জন্মের ২ ঘণ্টার মধ্যে মাতৃদুগ্ধ পান করালে উপকার জীবনব্যাপী, কিন্তু পথের কাঁটা মুনাফার লোভ

শিশুর জীবনের শুরু থেকে তারপর সারা জীবন মা-ই পরম সম্পদ। এই দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষকে লড়তে হয় বাঁচার লড়াই। সেই লড়াই লড়তে হলে চাই সুস্থ শরীর, উন্নত মস্তিষ্ক। বিজ্ঞান বলে, জন্মের ২ ঘণ্টার ভেতর মা যদি সদ্যোজাত সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করান, তাহলে সেই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। সেইসঙ্গে মস্তিষ্কের গঠন পরিণত হবে।

কিন্তু এব্যাপারে এক সার্বিক অজ্ঞতা থেকে গিয়েছে। মাতৃদুগ্ধ সঠিক সময়ে সন্তানকে পান করানো সম্পর্কে সচেতনতার একান্ত অভাব দুনিয়ার সব সমাজেই বিদ্যমান। ভারতেও একই পরিস্থিতি। এদেশের মেয়েরা মা হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়াচ্ছেন। জন্মদানের ২ ঘণ্টা পরে সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ালে শিশুমৃত্যুর হার ৩৩ শতাংশ কমে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের গঠনও স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ভারতে এবং পৃথিবীর অন্যান্য সদ্যোজাতকে মাতৃদুগ্ধ পান করানো হয় না সঠিক সময়ে। এর পরিবর্তে পান করানো হয় জল অথবা চিনি দেওয়া জল, মধু এমনকী, চা পর্যন্ত। এতে শিশুর কোনও উপকারই হয় না। বরং বিপদ বাড়ে। এমনকী, মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ে।

ভারতে মেয়েরা কিন্তু জানেন, সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পানের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু জন্মের ২ ঘণ্টার ভিতর শিশুকে  মাতৃদুগ্ধ পান করানো কতটা উপকারী- এই তথ্য অধিকাংশ মায়ের কাছেই নেই। এর দু'টি মূল কারণ। প্রথম কারণ, বিষয়টি নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারের জন্য সরকারি উদ্যোগ নেই এবং এবিষয়ে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য বাজেটগুলোতে বরাদ্দও নেই। ফলে কথাটি গোপনই থেকে যাচ্ছে। মেয়েদের এব্যাপারে সচেতন করতে বিজ্ঞানসম্মত সরকারি পরিকল্পনার অভাব সব রাজ্যেই।

আরও পড়ুন: স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছবি মিত্তল || পুরুষদেরও হতে পারে এই রোগ?

ভারতের শহর এলাকা এবং গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা মহিলাদের মধ্যে তুলনায় শহরের মেয়েদের মধ্যে সন্তানকে মায়ের দুধ পান করানোর চল বেশি। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে শহরের বাসিন্দা মায়েরা সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করান। আর গ্রামাঞ্চলে ৮৯ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা মাতৃদুগ্ধ পান করান, কিন্তু অনিয়মিতভাবে। এর অন্যতম এক কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই দরিদ্র মায়েরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। ফলে শিশুসন্তানকে বাড়িতে রেখে কর্মস্থলে যান। ফলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিশু মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। যদিও মায়ের দুধ জন্মের পর থেকে টানা ২ বছর বয়স পর্যন্ত পান করাই শিশুর স্বাস্থ্য উন্নত করে। মাতৃদুগ্ধ পান করানো মানবসভ্যতার অঙ্গ, সেকথাও বলা বাহুল্য। 

জন্মের ২ ঘণ্টার মধ্যে সদ্যোজাতকে মায়ের দুধ পান করানোর তথ্যটা নাগরিকদের মধ্যে প্রচার না করায় কেন্দ্র কিংবা দেশের রাজ্য সরকারগুলোর দায় কতটা? এক কথায়, অনেকটাই। একইসঙ্গে দায়ী মানুষের স্বার্থপরতা। একান্নবর্তী পরিবার এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয়েছে। এর ফলে অভিভাবকের অভাব পড়েছে সত্যিই। আর কে না জানে, পৃথিবী অভিভাবকশূন্য হলে নবীনদের বিপদ হবেই!  পরামর্শ দেওয়ার মতো প্রবীণ কাছের মানুষের অভাব পড়েছে। সাংসারিক জীবনযাপনের উপদেশ দেওয়ার মতো মানুষ কমছে। 

প্রতি বছর দুনিয়ার প্রায় ৮ কোটি শিশু মায়ের দুধ যথাসময়ে পায় না। সন্তানের জন্মের ২ ঘণ্টার ভেতর মায়ের দুধ পান করানো সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের প্রধান কারণ কেবলমাত্র তথ্যটি প্রচারিত না হওয়া।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ এ-ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র তরফে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সন্তান প্রসবের ২ ঘণ্টার ভেতর মায়েরা যাতে সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর উপযোগিতা সম্পর্কে জানতে পারেন-এব্যাপারে প্রচার চালানো দরকার।

ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভ নামে একটি সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মায়ের দুধ পান করানো প্রসঙ্গে সচেতনতা প্রচার ভারতে নমো নমো করে চলেছে। 

পাশাপাশি, পাউডারড মিল্ক সংস্থাগুলো অনলাইনে চুটিয়ে ব্যবসা করছে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য বিক্রির জন্যে। আর সেই ফাঁদে পড়ছেন বহু মানুষ। এদিকে মুনাফার পাহাড় তৈরি করছে শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারক পাউডারড মিল্ক সংস্থাগুলো।

মায়েরা স্রেফ সচেতনতার অভাবে সন্তানকে নিয়মিত মাতৃদুগ্ধ পান করানোর অভ্যাস ছেড়ে দিচ্ছেন। ভারতে এই সমস্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বেসরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সন্তানকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত মায়ের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে না ৩৫.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে। এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে পাউডারড মিল্ক।

আমাদের দেশে ২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে বাজারি সংস্থার তৈরি শিশুখাদ্য খাওয়ানো বেআইনি। ১৯৯২ সালে আইন করে বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০০৩ সালে ইনফ্যান্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট অ্যান্ড ইনফ্যান্ট অ্যাক্ট, যা এককথায় আইএমএ অ্যাক্ট হিসেবে পরিচিত, তা আরও কঠোর করা হয়। এই আইন লঙ্ঘনকারীদের তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। কার্যত আইনটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে। আইন বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র রিপোর্ট অনুসারে, আফ্রিকার দেশগুলোতে জন্মের ২ ঘণ্টার মধ্যে সদ্যোজাতকে মাতৃদুগ্ধ পান করানো হয় সারা পৃথিবীর তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি হারে। অন্তত শতকরা ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। এশিয়া মহাদেশে এই হার ৩২ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। 

ভারতে ইনফ্যান্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট অ্যাক্ট থাকলেও আইনটা যেন বছরের পর বছর ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে। আইন লঙ্ঘন করার জন্য ২০২০ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার নেসলে হেলথ সায়েন্সের বিরুদ্ধে আইনসংগত ব্যবস্থা নেয়। কেন শিশুখাদ্য প্রস্তুতাকারক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, এই প্রশ্নও উঠছে।

মাতৃদুগ্ধের বিকল্প দুধের (পাউডারড মিল্ক) বিপুল বাজার গড়ে উঠেছে বিশ্বজুড়েই। বর্তমানের বিলিয়ন ডলারের বাজার ২০২৭ সালের মধ্যে আরও ১০.২ শতাংশ বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষক সংস্থা গ্লোবাল মার্কেট ইনসাইট।

দেশকে আমরা মা বলি। বলা বাহুল্য, দেশের উন্নতির অন্যতম শর্ত হল শিশুদের ভবিষ্যৎ যাতে সুরক্ষিত হয় এবং শিশুরা যাতে সুস্থভাবে জীবন কাটাতে পারে এর দিশা খুঁজে বের করা। সেই দিশার হদিশ মিললেও তা এখনও কাগজেকলমে বন্দি থেকে গিয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ তম বছরেও জন্মের ২ ঘণ্টার ভিতর সদ্যোজাতকে মাতৃদুগ্ধ পান করানো সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে উঠেনি, এটা ব্যর্থতা এবং লজ্জার তো বটেই। শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে নজর দিতে সরকারি স্তরে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে দেরি হলেও কাজের কাজটা এবার শুরু করা উচিত। বেটার লেট দ্যান নেভার বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। মাতৃদুগ্ধ পান করানোর নিয়মবিধি সম্পর্কে মায়েদের অজ্ঞতা দূরীকরণই তাই অতীব জরুরি কাজ। সরকার চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এই কাজে লাগালে দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে সেটা খুবই ভাল হত। 

বৃহৎ পুঁজি পৃথিবীজুড়ে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প পণ্যের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার জাল বিছিয়ে রেখেছে। ২ বছরের নিচের শিশুদের জন্য মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি আইনের তোয়াক্কাও করে না। দ্রুত এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার।

More Articles