শেষ হাসপাতালটিও ধ্বংস! গাজায় যেভাবে চিকিৎসাকেন্দ্রে আক্রমণ চালিয়েছে ইজরায়েল

Israel Attack on Gaza Hospitals: সাম্প্রতিক ইজরায়েলি বিমান হামলায় উত্তর গাজার শেষ যে হাসপাতালটি কোনওরকমে চলছিল, সেটিও আর বেঁচে নেই।

দেড়বছর ধরে গাজাকে শেষ করে দিতে, এমন কোনও উপায়ই নেই যা ইজরায়েল বাকি রেখেছে। গণহত্যার এমন নজির সাম্প্রতিক বিশ্ব দেখেনি। তবে বিশ্বের অভ্যাসও হয়ে গেছে। শিশুর লাশ দেখার অভ্যাস, খেতে না দিয়ে প্রাণে শেষ করতে দেখার অভ্যাস; নিরস্ত্র, ভীত মানুষদের শেষ আশ্রয় গুঁড়িয়ে যেতে দেখার অভ্যাস! গাজার নাম পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে যা যা করণীয়, তার অতিরিক্ত কিছু করে চলেছে প্রতিবেশী ইজরায়েল। সাম্প্রতিক ইজরায়েলি বিমান হামলায় উত্তর গাজার শেষ যে হাসপাতালটি কোনওরকমে চলছিল, সেটিও আর বেঁচে নেই। গুরুতর অসুস্থ রোগীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন, বলা ভালো মৃত্যুর দিকে নিজেরাই হাঁটতে শুরু করেছেন। এই মুহূর্তে গাজায় আর কোনও হাসপাতাল নেই যেখানে বোমায়, গুলিতে জেরবার মানুষের সামান্য চিকিৎসাও হতে পারে।

গত রবিবার আল-আহলি আরব হাসপাতালে হামলা চলেছে। ইজরায়েল যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের দক্ষিণে একটি করিডোর দখল করে ফেলেছে। ইজরায়েল আগেই জানিয়েছিল, মার্চে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার পরে সামরিক আক্রমণ আরও প্রসারিত করার পরিকল্পনা করেছে সেনা। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই রবিবার ভোরে ইজরায়েলি বিমান বাহিনী হাসপাতালের একটি ভবন লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এসব জায়গায় হামলা চালানো মানবিক অপরাধ। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের স্বাস্থ্য সুবিধা, চিকিৎসা কর্মী এবং রোগীদের নিশানা করাকে যুদ্ধাপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। ইজরায়েল তা জানে, তাই আগে থেকেই এসব ক্ষেত্রে একটি সাধারণ যুক্তি তারা দিয়ে থাকে যে, ওই হাসপাতালের হামাসের সদস্যরা ঘাঁটি গেড়েছে। হামাস ওই হাসপাতাল থেকেই বসে নিয়ন্ত্রণ চালানোর চেষ্টা করছে। তাই এই হামলা। হামাস যে হাসপাতালে ছিল, তার প্রমাণ কী? নেই। ইজরায়েল প্রমাণ দেয় না।

আরও পড়ুন- কীভাবে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে AI ব্যবহার করল ইজরায়েল?

গাজার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে যুদ্ধের কিছুকাল পর থেকে বারবার হামলা করেছে ইজরায়েলি সেনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ২,০০০ পাউন্ড বোমা দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সব। আল-আহলি হাসপাতাল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রায় ৩৬টি হাসপাতালের একটি। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার স্বাস্থ্যসেবার উপর যে যে বড় হামলা চলেছে, তার তালিকা রইল:

১৭ অক্টোবর, ২০২৩

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, ইজরায়েলি হামলায় আল-আহলি হাসপাতালের গাড়ি পার্কিং এলাকায় আশ্রয় নেওয়া শয়ে শয়ে মানুষ নিহত হন ওই হামলায়। হামলার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই, হাসপাতালের পরিচালককে সতর্ক করে আসছিল ইজরায়েল। ইজরায়েল দাবি করে, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর নিজেদেরই উৎক্ষেপিত একটি ভুল রকেটেই ওই হাসপাতালে গিয়ে পড়ে বলে বিস্ফোরণ হয়। অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করে ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী।

৩ নভেম্বর, ২০২৩

আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে ইজরায়েলি বিমান হামলায় একটি অ্যাম্বুলেন্স কনভয় ধ্বংস হয়ে যায়। বহু ফিলিস্তিনি মারা যান এই হামলায়।

২১ নভেম্বর, ২০২৩

আল-আওদা হাসপাতালে বিমান হামলায় ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের ডাঃ মাহমুদ আবু নুজাইলা, ডঃ আহমদ আল-সাহার এবং ডাঃ জিয়াদ আল-তাতারি নিহত হন।

২২ জানুয়ারি, ২০২৪

খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের প্রবেশদ্বার থেকে প্রায় ৫০০ ফুট দূরে আশ্রয় নিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন নিহত হন। যুদ্ধ এবং জোর করে সরিয়ে নেওয়ার আদেশের কারণে ওই এলাকায় আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন।

২০ মার্চ, ২০২৪

ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, অবরোধের সময় আল-শিফা হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ৯০ জনকে হত্যা করা হয়। এই স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা।

৩১ মার্চ, ২০২৪

আল-আকসা হাসপাতালে বিমান হামলায় বহু মানুষ নিহত ও আহত হন। হামলা চালানো হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ঠিক বাইরে যেখানে অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিলেন।

১ এপ্রিল, ২০২৪

ইজরায়েলি বাহিনী গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফাতে ১৪ দিন ধরে হামলা চালিয়ে অজস্র চিকিৎসা কর্মীসহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের প্রাণ নেয়। হাসপাতালের বহু কর্মীদের এবং অন্যান্য মানুষদের অপহরণও করা হয়।

১৪ অক্টোবর, ২০২৪

দেইর এল-বালার আল-আকসা হাসপাতালে ইজরায়েলি বিমান হামলায় পাঁচজন নিহত এবং ৬৫ জন আহত হয়। বাস্তুচ্যুত মানুষের তাঁবুতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষ তখন সেখানে ঘুমোচ্ছিলেন।

২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

ইজরায়েলি সেনাবাহিনী নির্দেশ দিয়েছিল, উত্তর গাজার সর্বশেষ কার্যকরী হাসপাতাল, কামাল আদওয়ান ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। সেই আদেশ মানতে অস্বীকার করার পরে হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ হুসাম আবু সাফিয়াকে গ্রেফতার করে সেনা। সামরিক বাহিনী প্রায় ২০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, হাসপাতালের ভিতরে অভিযান চালয়ে প্রায় ২৪০ জনকে বন্দি করে। সেই সময় ওই অঞ্চলে পরিচালিত সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান ছিল এটিই।

৪ জানুয়ারি, ২০২৫

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মতে, ইজরায়েলি বাহিনী বারংবার হামলা চালিয়ে উত্তর গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালটির পরিষেবা বন্ধ করে দেয়।

২৩ মার্চ, ২০২৫

রাফাহ-র তাল-আস-সুলতান অঞ্চলে একটি উদ্ধার অভিযানের সময় ইজরায়েলি বাহিনী প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জন্য কর্মরত ১৫ জন ফিলিস্তিনি চিকিৎসককে গুলি করে হত্যা করে। নিহত এক ফিলিস্তিনি চিকিত্সকের মোবাইল ফোন থেকে উদ্ধার করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দাঁড় করিয়ে ওই ১৫ জনকে গুলি করে তাঁদের দেহ বালিতে পুঁতে দেয় ইজরায়েলি বাহিনী।

আরও পড়ুন- আরও নির্মম নেতানিয়াহু! গাজাতে যে উপায়ে আক্রমণের কৌশল ভাবছে ইজরায়েল

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গাজার হাসপাতালের অবস্থা 'বর্ণনাতীত’। হু-এর মুখপাত্র ডাঃ মার্গারেট হ্যারিস বলছেন, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের উপর একের পর এক আক্রমণ তাঁরা দেখছেন। ইজরায়েল এই অঞ্চলকে অবরুদ্ধ করে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহও গুরুতরভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। গত রবিবার, গাজা শহরের আল-আহলি হাসপাতালে যে হামলা চালিয়ে ইজরায়েল হামাসকে নিকেশ করার দাবি করেছে, তাতে হামাসের কেউ মারা গেছে কিনা নিশ্চিত না করা গেলেও এক শিশুর প্রাণ গিয়েছে। এই হাসপাতালটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিল জেরুজালেমের অ্যাংলিকান চার্চ৷ চার্চ অফ ইংল্যান্ডের হাউস অফ বিশপস একটি বিবৃতিতে বলেছে, গাজায় হাসপাতালগুলিও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়াতে তাঁরা হতাশ। আরও আশ্চর্যে বিষয় হচ্ছে, হামাস যে ওই সব হাসপাতাল ব্যবহার করে হামলা চালাচ্ছে, আক্রমণ করেছে বলে দাবি করেছে ইজরায়েল, তার সপক্ষে এখনও স্পষ্ট এবং বাধ্যতামূলক প্রমাণ প্রকাশ্যে আনতে পারেনি। আল-আহলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রমা হাসপাতাল ছিল। এটিই ছিল গাজার উত্তরে অবস্থিত একমাত্র হাসপাতাল যেখানে সিটি স্ক্যান হতো। আর কোনও অস্ত্রোপচারই হবে না গাজাতে, রোগীদের পরীক্ষা করাও যাবে না, ওষুধ দেওয়াও যাবে না। এমনকী জটিলতার ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থায় অন্য জায়গা থেকে যাঁদের এখানে পাঠানো হতো, তাঁরাও বিনা চিকিৎসায় প্রাণ দেবেন। বিশ্ব অভ্যস্ত এই হামলা, প্রতিহামলায়। মানবিক পরিষেবা বন্ধ হতে দেখাও আমাদের অভ্যাসই হয়ে গেছে। 

More Articles