Henipavirus: অন্য প্রাণীর থেকে শরীরে ঢুকছে মারণ-ভাইরাস, কাজ করছে না কিডনি-লিভার! কী বলছেন বিজ্ঞানীরা

আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ভাইরাস অন্যান্য প্রাণীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কিডনি এবং লিভার কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।

সম্প্রতি তাইওয়ানের সেন্টারস ফর ডিজি়জ় কন্ট্রোল বা সিডিসি-র পক্ষ থেকে জানা যাচ্ছে চিনের শ্যানডং এবং হেইনানে পঁয়ত্রিশ জনের বেশি ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন নোভেল ল্যাংইয়া হেনিপাভাইরাসে। সংক্রমিতদের মধ্যে বেশিরভাগই কৃষক এবং সাধারণ জনগণ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ভাইরাস অন্যান্য প্রাণীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কিডনি এবং লিভার কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।

বিজ্ঞানীদের মতে নোভেল ল্যাংইয়া হেনিপাভাইরাস ছুঁচোর মতো দেখতে প্রাণী 'শ্র্যু'থেকে ছড়ায়। এবং এই প্রাণীদের বিভিন্ন রকম বাসস্থানে দেখা মেলে।

উক্ত ভাইরাসটির কারণে কোনও সংক্রমিত ব্যক্তির এযাবৎ মৃত্যু ঘটেনি, কিন্তু বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, প্রাণীদের থেকে প্রায়শই বিভিন্ন মারণ-ভাইরাস ছড়াচ্ছে, যার অন্যতম উদাহরণ নোভেল করোনাভাইরাস নিজেই।

আরও পড়ুন: শিশুদের বড় বিপদের সংকেত দিচ্ছে মাঙ্কিপক্স, আবার নতুন ভাইরাস-আতঙ্ক ভারতে?

বিজ্ঞানীদের মতে হয়তো নোভেল ল্যাংইয়া হেনিপাভাইরাস থেকে পরবর্তী একটি মহামারীর সূচনা হবে না, কিন্তু আমাদের প্রাণীদের শরীর থেকে কীভাবে অজান্তেই একাধিক ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে, সে-বিষয়ে নড়েচড়ে বসার সময় কিন্তু এসে গেছে।

সিএনএন বা কেবল নিউজ় নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা যাচ্ছে, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এবং ইউনিভার্সিটি অফ হংকং স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর অধ্যাপক লিও পুন জানিয়েছেন, "আমরা ভীষণভাবে পশু-বাহিত রোগগুলিকে অবহেলা করছি। এবং বর্তমানে পশুবাহিত রোগগুলি হিমবাহের চূড়ামাত্র।"

তবে নোভেল ল্যাংইয়া হেনিপাভাইরাস যে ২০২১ সালেই ছড়িয়েছে, তা নয়। এর সংক্রমণ শুরু হয়েছে ২০১৮ সাল থেকেই। তবে গত সপ্তাহে এই ভাইরাস সম্পর্কে 'নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন'-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা সাড়া ফেলেছে বিশ্বজুড়ে।

গবেষকদের মতে, এই ভাইরাস একজন সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে সংক্রমিত হয় কি না, তার কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি। এখনও অবধি আক্রান্ত পঁয়ত্রিশ জন ব্যক্তির ক্ষেত্রে 'কনট‍্যাক্ট ট্রেসিং' করে তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের দেহে এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই মানুষের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিক্ষিপ্ত হলেও হতে পারে। তবে বিশদ গবেষণা প্রয়োজন সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, এই ভাইরাস এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির শরীরে  ছড়ায় কি না।

নোভেল ল্যাংইয়া হেনিপাভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরে কী কী লক্ষণ দেখা যেতে পারে?
এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে জ্বর, ক্লান্তি , কাশি, ক্ষুধামান্দ্য, পেশিতে ব্যথা, বমি বমি ভাব, মাথা যন্ত্রণা, বমি হওয়ার মতো ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ঘটনাও চোখে পড়েছে। বেশ কিছু সংখ্যক রোগীদের ক্ষেত্রে কমে গিয়েছে প্লেটলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা। লিভার এবং কিডনি-র কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে বহু রোগীর ক্ষেত্রে। আর সেখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

'তাইপেই টাইমস'-এর তরফে জানা যাচ্ছে, গৃহপালিত প্রাণীদের ওপর একটি সেরোলজিক্যাল সার্ভেতে জানা যাচ্ছে, পরীক্ষা করা হয়েছে এমন ছাগলদের মধ্যে দুই শতাংশ এবং কুকুরদের মধ্যে পাঁচ শতাংশই নোভেল ল্যাংইয়া হেনিপাভাইরাসে আক্রান্ত। পাশাপাশি পঁচিশটি প্রাণী প্রজাতির ওপর করা এই সার্ভেতে জানা যাচ্ছে, 'শ্র্যু' সম্ভবত এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক। সাতাশ শতাংশ 'শ্র্যু'-র দেহে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে।কীভাবে কমানো যেতে পারে সংক্রমণের আশঙ্কা?

বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে সত্তর শতাংশ সংক্রামক ব্যধি প্রাণীদের থেকেই ছড়াচ্ছে। নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের  কারণে মানুষ ক্রমশই অরণ্য ধ্বংস করছে, এবং প্রাণীরা নিজেদের স্বাভাবিক বাসস্থান হারিয়ে ফেলছে। মানুষ বন্যপ্রাণীদের সংস্পর্শে আসছে। যার ফলস্বরূপ বন্যপ্রাণীদের শরীরে এতদিন যে সমস্ত ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়া রোগের সৃষ্টি করত, সেই জীবাণুগুলোই দ্রুত জিনের গঠন বদলে বন্য পশুর পাশাপাশি মানুষকেও সংক্রমিত করার জন্য উপযুক্ত করে তুলছে নিজেদের।

গত দুই দশকে প্রাণীবাহিত রোগের ঘটনা সবথেকে বেশি দেখা গিয়েছে চিনে। এই ধরনের রোগের মধ্যে অন্যতম ২০০২ সালের মধ্যে মাথাচাড়া দেওয়া SARS এবং ২০১৯ সালের শেষ থেকে নোভেল করোনাভাইরাস বা SARS-CoV-2।

যে-সমস্ত বিজ্ঞানী এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না, তাঁদের মতে আরও বিশদে গবেষণা প্রয়োজন নোভেল ল্যাংইয়া হেনিপাভাইরাসের ওপর। তবে প্রাণীদের শরীরে আক্রমণ করত এতদিন যে সমস্ত ভাইরাস, তারা যে ক্রমাগত মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা অর্জন করছে, সেই দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সাম্প্রতিক এই গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, এই মুহূর্তে বোঝা প্রয়োজন, নতুন এই ভাইরাস কতটা ছড়াতে পারে এবং আর কী কী ভাবে ছড়াতে পারে। পাশাপাশি জানা প্রয়োজন, এই ভাইরাস মানুষের আর কতটা ক্ষতিসাধন করতে পারে এবং  সেই শারীরিক ক্ষতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে গেলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

ইউনিভার্সিটি অফ হংকংয়ের ভাইরোলজিস্ট ম্যালিক পেইরিস-এর মতে ('সিএনএন' সূত্রে জানা যাচ্ছে)  ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর যে অংশে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে, সেই চিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিনের বিস্তার ব‍্যাপক, যা বলে দেয়, এই ভাইরাস আদতে অনেক বেশি অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে।তিনি আরও জানাচ্ছেন, চিনের পাশাপাশি চিনের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও এই ভাইরাসের ওপর গবেষণা প্রয়োজন, যাতে বোঝা যায়, আমাদের অজান্তেই চিনের বাইরেও এই ভাইরাস ইতিমধ্যেই ছড়াতে শুরু করেছে কি না।

তবে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এখানেই আমাদের গবেষণা সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়; যাতে পরবর্তী মহামারীর সম্ভাবনাকে আমরা এড়িয়ে না যাই, সেই জন্য প্রাণীবাহিত অন্যান্য ভাইরাসও সমান্তরাল ভাবে ছড়াচ্ছে কি না, সেইদিকেও নজর রাখার সময় এসে গেছে, জানাচ্ছেন ড. পেইরিস।

More Articles