একটা 'না' থেকে দূরত্বের শুরু, রাখি-গুলজারের প্রেমের গল্প শেষ হয়েও শেষ হয় না...
'তুঝসে নারাজ ন্যহি জিন্দেগি, হ্যায়রান হুঁ মে' থেকে 'তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোয়ি, শিকওয়া তো নাহি'- অসংখ্য অমরত্ব পাওয়া গানের রচয়িতা গুলজার, মানে সম্পুরণ সিং কলরা, তাঁকে চেনেন না এমন মানুষ এই একশো কোটিতে নেই বললেই চলে । কবি, লেখক, আবৃত্তিকর, গীতিকার, স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং চিত্র পরিচালক-কত জোব্বা যে গুলজার গায়ে চাপিয়েছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৬৩ সালে এস ডি বর্মনের হাত ধরে বলিউড চিত্র জগতে একটি গানের রচয়িতা হিসাবে তাঁর প্রবেশ, এবং তারপর গুলজারকে আর কখনও পিছনে ঘুরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক কালজয়ী গান, হিট ডায়লগ, কবিতার মাধ্যমে তিনি খুব কম সময়েই বলিউড চিত্র-জগতের আকাশে হয়ে ওঠেন সবচেয়ে জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। এহেন গুলজার ১৯৭২ সালে বাঙালি কন্যা রাখি মজুমদারের প্রেমে হাবুডুবু খেলেন তাঁদের প্রথম দেখায়। সেই প্রেমও যেন আজ বলিউডের এক কাব্য।
১৯৭০ সালে রাখি সুপারস্টার ধর্মেন্দ্রর নায়িকা হয়ে 'জীবন মৃত্যু' সিনেমায় প্রথম কাজ করেন এবং জিতে নেন কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়। রাখির অভিনয় দক্ষতা, তাঁর রং-রূপ-যৌবনের আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দর্শককুলের একাংশ। স্বয়ং গুলজারও বাদ কেন পড়বেন? তিনিও মুগ্ধ হলেন রাখিতে। অকপটে সে কথা রাখিকে জানালেনও। রাখিও যে তখন মনে মনে গুলজারের প্রেমের চোরাবালিতে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিলেন, সে খবর হয়তো অনেকের কাছেই ছিল না। তাই গুলজারের প্রেম নিবেদনের পর পরই রাখি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং অচিরেই তাঁরা বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন ১৯৭৩ সালে। রাখি অবশ্য গুলজারের সঙ্গে বিয়ের আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে অজয় বিশ্বাস নামক এক বাঙালি চিত্র পরিচালককে। কিন্তু সে বিবাহ টেকে না। এবং মাত্র ২ বছরের মধ্যেই, ১৯৬৫ সালে তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।
রাখি আর গুলজারের বিয়েতে তাঁদের আশীর্বাদ জানাতে হাজির থাকেন বলিউডের তাবড় তাবড় অভিনেতা অভিনেত্রীরা। দিলীপ কুমার থেকে অমিতাভ বচ্চন, জিতেন্দ্র থেকে ধর্মেন্দ্র কে ছিলেন না সে বিয়েতে। খুব ধুমধাম করেই শুরু হয়েছিল তাঁদের একসাথে পথ চলা। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরেই তাঁদের এক কন্যা সন্তানের জন্মও হয়। তাঁরা ভালোবেসে নাম রাখেন মেঘনা। মেঘনা গুলজার। কিন্তু মেঘনা গুলজারের জন্মের এক বছর পরেই নিজেদের চলার পথ আলাদা করে নেন রাখি এবং গুলজার। কিন্তু কেন? বুকে অসীম ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও, একে অপরকে চোখে হারানো সত্ত্বেও, কী এমন হয়েছিল তাঁদের মধ্যে যা রাখি আর গুলজারকে কখনও একত্রিত করেনি? কেনই বা তাঁরা আলাদা হয়ে যান কিন্তু কখনোই বিবাহ-বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন না?
আসলে গুলজার সাহেব বিয়ের আগেই রাখির কাছে শর্ত রেখেছিলেন যে বিয়ের পর তাঁকে চলচিত্রে অভিনয় করা ছেড়ে দিতে হবে কারণ তিনি চান না তাঁর বিবাহিত স্ত্রী সিনেমায় পরপুরুষের সাথে অভিনয় করুক। প্রাথমিক ভাবে এই শর্তে রাখি রাজি হলেও তিনি ভেবেছিলেন গুলজার অন্তত তাঁর নিজের নির্দেশনার সিনেমাগুলোতে তাঁকে অভিনয় করার সুযোগ দেবেন। কিন্তু এমন কিছুই হয় না। রাখি বারবার অনুরোধ করেন গুলজারকে। কিন্তু গুলজার তাঁর জেদে অটুট থাকেন। এদিকে বলিউডের তাবড় তাবড় চিত্র পরিচালকরাও রাখির কাছে তাঁদের সিনেমায় অভিনয় করার আবেদন নিয়ে এসে ফেরত যাচ্ছেন খালি হাতে, দিনের পর দিন। রাখি খুশি হতে পারছিলেন না। একজন মানুষের জীবনে ভালোবাসাই সব কিছু হতে পারে না, একজন স্বাধীনচেতা মানুষ চান স্বাবলম্বী হতে, তাঁর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে উপার্জন করতে, খ্যা। রাখিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মনের মধ্যে চাপা অভিযোগ নিয়ে তিনি সংসার করছিলেন, মেঘনাকে বুকে আগলে বড় করে তুলেছিলেন।
আরও পড়ুন-শহর কলকাতায় বাঘের উৎপাত! গাঁজাখুরি নয়, সেদিন যা হয়েছিল…
কিন্তু অদৃষ্ট বোধহয় তাই চায়, যা আমরা মনের খুব ভিতর থেকে চাই। হঠাৎই রাখি আর গুলজারের জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটলো যা তাদেরকে আলাদা করে দিলো চিরতরে এবং রাখি আবার ফেরত এলেন চলচ্চিত্র জগতে। কী সেই ঘটনা?
গুলজারের পরিচালনায় 'আঁধি' সিনেমার শুটিং চলছিল কাশ্মীরে। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রাখিও ছিলেন সেই সিনেমার শ্যুটিংয়ে। একদিন রাতে শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর সব্বাই একটি ছোট্ট গেট-টুগেদারের আয়োজন করেন । শোনা যায় এখানে সেই সিনেমার নায়ক সঞ্জীব কুমার নাকি নেশাতুর অবস্থায় সিনেমার নায়িকা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আপত্তিকর ব্যবহার করে ফেলেন। সুচিত্রা সেন নিজের রুমে ফিরতে চাইলে সঞ্জীব কুমার তাঁকে বাধা দেন এবং তাঁর হাত চেপে ধরেন। গুলজার পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করেন এবং দু'জনের মাঝে এসে সুচিত্রা সেনকে সেই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে তাঁর রুম পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসেন। সুচিত্রা সেনের হোটেল রুমে গুলজারের যাওয়ার খবর কানে পৌঁছায় রাখির। এবং তিনি গুলজারের এই কর্মকান্ড মেনে নিতে পারেন না। গুলজার ফেরত এলে তিনি আপত্তি জানান তাঁর এই কাজের জন্য, কিন্তু গুলজার জানান তিনি যা করেছেন ঠিক করেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবী ওলটপালট হয়ে যায় রাখির। তিনি ভাবেন তিনি যখন গুলজারের সমস্ত ইচ্ছার মর্যাদা দিয়ে আসছেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে, তখন গুলজার কেন অনড়?
শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। পরের দিন সকালেই যশ চোপড়া কাশ্মীরে আসেন তাঁর পরের ছবি 'কাভি কাভি'-তে রাখিকে নায়িকার রোলে অভিনয় করানোর প্রস্তাব নিয়ে। রাখি আর তোয়াক্কা করেন না গুলজারের শর্তের এবং রাজি হয়ে যান সিনেমায় অভিনয় করার জন্য। গুলজারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই সিনেমাটি করায় রাজি হওয়ার পর থেকেই রাখি আর গুলজারের চলার রাস্তা পৃথক হয়ে যায়। তাঁদের মেয়ে মেঘনা গুলজারের মুখ চেয়ে তাঁরা কখনোই বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স করেননি, কিন্তু তাঁরা একে অপরের থেকে আলাদা আলাদা, পৃথক পৃথক ছাদের নিচে গড়তে শুরু করেন নিজেদের পৃথিবী।
এরপরে কেটে গিয়েছে প্রায় ৫০ বছর। না রাখি কখনও আবদ্ধ হয়েছেন কোনও বৈবাহিক সম্পর্কে, না গুলজার। তাঁরা একে অপরের থেকে দূরে থেকেও একে অপরের খুব কাছের হয়েই থেকে গেছেন। রাখি তাঁর ইন্টারভিউয়ে বলেন, 'আমাদের অ্যওয়ার্ড দেওয়া দরকার, আমরা যে কোনও বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর থেকেও একে অপরকে বেশি বুঝি। গুলজার এখনও আমাকে নিজের স্ত্রী ভাবে। মাঝে মাঝেই রাতে গুলজার ফোন করে আর বলে, "আমার চারটে বন্ধু আজ বাড়িতে নিমন্ত্রিত কিন্তু ওদের খাওয়ানোর মতো কিছু নেই বুঝলে। তুমি ঝটপট ঝিঙের তরকারি রান্না করে পাঠিয়ে দাও"। আমি ফোনটা রেখেই রান্না ঘরে ঢুকি। আমার হাতের ক্ষির খেতে খুব ভালোবাসেন গুলজার...'
রাখি আরও যোগ করেন, 'একবার আমার জন্মদিনে আমি মেঘনার রুমে কিছু একটা করছিলাম। হঠাৎ আমি অনুভব করি গুলজারের উপস্থিতি, ঠিক আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। গলা ভারি করে বললেন, "চলো চলো কী করছো? আমাকে ক্ষীর খাওয়াও.."। পরে বুঝতে পারি মেঘনা আর গুলজার মিলে আমাকে জন্মদিনে চমকে দেওয়ার জন্য এই প্ল্যান করেছিল একসঙ্গে। আমিও গুলজারকে ওঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই বরাবর'
বলতে বলতে একটু বোধহয় ছলছল করে ওঠে রাখির চোখ। গলার আওয়াজ কেঁপে ওঠে বোধহয় অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির জোয়ারে। তবু তিনি বলতে থাকেন, 'আমি যত গুলজারের সিনেমা দেখি তত বুঝি গুলজার আমাদের একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোকে তুলে ধরেছে ক্যামেরার সামনে। আমি দেখতে পাই আমাকে আর গুলজারকে। যে মুহূর্তগুলো শুধু ও জানে, আর আমি জানি, ও খুব যত্ন করে সে'গুলো ফুটিয়ে তোলে ক্যামেরার সামনে। যখন আমরা বিবাহিত ছিলাম তখন আমরা রাতের খাবার খাওয়ার পর একসঙ্গে বিছানায় বসে গল্প করতাম। গুলজার তার লেখা শোনাতো আমায়, আমি বাংলা গল্প অনুবাদ করে শোনাতাম গুলজারকে। ও অনেক রাত্রি পর্যন্ত লিখলে আমি জেগে বসে থাকতাম ওঁর পাশে।'
আবার চোখটা ছলছল করে ওঠে বোধহয় রাখির। স্মৃতি বড় বিষম বস্তু; সে কাউকে দিয়ে তাজমহল বানায়, কাউকে দিয়ে কবিতা লেখায় পাতার পর পাতা, কাউকে বিনিদ্র জাগিয়ে রাখে রাতের পর রাত, কাউকে খুব নিঃসঙ্গ করে তোলে, কারোর চোখ দিয়ে জল হয়ে ঝড়ে পড়ে খুব নিঃশব্দে, কাউকে দিয়ে গজল গাওয়ায় আজন্মকাল। রাখি আর গুলজার আজও বসে আছেন পরস্পরের স্মৃতির পাশে, একে অপরের সুখে দুঃখে আজও তাঁরা একে অপরের ছাতা হয়ে রয়ে গেছেন, আজও তাঁরা আপদে বিপদে পাশে থাকেন একে অন্যের। শুধু তাঁরা একে অপরের সাথে থাকতে পারলেন না এই জন্মে। তাঁরা বৃদ্ধ হলেন ঠিকই, কিন্তু এক হতে পারলেন না।
রাখি আর গুলজারের জীবন যেন গুলজারের নিজের লেখা গানেরই লাইন -
'জিনে কে লিয়ে, সোচা হি নাহি, দর্দ সমাহলনে হোঙ্গে-
মুসকুরায়ু তো, মুসকুরানে-কে, কর্জ উতারনে হোঙ্গে...'
ভালো থাকুন গুলজার, ভালো থাকুন রাখি। আপনাদের আবার কোথাও দেখা হোক, সেখানে কোনও অভিযোগ না থাক, সেখানে দেওয়াল আলাদা না হোক।