আরও নির্মম নেতানিয়াহু! গাজাতে যে উপায়ে আক্রমণের কৌশল ভাবছে ইজরায়েল
Israel Gaza War: বাইডেন প্রশাসন ইজরায়েলে ২,০০০ পাউন্ড বোমা পাঠাতে অস্বীকার করেছিল। বাইডেন প্রশাসন বলেছিল, যদি ইজরায়েল গাজায় আরও মানবিক সাহায্যের অনুমতি না দেয় এবং সাধারণ মানুষের হত্যা না কমায় তাহলে বোমা পাঠাবে না আমের...
হামাসের সঙ্গে দুই মাসের যুদ্ধবিরতির পর ইজরায়েলের সেনাবাহিনী আবারও গাজায় আক্রমণ শুরু করেছে। জানা যাচ্ছে, ইজরায়েলের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতারা নতুনভাবে স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করছেন। অর্থাৎ সাময়িক বিরতির পর আবারও গাজা অঞ্চলে সামরিক দখল চলতে শুরু করেছে এবং, সম্ভবত আগের থেকেও ভয়াবহ আকারে। বর্তমান এবং প্রাক্তন ইজরায়েলি কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, গাজাতে নতুন করে এবং আরও আক্রমণাত্মক কৌশলে হামলা চালাতে চলেছে ইজরায়েল। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানবিক সাহায্যের উপর সরাসরি সামরিক নিয়ন্ত্রণ। হামাসের বেসামরিক নেতৃত্বকে লক্ষ্য করা; আশেপাশের এলাকা থেকে নারী, শিশু এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং যারা রয়ে গেছে তাদের অবরুদ্ধ করা - উত্তর গাজায় গত বছর থেকে শুরু হওয়া এই কৌশলকেই আরও তীব্রভাবে প্রয়োগ করতে চলেছে ইজরায়েল।
ইজরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, এখনও যুদ্ধবিরতি আলোচনার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁরা। এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগই আকাশপথে বোমা হামলা করেছে ইজরায়েল। এই আক্রমণ আরও কীভাবে চলবে, তার কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রক বলছে, এখনও অবধি ইজরায়েলের এই আক্রমণে ৫০,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এখনও, যাদের অর্ধেকেরই বেশি নারী ও শিশু। এই যুদ্ধে ৪০০-রও বেশি ইজরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে।
পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ এবং দখল চালাতে পাঁচটি সেনা ডিভিশনের প্রয়োজন হবে ইজরায়েলের। জানা যাচ্ছে, নিজেদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রসারিত করতে পারে ইজরায়েল। ইজরায়েলি আধিকারিকদের একাংশ বলছেন, এই আগ্রাসনের প্রচেষ্টা, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইজরায়েলে আক্রমণ করার পরেই প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর হামাসকে নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। হামাসের ওই হামলায় ১২০০ জন ইজরায়েলি সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়৷ পাল্টা প্রতিশোধে ৫০ হাজার মানুষ খুন করেছে ইজরায়েল।
আরও পড়ুন-রমজানে মৃত ৪১৩! যুদ্ধবিরতির মধ্যেও কেন গাজায় আবার হামলা ইজরায়েলের?
সামরিক গাজা বিভাগের প্রাক্তন ডেপুটি কমান্ডার আমির আভিভি বলেছেন, গত বছর আইডিএফ-এর অভিযান কৌশল ও যুদ্ধকৌশল নিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা গিয়েছিল। ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ক্ষতির বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের উদ্বেগের কারণেও হামলা সীমাবদ্ধ ছিল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আবারও ট্রাম্পের ফিরে আসা এবং ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা সংস্থায় পরিবর্তনের কারণে সেই সীমাবদ্ধতাগুলি অনেকটা কমে এসেছে।
আভিভি বলছেন, "এখন নতুন আইডিএফ নেতৃত্ব রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমর্থন আসছে, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে এবং আমরা উত্তরে আমাদের প্রধান অভিযান শেষ করেছি এবং সম্পূর্ণ মনোযোগ এবার গাজায়। এবার পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ হবে এবং হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল না করা পর্যন্ত তারা থামবে না।"
ইজরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, বড় আকারের কোনও আগ্রাসন শুরু করার আগে ইজরায়েল নাকি এখনও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছুক। গত মঙ্গলবার ইজরায়েল কয়েকজন হামাস নেতা ও যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে একটি বিধ্বংসী বিমান হামলা চালায় এবং স্থলভাগেও অভিযান চালায়। পাল্টা প্রতিশোধে তেল আবিবে রকেট হামলা চালায় হামাস। ইজরায়েল বলছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করেনি ইজরায়েল। ইজরায়েলি কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতির ১৬ তম দিনে চুক্তির দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশের জন্য তাদের শর্তগুলি জানান কিন্তু হামাস তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
হামাস তখন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত, স্টিভ উইটকফের একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, ১১ জন জীবিত বন্দির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি ৪০ দিন বাড়ানোর জন্য এবং পরিবর্তে একজন আমেরিকান ইজরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ইজরায়েল নাকি তারপরই আবার আক্রমণ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
হামাস অবিলম্বে দ্বিতীয় পর্বের জন্য আলোচনা শুরু করতে চেয়েছিল, যে পর্বে গাজা থেকে সম্পূর্ণ ইজরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করবে এবং হামাস অবশিষ্ট জীবিত ইজরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেবে বলে কথা ছিল। শনিবার হামাস বলছে, এখনও উইটকফের প্রস্তাব বিবেচনা করছে তারা। তথ্য বলছে, গাজায় ইজরায়েল হামাসের ২৪টি ফাইটিং ব্যাটালিয়নের প্রায় সবক'টিই ধ্বংস করে দিয়েছে। অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য অঞ্চলটি দখলে রাখতে হবে ইজরায়েলকে।
ক্যানবেরার বিশ্ববিদ্যালয়ের যুদ্ধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাশা-ডোমিনিক ডভ বাচম্যান বলছেন, আলজেরিয়ার ফরাসিদের আক্রমণ, অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম, আফগানিস্তানে আমেরিকানদের আক্রমণের ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে, বিদ্রোহী বিরোধী প্রচেষ্টায় একদিন ইজরায়েলিরাও ব্যর্থই হবে। এই আগ্রাসন ইজরায়েলের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করবে বলে মনে করছেন তিনি। তবে গাজায় আরও তীব্র এবং দীর্ঘ অভিযানের সমর্থকদের যুক্তি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন আরও গভীর। সামরিক চাপ বাড়ানোই এখন আশু প্রয়োজন।
গত বছর, বাইডেন প্রশাসন ইজরায়েলে ২,০০০ পাউন্ড বোমা পাঠাতে অস্বীকার করেছিল। বাইডেন প্রশাসন বলেছিল, যদি ইজরায়েল গাজায় আরও মানবিক সাহায্যের অনুমতি না দেয় এবং সাধারণ মানুষের হত্যা না কমায় তাহলে বোমা পাঠাবে না আমেরিকা। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই, গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প ভারী বোমা বিক্রির অনুমোদন দিয়েছেন। ইজরায়েল এই মাসের শুরুতেই গাজায় সমস্ত সহায়তা বন্ধ করার আগে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনাও করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইজরায়েলি সামরিক সংস্থার নেতৃত্বের পরিবর্তন, ইতিমধ্যেই রণকৌশলে বীভৎস পরিবর্তন এনেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইজরায়েল কাটজ এবং আইডিএফ চিফ অফ স্টাফ ইয়াল জামির এমন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়েছেন যারা কখনও সখনও নেতানিয়াহুর বিরোধিতাও করেছেন।
আরও পড়ুন- দুর্নীতি ঢাকতেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার গাজায় আক্রমণ নেতানিয়াহুর?
নেতানিয়াহু গত বছর আইডিএফকে গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছিলেন যাতে হামাসকে কোনওরকমের ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করা যায় এবং সেই ত্রাণ বিক্রি করে লাভবান হওয়া থেকেও বিরত রাখা যায়। ইজরায়েলের অনুমান, হামাস ত্রাণ বিক্রি করে ১ বিলিয়ন ডলার লাভ করেছে। তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং তৎকালীন আইডিএফ চিফ অফ স্টাফ হার্জি হালেভি এই ধারণাটিকে নস্যাৎ করে দিয়ে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এসব করলে সৈন্যরাই অহেতুক ঝুঁকির মুখে পড়বে। সম্প্রপ্তি ইজরায়েলি কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাকে অবহিত করেছেন যে আগামীতে মানবিক সাহায্যগুলি পরীক্ষা করা হবে এবং তা ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত নতুন 'লজিস্টিক হাব’-এই করা হবে।
গ্যালান্ট এবং হালেভি হামাসের সামরিক ক্ষমতার অঞ্চলগুলি আক্রমণ করার পক্ষে ছিলেন। তবে নেতানিয়াহু হামাসের সাধারণ কর্মকর্তাদেরও নিশানায় রাখতে চেয়েছিলেন। নভেম্বরে গ্যালান্টকে দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করার পর, হামলার ধরণ পাল্টে গেছে। গত সপ্তাহে ইজরায়েল একটি হামলা চালায় যাতে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই হামলায় শুধুমাত্র হামাসের সশস্ত্র শাখা, ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের সদস্যদেরই লক্ষ্য করা হয়নি, গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মহাপরিচালক, বিচার মন্ত্রকের মহাপরিচালক এবং হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্যদেরও লক্ষ্য করা হয়েছিল। এঁরা সকলেই রমজানের রোজার আগে ভোরবেলা খাবারের জন্য বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন। কাটজ হুমকি দিয়েছেন, হামাস যত বেশি প্রত্যাখ্যান করবে, তত বেশি জমি হারাবে তারা, ইজরায়েলে তত বেশি গাজা দখল করবে।