হুহু করে ছড়াচ্ছে সংক্রমণ, তৃতীয় ঢেউয়ে ঝুঁকি ঠিক কতটা, জানুন বিশেষজ্ঞর মত

দেশ তথা রাজ্যজুড়ে যে হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে তাতে শঙ্কিত চিকিৎসকমহল। গত কয়েকদিনে যে গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে সংক্রমিতের সংখ্যা তাতে চলতি মাসেই দৈনিক সংক্রমণ ৩০ হাজার অতিক্রম করবে বলেই দাবি করেছেন চিকিৎসকদের একাংশ। বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে করোনার এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রামক হলেও তা ডেল্টা স্ট্রেইনের মত বিপজ্জনক নয়। অতিমারির প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি আমরা, এমনই দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে একথাও ঠিক, করোনার নতুন এই স্ট্রেইনের বয়স মাত্র তিন সপ্তাহ তাই নিশ্চিত করে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।

৪ জানুয়ারি রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের বুলেটিন অনুযায়ী, শেষ ২৪ ঘন্টায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন  ৯০৭৩ জন।একলাফে আগের দিনের তুলনায় ৩০০০ বেড়েছে সংক্রমণ।  এ মুহূর্তে রাজ্যে অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা ২৫,৪৭৫। গত ২৪ ঘন্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। এদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৩,৭৬৮ জন। ওই দিন রাজ্যের করোনা পজিটিভিটি রেট ছিল ১৮.৯৬ শতাংশ। ৪৭,৮৬৪ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে এই দিন। রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে ও নার্সিং হোমে বহু ডাক্তার নার্সেরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন।স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে বেলাগাম সংক্রমণের জেরে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর প্রভাব নিয়ে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে অন্তত ৭০ জন, কলকাতা মেডিকেল কলেজের ১২। জন, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ৪৫ জন, আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজের ৩২ জন, ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজির ১৫ জন ,কামারহাটি সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজের ১০  জন এবং বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের ৩ জন চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল যেমন আমরি, পিয়ারলেস ও রুবি হাসপাতালের চিকিৎসকদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। পাশাপাশি টলিউডের একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী ও মন্ত্রীও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।একাধিক বার সংক্রমণেরও ঘটনা সামনে এসেছে অনেক। প্রাক্তন মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখার্জী করোনা আক্রান্ত।

করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই মৃদু উপসর্গ বা উপসর্গহীন হওয়ায় ডাক্তাররা এতো বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার মৌমিতা নস্করের মতে, রিসার্চ বলছে ওমিক্রন অত্যধিক মাত্রায় সংক্রামক হলেও এতে ঝুঁকির পরিমাণ অনেকটাই কম। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির থেকে যদি ১০ জন আক্রান্ত হন তবে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৪০ জন হচ্ছে । কিন্তু ওই ১০ জনের মধ্যে হয়তো ৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছিল এবং তার মধ্যে হয়তো একজনের মৃত্যুও হচ্ছিল।ওমিক্রনের ক্ষেত্রে হয়তো সেই সংখ্যা খুবই কম। আসলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসের যে ক্ষতি হচ্ছিল তা ছিল অপূরণীয়।কিন্তু নতুন এই স্ট্রেইনে ফুসফুসের ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূকভাবে অনেকটাই কম হচ্ছে ।ফলে অক্সিজেন স্যাচুরেশন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব নামছে না। ফলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও কম থাকছে।

আরও পড়ুন-একটা ‘না’ থেকে দূরত্বের শুরু, রাখি-গুলজারের প্রেমের গল্প শেষ হয়েও শেষ হয় না…

রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের বুলেটিনও বলছে একই কথা। এই মুহূর্তে সিংহভাগ করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিই রয়েছেন হোম আইসলেশনে। মোট আক্রান্তদের মধ্যে ২৩,৬৫৫ জনই বাড়িতে আছেন। মাত্র ১,৬৮৮ জন কোভিড রোগী ভর্তি রয়েছে হাসপাতালে।সেফ হোমে রয়েছেন ১৫২ জন রোগী। ফ্যাটালিটি রেট ১.১৯ শতাংশ। তবে যে চারিদিকে এত গেল গেল রব!  

চিকিৎসক মৌমিতা  নস্করের মতে, ভাইরাসকে কাবু করার মত ওষুধের সংখ্যা এখনও খুবই কম। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই একমাত্র সম্বল। সেই কারণেই লকডাউন, মাস্ক ও স্যানিটাইজেশনের কথা বলা হচ্ছে বারবার। যেহেতু বাচ্চাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাই তাঁদের নিয়ে চিন্তায় আছি আমরা। আরও একটি বিষয় হল বাচ্চাদের কিন্তু বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা খুব অসুবিধের কারণ তাঁরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক ভাবে তাঁদের অসুবিধার কথা বলতে পারে না। এই জন্যই বড়দের ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।এতে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতেও খানিক সময় লাগবে কারণ তাঁর আশেপাশের বড়দের মধ্যে রোগ  প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। আর সবথেকে বড় কথা শিশুর অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তবে খুব চিন্তার মতও কিছু হয়নি এখনও।

তৃতীয় ঢেউয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হাসপাতালগুলির কতটা  প্রস্তুতি রয়েছে জানতে চাওয়ায় তাঁর মত, প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য হাসপাতালগুলি অনেকটাই তৈরি ছিল। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় হঠাৎ করেই গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতেই কিছুটা সময় লেগেছিল। এই কারণেই প্রচুর রোগীকে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।আসলে নতুন অতিথিকে বুঝতে তো খানিক সময় লাগেই তা চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও বেগ পেতে হয়েছিল। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা হয়েছে।কিন্তু সংক্রমণ তো মানুষের হাতে। যদি সঠিক ভাবে করোনার বিধিনিষেধ পালন করেন এবং ভ্যাকসিন  নেওয়া থাকে তবে আশা করা যায় তেমন ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হবে না।

মৌমিতা নস্করের কথায়, "মানুষ সচেতন নয় এখনও। অনেকই এখনও ভ্যাকসিন নিচ্ছে না যা চারপাশের মানুষের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন মানুষ যদি বেপরোয়া হয়ে রোগ বাঁধিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে দায়ী করে তবে কিছুই বলার নেই। সামান্য উপসর্গেই টেস্ট করুন, আইসোলেশনে থাকুন। অযথা ভয় পাবেন না। আবারও বলছি এখনও পর্যন্ত দেখা গেছে ওমিক্রন প্রাণনাশী নয়. তবে বিধি মেনে চলুন।"   

More Articles