তাঁর কণ্ঠস্বরের খোঁজে হন্যে ইডি! কীভাবে 'কালীঘাটের কাকু' হলেন বেহালার সুজয়কৃষ্ণ?
Kalighater Kaku Voice Test: সুজয়ের দাদা বিপিএল কার্ডের উপভোক্তা। পর্ণশ্রী থানা এলাকায় ছোট্ট এক চিলতে বাড়িতে তাঁর বসবাস। অথচ সুজয়বাবুর হাতে আসত লক্ষ লক্ষ টাকা। কীভাবে? ভাবিয়েছে ইডির গোয়েন্দাদের।
গত বছর নাগাদ হঠাৎ করেই শিরোনামে এসে পড়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু। নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে উঠে এসেছিল তাঁর নাম। প্রাথমিক ভাবে সেসময় তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল ইডি। তার পর ওই বছরই মে মাসে ইডির হাতে গ্রেফতার হন সুজয়কৃষ্ণ। জানা যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে নাকি কাজ করতেন তিনি। এর পর একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য হাতে এসেছে ইডি-র। সেই দুর্নীতির জের ২০২৪ সালেও পিছু ছাড়েনি সুজয়কৃষ্ণের। অসুস্থতাকে কারণ দেখিয়ে এর পর হাসপাতালে পৌঁছন, তবে তার পরেও শান্তি মেলেনি। আপাতত তাঁর কণ্ঠস্বরের পিছনে পড়েছে ইডি। সেই সূত্র ধরেই ফের খবরে কালীঘাটের কাকু।
বেহালার বাসিন্দা সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র। সেখানে পেল্লাই তাঁর বাড়ি। সাধ করে আবার তার নাম রেখেছেন রাধারানী। তা বেহালার সুজয়কৃষ্ণ কী করে হল কালীঘাটের কাকু, তা এক রহস্য বটে। বেহালাতেই তাঁর জন্ম। বড় হয়ে ওঠা সেখানেই। কর্মসূত্রে তিনি যান নিউ আলিপুরে। কালীঘাটে পা রাখার তেমন সময়সুযোগ কোনওটাই হয়ে ওঠে না। তবু কীভাবে যেন জুটে গিয়েছিল 'কালীঘাটের কাকু'-র তকমা। সেই তকমা ঘিরে তেমন বিব্রতবোধ করা কোনওদিনই ধাতে ছিল না তাঁর। কিন্তু পরে জানা গেল, কুন্তল ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই জুটেছিল এই তকমা।
আরও পড়ুন: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ কালীঘাটের কাকুর গলা? কী রহস্য লুকিয়ে কণ্ঠস্বরে?
দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সুজয়কৃষ্ণ। সে প্রায় ৪৬ বছর তো হবেই। ৭৭-র নির্বাচনে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৮২ থেকে কংগ্রসের সক্রিয় কর্মী। তার পর তৃণমূলে। জানা গিয়েছে, কুন্তল ঘোষ নাকি কাকু বলে ডাকতেন সুজয়কৃষ্ণকে। সেই থেকে সকলেই কাকু বলে ডাকতে শুরু করেন। কীভাবে যেন কালীঘাটের কাকু হয়ে যান তার পর থেকে। শুধু নিয়োগ দুর্নীতি নয়, কয়লা মামলাতেও ইডির ডাক পেয়েছিলেন তিনি।
বেহালায় তার পেল্লাই বাড়ি যে বরাবরই এমন পেল্লায় ছিল, তা কিন্তু নয়। বরং সুজয়কৃষ্ণের দাদা অজয়কৃষ্ণের কথাবার্তা থেকে জানা গিয়েছে, একসময় টালির ঘর ছিল বেহালায়। রান্নাঘর মাটির। সেই মাটির ঘরের জানলা থেকে ছিল একটি মুদির দোকান। প্রাথমিক ভাবে সেটাই চালাতেন সুজয়কৃষ্ণ। সেখান থেকে ক্লাসিক ফিনান্সে ম্যানেজারির চাকরি। পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে চাকরি পান সুজয়কৃষ্ণ, তেমনটাই জানতেন দাদা। তবে কী চাকরি, কোথায় অফিস- এ সমস্ত খবর জানা ছিল না সুজয়ের।
সুজয়ের গ্রেফতারির পর একে একে তার সম্পর্কে বিস্ফোরক সব তথ্য এসেছে ইডি-র হাতে। নিয়োগদুর্নীতিতে কুন্তল ঘোষের থেকে ৭০ লক্ষ টাকা পান সুজয়বাবু। ১০ লক্ষ গিয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাতেও। এমনকী মাণিক ভট্টাচার্যের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর। বিশেষত ২০২৮ সালের পর থেকে তো বটেই। যদিও ইডি-র সামনে সে সমস্ত অভিযোগই উড়িয়েছেন সুজয়। তিনি জানান, ২০২১ সালের আগে মাণিককে চিনতেনও না তিনি।
এদিকে গোপাল দলপতি প্রথমে কালীঘাটের কাকুর কথা সামনে এসেছিলেন। কালীঘাটের কাকু আসলে কে সেই নাম প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন তাপস মণ্ডল। কুন্তল নাকি বার বার কালীঘাটের কাকুর কাছে পেমেন্ট পাঠাতে হবে বলে জানাত বলে দাবি করেছিলেন তাপস মণ্ডল। তার পরেই গ্রেফতার হয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসের প্রাক্তন কর্মী সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র। শাসকদলের তাবড় নেতাদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতেন তিনি। বেনামে একাধিক সংস্থার সঙ্গেও যোগ ছিল সুজয়কৃষ্ণের। এমনকী শান্তনু বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের স্ত্রীর সংস্থাতেও বিনিয়োগ করেছিলেন কাকু। কীভাবে সুজয়বাবুর হাতে আসত এত টাকা? ভাবিয়েছে ইডির গোয়েন্দাদের।
এদিকে সুজয়ের দাদা বিপিএল কার্ডের উপভোক্তা। পর্ণশ্রী থানা এলাকায় ছোট্ট এক চিলতে বাড়িতে তাঁর বসবাস। কোনও ভাবে ডাল-ভাত খেয়েই দিন কাটে। ছোট্ট সংসার, টুকটাক কাজ করে যা আয় হয়, তাতেই কোনওমতে চলে যায়। তার পাঁচশো মিটার দূরেই প্রাসাদোপম বাড়ি। কিন্তু সেই বাড়িতে বছর খানেক হল নেই সুজয় কৃষ্ণ। ইডি হেফাজত কিংবা এসএসকেম- এই করেই দিন চলে যাচ্ছে সুজয়কৃষ্ণের। পর্ণশ্রীর যে ফ্ল্যাটে থাকেন দাদা, সেখানে আরও কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে সুজয়বাবুর। পরে একটু দূরে ওই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করেন কালীঘাটের কাকু। অজয় জানান, অভিষেকও এসেছিলেন একবার সেখানে। অজয়বাবু এ-ও জানান, সই করার ক্ষমতা ছিল না সুজয়কৃষ্ণের। অথচ পরে জানা যায় ওই নাকি এত দুর্নীতির মাথা।
আরও পড়ুন:ইডি, সিবিআই কি হাতের পুতুল? বাংলা যা ভাবছে
আপাতত মাস চারেক ধরে হাসাপাতালেই রয়েছে সুজয়কৃষ্ণ। গত ২২ অগস্ট এসএসকেএমের কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি করা হয় তাঁকে। আপাতত তাঁর কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করাই বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইডি-র কাছে। তদন্তে নেমে একটি মোবাইল কথোপকথনের রেকর্ড এসেছিল ইডি-র হাতে। সেই ফোনকলের নেপথ্যে আদৌ কালীঘাটের কাকুই কিনা, তার প্রমাণ পেতেই জরুরি ছিল সুজয়কৃষ্ণের কণ্ঠস্বরের নমুনা। সেই নমুনা সংগ্রহের জন্যই এসএসকেএম থেকে ইএসআই জোকা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সুজয়কৃষ্ণকে। সেখানে সংগ্রহও করা হয় তাঁর কণ্ঠস্বরের নমুনা। আপাতত সেই কণ্ঠস্বরেই লেখা রয়েছে কালীঘাটের কাকুর ভাগ্য!