ইডি, সিবিআই কি হাতের পুতুল? বাংলা যা ভাবছে

CBI And BJP TMC Govt: দুর্নীতি মামলায় সিবিআইয়ের সাফল্যের হার মাত্র তিন শতাংশ কেন? প্রশ্ন তুলছে বাংলা যা ভাবছে।

এক দশক আগে, সু্প্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রাজেন্দ্র মাল লোধা কয়লাবণ্টন দুর্নীতি তদন্তের অগ্রগতিতে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, সিবিআই খাঁচাবন্দি তোতা। হইচই পড়ে যায়। কেন্দ্রে তখন মনমোহন সিংয়ের সরকার। ১০ বছর পর, দৃশ্য পালটে স্থান হচ্ছে কলকাতা হাইকোর্ট, বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাস। বিচারপতি বলেন, সিবিআইয়ের থেকে ভালো জিজ্ঞাসাবাদ তো উলুবেড়িয়া থানা করতে পারে। শুধু তাই নয়, ক্ষুব্ধ বিচারপতি শিক্ষক নিয়োগ মামলায় ইডির তদন্তকারী অফিসার, পদমর্যাদায় সহকারী ডিরেক্টর মিথিলেশ মিশ্রকে সরিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দেন। কেন? বিচারপতি অমৃতা সিনহার মন্তব্য, ওই অফিসারের আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে।

ইডির পালটা যুক্তি, মোট ১৩১টি মামলা চলছে। এক একজন অফিসার ২২টি করে মামলা দেখছেন। এই যুক্তি মানেননি বিচারপতি। বিচারপতির এই তিরস্কার টুইটের পাশেই যদি রাখা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইট, যার ভাষা অনেকটা স্পিলবার্গের ছবির মতো। ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান। অভিষেক লেখেন, "বাংলার মানুষ এবং তাঁদের মৌলিক অধিকারের লড়াইয়ে পৃথিবীর কোনও শক্তি আমাকে পিছন থেকে আটকাতে পারবে না। পারলে আটকে দেখাও..."

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ৩ অক্টোবর অভিষেককে হাজিরা দিতে বলেছে ইডি। ওই দিন কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রতিবাদে দিল্লিতে তৃণমূলের কর্মসূচি। অভিষেক ঘোষণা করেছেন তিনি হাজিরা দেবেন না। বিচারপতি অমৃতা সিনহা বলেছেন, ৩ অক্টোবর তদন্তের কাজে যেন গাফিলতি না হয়। তাহলে এবার কী পদক্ষেপ করবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা? খাঁচাবন্দি তোতা কি মুক্তি পেয়েছে? নাকি এক খাঁচা থেকে উড়ে আরেক খাঁচায় গিয়েছে?

বাংলায় প্রবাদ আছে, যে যায় লংকায় সে হয় রাবণ। যে যখন ক্ষমতায়, রাজনৈতিক স্বার্থে কেন্দ্রীয় এজেন্সি তার। এ অভিযোগ উঠেছে বারবার। তা সে ১৯৮৪ সালের শিখনিধন মামলা হোক বা ২০০৫-এর সোহরাবুদ্দিন ফেক এনকাউন্টার মামলা, যে মামলায় গুজরাতের তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী অমিত শাহকে গ্রেফতার করে সিবিআই। সে সময়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদি সিবিআইকে কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইন্ডিয়া বলেছিলেন।এক সময় যা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি আজ সেই একই শব্দই প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে বিজেপি বিরোধী দলের মুখে।

২৩ মার্চ, ২০২৩। মোদি পদবির সম্মানহানির দায়ে সুরাট আদালত রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে। পরের দিন ১৪ টি বিরোধী দল একজোট হয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন জমা করে। অভিযোগ, রাজনৈতিক স্বার্থে সিবিআইকে ব্যবহার করছে কেন্দ্র। পিটিশনে কয়েকটা তথ্য তুলে ধরে বিরোধীরা।

২০০৪-২০১৪ এই সময়ে ৭২ জন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। তার মধ্যে ৪৩ জন বিরোধী দলের।

২০১৪-২০২৩ এই সময়ে ১২৪ জন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। তার মধ্যে ১১৮ জন বিরোধী দলের।

অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ মামলাই বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে। পিটিশনে বিরোধীদের প্রশ্ন ছিল, পি চিদম্বরম, মণীশ সিসোদিয়া, সঞ্জয় রাউথ, সত্যেন্দ্র জৈন গ্রেফতার হলে, কেন একই যুক্তিতে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, নারায়ণ রানে বা শুভেন্দু অধিকারী কেন গ্রেফতার হবেন না?

২০১৩ সালে অমিত শাহ বলেন, কংগ্রেসের হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মুকুল রায় সারদা চিট ফান্ড মামলার অন্যতম মূল অপরাধী। বিজেপি ক্ষমতায় এলে দু'জনকেই গ্রেফতার করা হবে। ২০১৯ সালে সেই হিমন্ত বিশ্বশর্মা অসমে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী। মুকুল রায় বিজেপির সহ-সভাপতি। বিরোধীরা ঠাট্টা করে বলে ওয়াশিং পাওডার ভাজপা।

এক নজরে দেখা যাক, সিবিআইয়ের হাতে কী কী মামলা রয়েছে?

সারদা চিট ফান্ড মামলা

২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার তছরুপ। ৯ বছর পরেও মামলার মূল চার্জশিট জমা পড়েনি

রোজ ভ্যালি মামলা

১৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক তছরুপ। এই মামলাতেই গ্রেফতার শ্রীকান্ত মোহতা ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পরে জামিনে মুক্তি পান। তাপস পাল ৩ বছর জেলবন্দি ছিলেন। ২০২৩ সালের মে মাসে ইডি আর্থিক তছরুপ প্রতিরোধ আইনে নতুন চার্জশিট জমা করে।

নারদা স্টিং অপারেশন

২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের ফলাফলের ঠিক পরে ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র এবং শোভন চট্টোপাধ্যাকে গ্রেফতার করে সিবিআই আর ৪ দিন পর প্রত্যেকেই জামিন পেয়ে যান।

হাইকোর্টে মামলার শুনানি চলছে

কয়লাপাচার মামলা

এই মামলরায় একাধিকবার কেন্দ্রীয় এজেন্সি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাজিরা দিতে বলে। হাজিরা দিতে বলা হয় অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। একাধিকবার ডাকা হয়েছে মন্ত্রী মলয় ঘটককে। ডেকে পাঠানো হয় রাজ্যের ৮ আইপিএস অফিসারকে।

গরুপাচার মামলা

২০২০ সালে এফআইআর দায়ের করে সিবিআই। সিবিআই গ্রেফতার করে অনুব্রত মণ্ডল, তাঁর দেহরক্ষী সায়গল হোসেন, মেয়ে সুকন্যা মণ্ডল এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মণীশ কোঠারিকে। এখনও চার্জশিট দেয়নি সিবিআই।

ভোট-পরবর্তী হিংসা মামলা

৫২ টি খুন অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলার তদন্ত, ৩৯ ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির মামলার তদন্ত। ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ চার্জশিট পেশ করে সিবিআই।

পুরনিয়োগ দুর্নীতি মামলা

ব্যবসায়ী অয়ন শীল গ্ৰেফতার হওয়ার পর কলকাতা হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। সরকার সিবিআই তদন্ত বন্ধ করার আবেদন করে সুপ্রিম কোর্টে। আদালত তা খারিজ করে। কলকাতা হাইকোর্টে শুনানি চলছে।

এসএসসি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলা

বহু চর্চিত মামলা। প্রায় ৩৬ হাজার চাকরিজীবী টাকার বিনিময়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ। প্রায় ২০০ কোটি টাকার দুর্নীতি। উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৫২ কোটি টাকা। গ্রেফতার হয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তাঁর বান্ধবী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষা দফতরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারিক মানিক ভট্টাচার্য, পলাশিপাড়ার বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা, বড়ঞার বিধায়ক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি সুবীরেশ ভট্টাচার্য। প্রাক্তন এসএসসি চেয়ারম্যান শান্তিপ্রসাদ সিনহা, এসএসসি নিয়োগে বিশেষ সহায়ক কমিটির আহ্বায়ক।

এ ছাড়াও গ্রেফতার তৃণমূলের যুবনেতা কুন্তল ঘোষ এবং শান্তনু বন্দ্যোপাধ্য়ায়, সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকা হয় তৃণমূল যুব সভানেত্রী সায়নী ঘোষকে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শিক্ষানিয়োগ দুর্নীতি মামলা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে সরে বিচারপতি অমৃতা সিনহার বেঞ্চে গিয়েছে।

তবে কি সত্যিই প্রভুর হয়ে তোতাপাখির মতো এ রাজ্যে তো বটেই বিজেপি বিরোধী অন্যান্য রাজ্যেও প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে সিবিআই, ইডি? আর যদি না করে থাকে তা হলে দুর্নীতি মামলায় সিবিআইয়ের সাফল্যের হার মাত্র তিন শতাংশ কেন? প্রশ্ন তুলছে বাংলা যা ভাবছে। দেখুন আজ সন্ধ্যায়। সাংবাদিক, বিশ্লেষকরা কী বলছেন? আজকের পর্ব, ইডি, সিবিআই কি হাতের পুতুল? প্রতি সোম, বুধ, শুক্র সন্ধে ৭ টা থেকে - কলকাতা ২৪x৭ এর ইউটিউব চ্যানেল এবং inscript.me এর ফেসবুক পেজে চোখ রাখুন।

 

More Articles