জন্যেও ব্যবহার করতে পারি।

এই সব ভেবেই আমরা বেশ কিছু গবেষণা করি সেল থেরাপি নিয়েই।  উদ্দ্যেশ্য ছিল, আমাদের গবেষণার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়, তা পরীক্ষা করে দেখা। এবং তা সফল হলে ২০১৭ সালে আইস্টেমের যাত্রা শুরু হয়।

এজ রিলেটেড ম্যাক্যুলার ডিজেনারেশন বা এ.এম.ডি. … এর  ফলে তো অন্ধ হয়ে যায় মানুষ। আপনারা এই অসুখের ফলে হওয়া অন্ধত্ব সারাতে কী পরিকল্পনা করছেন? 

ড: রাজর্ষি পাল: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে, একটি বিষয় উল্লেখ করি। এ.এম.ডি. দুই ধরনের - এক, ওয়েট এএমডি; আরেকটি ড্রাই এএমডি। দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ ড্রাই এএমডির ক্ষেত্রে রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়ামের কোশগুলি নষ্ট হয়ে যায়। আর ঠিক এই কারণেই অন্ধ হয়ে যায় মানুষ। এর কিন্তু বর্তমানে কোনো সুরাহা নেই।

আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যারা ইতিমধ্যেই এই অসুখের কারণে যাঁরা আংশিক অন্ধত্বে ভুগছেন, তাঁদের চোখে আমাদের ল্যাবে বানানো রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াল সেলকে প্রবেশ করানো হল। আমরা দেখলাম চোখে যে এপিথেলিয়াল কোশগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, নতুন কোশগুলো এসে তাদের নষ্ট হওয়া আটকালো। এর ফলে দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে এলো।

এভাবে কি ল্যাবে বানানো আর.পি.ই. সেল পুরোনো কোশের নষ্ট হওয়া আটকাচ্ছে? না-কি সুস্থ, নতুন আর.পি.ই কোশ তৈরি করে চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনছে?

ড: পাল: খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন! দেখুন দুই ভাবে পদ্ধতিটা হতে পারে - এক তো নতুন এপিথেলিয়াল সেলগুলো এসে, পুরোনো কোশের নষ্ট হওয়া থামাতে পারে। কিংবা, নতুন করে প্রবেশ করানো কোশগুলো, নতুন কোশের জন্ম দিতে পারে। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে রিজেনারেশন অফ সেল। কিন্তু, সেল রিজেনারেশন (অর্থাৎ নতুন কোশ তৈরি হওয়া) হচ্ছে কি-না, তার সপক্ষে প্রমাণ আমাদের কাছে নেই এখনও অবধি। কিন্তু এইটুকু দেখা গেছে, আমাদের ল্যাবে বানানো রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম কোশগুলি অন্তত চোখের পুরোনো  রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম কোশের নষ্ট হওয়া আটকাচ্ছে। 

ল্যাবে বানানো কিছু সুস্থ কোশ এসে, কী ভাবে পুরোনো কোশের নষ্ট হওয়া আটকে দিতে পারে?!

ড: পাল: বিষয়টা এরকম হচ্ছে, আমাদের ল্যাবে বানানো আর.পি.ই. সেলগুলো চোখে প্রবেশ করানোর পরে, চোখের মধ্যে নষ্ট হতে থাকা পুরোনো আর. পি.ই. কোশের গায়ে আটকে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে এনগ্রাফ্ট হওয়া। এর মাধ্যমে নতুন কোশগুলি পুরোনো কোশেরই অবিচ্ছেদ্দ অংশ হয়ে ওঠে। আর তারপরেই নতুন কোশগুলি প্রোটিন আর কোশের বেড়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক তৈরি করা শুরু করে। এই পদার্থগুলি নষ্ট হওয়া কোশগুলিকে সারিয়ে তোলে,  ফলে তারা আবার আগের মত কাজ করতে আরম্ভ করে।

এই থেরাপি কিন্তু তাদের জন্যে কাজ করবে না, যারা পুরোপুরি অন্ধ অর্থাৎ যাদের আর.পি.ই. সেল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।  ধরুন কেউ পঞ্চাশ শতাংশ , বা সত্তর শতাংশ অন্ধ, তাদের ক্ষেত্রেই কাজ করবে  সেল থেরাপি। কারণ তাদের চোখে কিছু আর.পি.ই. সেল তখনও রয়েছে, হতে পারে তারা নষ্ট হওয়ার পথে।

আপনাদের ল্যাবে তৈরি করা কোশগুলি আদৌ কাজ করছে কিনা তা প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করলেন কী ভাবে?

ড: পাল:  ল্যাবে তৈরি আর.পি.ই. কোশ, আর চোখে যে আর.পি.ই. কোশ সাধারণত থাকে, চারিত্রিক দিক থেকে তারা আদৌ একই কি-না, বা আদৌ আমরা ল্যাবে  যে কোশ তৈরি করেছি, তা আদতে আর.পি.ই. কোশ কিনা, সেটা জানা প্রাথমিক ভাবে দরকার ছিল।

তারপর আমরা দ্বিতীয় ধাপে এগোলাম। এই কোশগুলিকে ল্যাবের ইঁদুরের চোখে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এই ইঁদুরদের মধ্যে বেশ কতগুলি ইতিমধ্যেই এ.এম.ডি-জনিত অন্ধত্বে ভুগছিল। 

চোখে আর.পি.ই সেল প্রবেশ করানোর পর কী করে বুঝলেন ইঁদুরগুলি ওদের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে?

ড: পাল: কিছু পরীক্ষা আছে, যেগুলি আমাদের চোখের রেটিনার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে - যেমন ইলেক্ট্রোরেটিনোগ্রাফি। এর সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়, চোখে আলো পড়লে, তার প্রতিক্রিয়ায় চোখ সাড়া দিচ্ছে কিনা। আমরা ইঁদুরের ইলেক্ট্রোরেটিনোগ্রাফি করে দেখলাম, চোখে আলো ফেললে তারা  সাড়া দিচ্ছে! অন্যদিকে, যাদের চোখে আর.পি.ই সেল প্রবেশ করানো হয়নি, অথচ যারা অন্ধ ছিল, তারা কিন্তু আলো দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আমরা তখনই সাক্ষাৎ প্রমাণ পেলাম, যে আমাদের তৈরি করা কোশগুলো যে সত্যি-ই কাজ করছে।

আগেই বললাম রেটিনার মধ্যেকার আর.পি.ই. কোশগুলোর যে স্তর নষ্ট হয়ে যায় ম্যাকিউলার ডিজেনারেশন হলে। ল্যাবে বানানো আর.পি.ই. কোশ প্রবেশ করানোর পর, আদৌ সেই স্তর আবার আগের মত হল কিনা তা বোঝার জন্যে আরেকটি পরীক্ষা করেছিলাম আমরা - অপ্টোকাইনেটিক থ্রেশহোল্ড এর নাম। আমরা দেখলাম সেল থেরাপির পরে, আংশিকভাবে দৃষ্টি হারানো ইঁদুরগুলোর রেটিনার আর.পি.ই. কোশের স্তর অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে । অন্যদিকে যে সমস্ত আংশিকভাবে দৃষ্টি হারানো ইঁদুরগুলোর সেল থেরাপি হয়নি, তাদের আর.পি.ই. লেয়ারের কোনো উন্নতি চোখে পড়েনি ।

এই পুরো কাজটা কি আইস্টেম একক ভাবে করল?

ড: পাল: নাহ, এর জন্যে আমরা ওরেগন হেলথ এন্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি সাথে কাজ করেছি। এবং প্রাথমিক গবেষণার শেষে আমরা দেখলাম  ল্যাবে তৈরি কোশগুলোকে ওই অন্ধ ইঁদুরদের চোখে প্রবেশ করানোর পরে আমরা দেখলাম রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম কোশের নষ্ট হওয়ার হার অনেক কমে এসেছে যেটা আদতে এই ইঁদুরদের চোখের দৃষ্টি ফেরাতে সাহায্য করবে।  

ঠিক কতদূর আপনাদের গবেষণার কাজ? সাধারণ মানুষের হাতে কবে আসতে পারে?

ড: পাল: এই মুহুর্তে আমাদের প্রি-ক্লিনিক্যাল ফেজ় চলছে। এবং এই পর্যায়টি হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার আগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়। প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টেজেই আমরা পরীক্ষা করে দেখে নিই আমাদের তৈরি কোশগুলো ইঁদুরের শরীরে আদৌ কাজ করেছে কিনা এবং কোশগুলির ব্যবহার কতটা নিরাপদ।

এই ধাপের রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরেই আমরা মানুষের শরীরে এই কোশগুলির প্রয়োগ শুরু করতে পারবো। আশা করা যায় এই প্রিক্লিনিক্যাল স্টেজ আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে।

তাহলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কবে শুরু হচ্ছে?

ড: পাল: আশা করছি ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনেরাল অফ ইন্ডিয়ার অনুমোদন পেলে এই বছরের শেষেই আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য রোগী নিয়োগ করতে পারবো।

চোখে সেলগুলো প্রবেশ করানো কী ভাবে হবে?

ড: পাল: দেখুন, তা করতে হবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এবং এই অস্ত্রোপচারটি কিন্তু খুব জটিল।

কোশগুলো প্রবেশ করাতে হবে রেটিনায় আর রেটিনা থাকে চোখের পেছন দিকে, কর্নিয়ার মত চোখের সামনে না। তাই ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে যখন কোশগুলি প্রবেশ করানো হবে, সেটা করতে হবে চোখের পেছন দিক দিয়ে। এই অস্ত্রোপচারকে বলে সাব- রেটিনাল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা সাব - রেটিনাল ইঞ্জেকশন। খুব দক্ষ সার্জেন ছাড়া এই অস্ত্রোপচার সম্ভব না।

কিন্তু জিন থেরাপি প্রোডাক্ট দিয়ে অস্ত্রোপচারের জটিলতা এড়ানো যেতে পারে।  ঠিক এরকম একটি প্রোডাক্ট আমরা ব্যবহার করব ভাবছি, এর নাম লাক্সটার্না।

সাধারণ মানুষ এই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারবে?

ড: দেশাই: আমরা নিশ্চিত করছি আমাদের ল্যাবে কোশ উৎপাদনের মাসিক খরচ যাতে অত্যন্ত কম হয়। তাহলে এই কোশগুলির খরচও মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকবে।

এ তো হল ল্যাবে কোশ উৎপাদনের খরচ। কিন্তু অস্ত্রোপচারের খরচ কেমন হবে?

ড: পাল: লাক্সটার্নার খরচ চার লক্ষ মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের পক্ষেও এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু আইস্টেমের লক্ষ্যই হচ্ছে, চিকিৎসার খরচ কমানো যাতে বিভিন্ন স্তরের মানুষ সেল থেরাপির করাতে পারে। আমি এই মুহুর্তে খরচ কত সেটা বলতে পারব না, তবে আমরা খেয়াল রাখছি খরচ যাতে অন্তত দশগুণ কমানো যায়।

আপনারা কি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং হার্ডওয়্যার অটোমেশন ব্যবহার করেছেন এই গবেষণায়?

ড: পাল: চমৎকার প্রশ্ন! আমরা করিনি এখনও এর ব্যবহার, কারণ সেই অনুদান এখনও আমাদের কাছে নেই। তবে খুব শিগগির আমরা সেল থেরাপিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং হার্ডওয়্যার অটোমেশন ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছি।

তাহলে আমরা কি আশা করতে পারি ভারতে সাধারণ ভাবে সেল থেরাপি সম্ভব হতে চলেছে ভবিষ্যতে? 

ড: দেশাই: আলবাত! ভারতে সেল থেরাপি অবশ্যই সম্ভব। খুব তাড়াতাড়ি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং হার্ডওয়্যার অটোমেশনের মাধ্যমে ভারতে সাধারণ মানুষের জন্যে সেল থেরাপি খুব কম খরচেই সম্ভব হবে।

 

More Articles