নামে ঢ‍্যাঁড়স, পুষ্টিগুণে সবজির রাজা! উপকারিতা জানলে পাতে তুলবেনই

Bhendi Health Benefits: ঢ‍্যাঁড়সেও এত গুণ? জেনে নিন একনজরে।

ঢ্যাঁড়স নামটা শুনলেই আপামর বাঙালির মুখটা কেমন যেন একটু বেঁকে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখে আরেকটি শব্দ ফুটে ওঠে, ইশ! হ্যাঁ এইরকম প্রতিক্রিয়াই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। ঢ্যাঁড়স বা ভেন্ডিকে সকলেই কমবেশি একটু অবহেলার চোখে দেখে। কেউ কিছু না পারলেই তাকে ঢ্যাঁড়স বলে দেগে দেওয়া হয়। এই ঢ্যাঁড়সের পুষ্টিগুণ কিন্তু অনেক। শীত কাটতে না কাটতেই বাজার ছয়লাপ হয়ে যায় এই সবজিতে। আর পুষ্টিগুণে ভরপুর হলেও কী হবে, ঢ্যাঁড়স রান্না করলে বাড়ির খুদে সদস্যরাও তা মুখে তুলতে নারাজ, কারণ ঢ্যাঁড়সের পিচ্ছিলতা। একবার এই পিচ্ছিল ঢ্যাঁড়স হাতে লাগলে হাত থেকে তা নামানো যে কী পরিশ্রম, তা মানুষমাত্রই জানেন। কিন্তু কীভাবে এল এই ঢ্যাঁড়স?

ঢ্যাঁড়সের ইতিহাস ও নামকরণ
একটি সবজি, কিন্তু নাম তার ভিন্ন। হিন্দিতে বলে ভিন্ডি, তেলেগুতে বেন্দাকায়া, গুজরাতিতে ভিন্দা। নারীর সুডৌল অঙ্গের মতো আকৃতি হওয়ায় ইংরেজ রসিকরা এর নাম দেন লেডিজ ফিঙ্গার। ভারতে এই সবজি ভেন্ডি বা ভিন্ডি নামে পরিচিত হলেও সারা বিশ্ব একে চেনে ওকরা নামে। এই ওকরা শব্দটি এসেছে ইগবো শব্দ ওকুরু থেকে। নাইজেরিয়াতে এই ইগবো ভাষা ব্যবহার করা হয়। যদিও নামের ব্যুৎপত্তি পশ্চিম আফ্রিকায়। আফ্রিকার বান্টু ভাষায় একে 'কিঙ্গুম্বো' বলে। আরবি ভাষায় এর নাম 'বামিয়া'। আবার কোনও কোনও স্থান, যেমন আমেরিকার কিছু অংশ এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এটি গাম্বো নামেও খ্যাত।

আরও পড়ুন: জলের দরে মেলে আজও, ভুট্টার গুণ জানলে শেষ বর্ষায় পাতে তুলতে বাধ্য হবেন

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ঢ্যাঁড়স এল কীভাবে? এই নিয়েও আছে নানা মতামত। ১৯২৬ সালে রাশিয়ান বোটানিস্ট নিকোলাই ভ্যাভিলভ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তাতে তিনি বিভিন্ন উদ্ভিদের উৎপত্তি-কেন্দ্রের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেছেন। মনে করা হয়, ঢ্যাঁড়সের এই উৎপত্তি-কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি হল আবিসিনিয়া। এর মধ্যে রয়েছে ইরিত্রিয়ার মালভূমি অঞ্চল, যা বর্তমানে ইথিওপিয়া এবং সুদানের উচ্চতর অঞ্চল। কিন্তু কীভাবে এই সবজি সুদূর ইরিত্রিয়া থেকে ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, তা এক ধাঁধাঁর মতো।

বলা হয়, মিশরীয় ও মূর জাতির বিভিন্ন রচনায় ১২০০ ও ১৩০০ শতকে আরবি ভাষায় এই ঢ্যাঁড়সের উল্লেখ আছে। তাতে ধারণা করা হয় যে, প্রাচ্য থেকেই এটি এখানে এসেছে। সম্ভবত ইথিওপিয়া থেকে লোহিত সাগর বা আরবের নিকটবর্তী বাব-আল-মান্দিব প্রণালী পেরিয়ে এটি আরব ও পরে ইউরোপে যায়। ১৬৫৮ সালে ব্রাজিলে এর উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার ১৬৮৬ সাল নাগাদ এটি সুরিনামে পৌঁছে যায়। উত্তর আমেরিকাতে বিশেষভাবে দক্ষিণ-পূর্বে ঢ্যাঁড়সের আগমন ঘটে সপ্তদশ শতকের শুরুতে। ১৭৪৮ সালে এটি উত্তরে ফিলাডেলফিয়া এলাকাতে চাষ করা শুরু হয়। কিন্তু ওকরা কীভাবে ইরিত্রিয়া থেকে মিশরে পৌঁছল, তা নিশ্চিত করা কঠিন।

আবার এক তত্ত্ব অনুসারে, ২০০০ খ্রিস্টাব্দে কিছু বান্টু উপজাতিভুক্ত মানুষ, যারা মিশর থেকে ভারতে এসেছিল, তারাই ওকরাকে ভারতে এনেছিল। কিন্তু সেই সময়ের হরপ্পা সভ্যতায় এই ঢ্যাঁড়সের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে ১১২৬ থেকে ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পশ্চিম চালুক্য রাজবংশের সম্রাট তৃতীয় ভূলোকমালা সোমেশ্বর-এর কথায় ঢ্যাঁড়সের উল্লেখ পাওয়া যায়। সোমেশ্বর ছিলেন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ও রাজা, তার প্রজারা তাঁকে ‘সর্বদান্য ভূপ’ উপাধি দিয়েছিলেন, এর অর্থ– ‘যে রাজা সব জানেন’। সোমেশ্বর তাঁর গ্রন্থ ‘মনসোল্লাসা'-য় সেই সময়ে ঢ্যাঁড়স কীভাবে বানানো হতো তার একটি রেসিপি দিয়েছেন। তাঁর রেসিপি হলো–

ভেন্ডি টুকরো টুকরো করে কাটুন।

তারপর তাঁকে গরম তেলে ভাজুন।

আর শেষে তার ওপর কিছুটা দই ছড়িয়ে দিন।

১৫ শতাব্দী আগে আয়ুর্বেদের বিখ্যাত পণ্ডিত চরক ‘ভান্তি’ বা ‘ভান্ডি’ নামের একটি সবজির কথা উল্লেখ করেন। তিনি ভান্তি সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে বান্টু উপজাতির নিয়ে আসা ওকরার মিল অনেক।

পুষ্টিগুণ
ঢ্যাঁড়সের ইতিহাস আর নামকরণ নিয়ে তো অনেক কথা হলো, এবার ফেরা যাক ঢ্যাঁড়সের পুষ্টিগুণে। অবহেলার পাত্র হলেও পুষ্টি-বিশেষজ্ঞদের মতে ঢ্যাঁড়সের খাদ্যগুণ অনেক। দেখতে গেলে তা গুণের আকর। এতে রয়েছে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ও ভিটামিন এবিসি। এতে আছে ক্যারোটিন, ফলিক অ্যাসিড, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন এবং অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড। ঢ্যাঁড়সের রাইবোফ্লাভিনের পরিমাণ বেগুন বা শিমের থেকেও বেশি। ঢ‍্যাঁড়সে প্রতি ১০০ গ্রামে আমিষ (১.৮ গ্রাম), ভিটামিন-সি (১৮ মিলিগ্রাম), খনিজ পদার্থ বিশেষ করে ক্যালসিয়াম (৯০ মিলিগ্রাম), আয়রন (১ মিলিগ্রাম) ও আয়োডিন রয়েছে।

প্রতি ১০০ গ্রাম ঢ্যাঁড়সে পাবেন শক্তি ৩৩ কিলোক্যালরি, কার্বোহাইড্রেটস ৭.০৩ গ্রাম, প্রোটিন ২ গ্রাম, ফ্যাট ০.১ গ্রাম, ফাইবার ৩.২ গ্রাম, ফোলেট ৮৮ মাইক্রোগ্রাম, নিয়াসিন ১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ২১.১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ৩৭৫ IU, ভিটামিন ই ০.৩৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে ৫৩ মাইক্রোগ্রাম, সোডিয়াম ৮ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম ৩০৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮১ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৫৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৬৩ মিলিগ্রাম, জিংক ০.৬০ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন-বি ২২৫ মাইক্রোগ্রাম, লুটেইন ৫১৬ মাইক্রোগ্রাম। এতসব উপকারী উপাদান-সমৃদ্ধ সুলভ এই সবজি নিয়মিত শোভা পেতে পারে আপনার খাবারের এককোণে।

উপকারিতা
ঢ্যাঁড়সের উপকারিতা কিন্তু বলে শেষ করা যায় না। পেটের কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় ঢ্যাঁড়স। এর ভেতরে থাকা ফাইবার হজমে সাহায্য করে। এবং বিটা-ক্যারোটিন ও ভিটামিন এ থাকার ফলে ঢ্যাঁড়স চোখের জন্য উপকারী।

নিয়মিত ঢ্যাঁড়স খেলে শরীরে জরুরি ইমিউনিটি সিস্টেম তৈরি হয় যা ভাইরাস জনিত সংক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে। এতে থাকা ভিটামিন সি ডেড স্কিন সেল সারাতে সাহায্য করে। আর গরমকালে ত্বক সুস্থ রাখতে ঢ্যাঁড়সের জুড়ি নেই। ঢ্যাঁড়স ওজন নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।

ডায়াবেটিসের জন্যও ঢ্যাঁড়স উপকারী। এখন ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস রোগী, আর সেই কারণে ঢ্যাঁড়স এখন একটি জরুরি মেনুতে পরিণত হয়েছে। সুস্বাদু এই ঢ্যাঁড়স চুলের জন্যও উপকারী। ঢ্যাঁড়সে এমন কিছু উপাদান আছে, যা চুলের কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে।

এত বিস্ময়কর ব্যবহার সত্ত্বেও ভারতে একটি অবহেলিত নামমাত্র সবজি হিসেবেই ঢ্যাঁড়স ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পৃথিবীর অনেক দেশ সবজির পাশাপাশি এটি ফল হিসেবে গ্রহণ করে। ভারতে গুড় তৈরিতে আখের রসের সঙ্গে ঢ্যাঁড়সের শেকড় ও কাণ্ডের ব্যবহার করা হয়। তুরস্কে কফির বীজের বিকল্প হিসেবে ওকরার বীজ ব্যবহার করা হয়। আর দেরি না করে তবে এবার বাজার থেকে ভালো দেখে ঢ্যাঁড়স কিনে আনুন আর নিজেকে সুস্থ রাখুন।

More Articles