কমবে দীর্ঘস্থায়ী রোগ! বিশ্বজুড়ে হু হু করে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই ডায়েট

প্রতিদিন যে ধরনের খাবারগুলি আমরা খাই তা সরাসরি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং জীবনকালকে প্রভাবিত করে। শুধুমাত্র সঠিক খাদ্যগ্রহণের কারণেই কমে যেতে পারে একাধিক মারাত্মক রোগের ঝুঁকি।মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট মেনে খাবার খেলে উল্লেখযোগ্যভাবে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে এবং কমে যেতে পারে বেশ কিছু দীর্ঘস্থায়ী রোগের সম্ভাবনাও। চলুন জেনে নেওয়া এই প্রকার ডায়েটের উপকারিতা, কোন খাবারগুলি খাবেন আর কি খাবেন না এবং কী পদ্ধতিতে পালন করবেন মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট - এমন কিছু খুঁটিনাটি তথ্য।

মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট কী?


মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট হল একধরনের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন সম্পর্কিত ডায়েট পদ্ধতি।১৯৬০ সাল থেকে এই ডায়েট পদ্ধতিকে স্বাস্থ্যের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিশ্বে ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যকর হিসেবে পরিচিত এই ডায়েট সম্পর্কে গবেষণা শুরু ১৯৫০ সাল থেকে। গবেষকরা লক্ষ্য করেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভূমধ্যসাগরের সীমান্তবর্তী দেশগুলিতে হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কম।সেই থেকেই এই ডায়েট পদ্ধতি কীভাবে হৃদরোগ, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা, ক্যান্সার, টাইপ টু ডায়াবেটিস,অ্যালজাইমার, পারকিনসন রোগ এবং স্মৃতিভ্রংশের মত রোগগুলির ঝুঁকি কমিয়ে দেয় তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।

এই ডায়েটের মূল বিষয় হল -

• প্রতিদিনের খাবারে শাকসবজি, ফল,লেবু, গোটা শস্য,বাদাম, ভেষজ উদ্ভিদ,মশলা এবং অলিভ ওয়লের মত অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বেশি থাকা প্রয়োজন
• পরিমিত পরিমাণে মাছ, মাংস,ডিম, দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া উচিত।সাথে রেড মিটও সামান্য পরিমাণে খেতে পারেন।
• পরিমিত মাত্রায় অ্যালকোহল পান। এক্ষেত্রে কোনো অনুষ্ঠানে রেড ওয়াইন এক গ্লাস পরিমাণে খেতে পারেন।
• রিফাইনড শস্য, শর্করা এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস এড়িয়ে চলুন।

মেডিটেরেনিয়ন ডায়েটের উপকারিতা :

ক্যারোলিন উইলিয়ামস, একজন মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট গবেষকের কথায়, ভূমধ্যসাগরের নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাকারী মানুষেরা পৃথিবীর অন্যতম স্বাস্থ্যবান মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। গবেষণায় উঠে এসেছে এর প্রকৃত কারণ হল এই অঞ্চলের মানুষ মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট পদ্ধতি মেনে খাবার খান '।

আরও পড়ুন-অত্যধিক মদ্যপানে ঠিক কতটা ক্ষতি লিভারের, উপসর্গ জেনে সতর্ক হোন

অন্য আরেকটি পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, নিবিড়ভাবে এই ডায়েট পদ্ধতি মেনে চললে তা তাৎপর্যপূর্ণভাবে সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করে। যারা এই পদ্ধতিতে খাদ্যগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে ৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে হৃদরোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও ক্যান্সারে আক্রান্ত বা মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ৬% এবং পারকিনসন ও অ্যালজাইমার রোগের পরিমাণ ১৩% কমে গেছে।
গবেষণা আরও প্রমাণ করেছে যে এই ডায়েট পদ্ধতি অনুসরণ করলে দেহে কোলেস্টরল, ব্লাড প্রেসার ও সুগারের মত রোগগুলিতে ইতিবাচক সাড়া মেলে।সাথে ভালো স্মৃতিশক্তি ও ঘুম হয়। এই গবেষণারই অন্য একটি অংশে উল্লেখ করা হয়েছে মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট পদ্ধতিকে দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

কতখানি উপকারী মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট?

ডায়েট শব্দটি কানে শুনলেই অনেকের মনে আসে খাবার বর্জন, সীমিত আহার গ্রহণ এবং স্বাদহীন কিছু খাবারের কথা।কিন্তু এখন অনেক ধরনের সুস্বাদু খাবার খেয়েও ডায়েট প্ল্যান করা সম্ভব। মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট তেমনই একধরনের ডায়েট পদ্ধতি।তাই খুব সহজেই প্রতিদিনের জীবনযাপনের অংশ করে তুলতে পারেন এই ডায়েটকে।
গবেষণা বলছে, পৃথিবীর বুকে যে পাঁচটি অঞ্চলের মানুষ ভালোভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন তার মধ্যে দুটি অঞ্চলের মানুষই এই পদ্ধতি মেনে খাবার খান। সারডিনিয়া, ইটালি, গ্রিসের মত দেশের মানুষের ওপর এই গবেষণা করা হয়। তাতে আরও দেখা যায়, এখানকার মানুষেরা এই ডায়েটের পাশাপাশি জীবনের কিছু গভীর উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচেন। পরিবার ও নিজের জাতির মানুষের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন এবং জীবনে চাপ কমানোর জন্য কিছু অভ্যাস মেনে চলেন। সাথে রয়েছে হাঁটাচলা যা তাঁদের দীর্ঘায়ু পেতে সাহায্য করে ।

কী কী খাবার খাবেন?

শাকসবজি-
শুধুমাত্র কোনও একটি খাবার থেকে সব রকম পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব নয়। তাই মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট পদ্ধতি মেনে খাবার খেলে বিভিন্ন রকম শাকসবজি খান। এটি মূলত উদ্ভিদ ভিত্তিক একপ্রকার ডায়েট পদ্ধতি।প্রতিবারের খাবারের সাথেই সবজি রাখুন। মেডিটেরেনিয়ন ডায়েট পদ্ধতির গোড়ার কথাই হল এতে বিভিন্ন ধরনের রঙিন শাকসবজি থাকতে হবে।

যেসব শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে যা ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে ,পুষ্টি জোগায় এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে সেগুলি খান। গাজর, ব্রকলি, শসা, বাঁধাকপি, পেয়াঁজ, মটর, কুমড়ো, মূলা, মিষ্টি আলু,শালগম, পালং শাক রাখতে পারেন ডায়েটে।

তাজা ফল-

এই ডায়েট পদ্ধতির অন্য একটি প্রধান উপাদান হল তাজা ফল। সারাদিনে অন্তত তিনবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইবার এবং বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন এবং খনিজ সরবরাহ করে এমন ফল খান। আপেল, অ্যাভোকাডো, লেবু , চেরি, স্ট্রবেরি, তরমুজ, আঙুর- এই ফলগুলি রাখতে পারেন খাবারের তালিকায়।

এক্ষেত্রে ফলে উপস্থিত সুগার আপনার দেহে শক্তি সরবরাহ করবে এবং ফাইবার দেহের মেটাবলিক রেট কম করবে এবং রক্তে শর্করার মাত্রাও  বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

লেগুম বা শুঁটি জাতীয় শস্য

এই ধরনের খাবার একাধিক পুষ্টি উপাদান যোগায় দেহে। তাই প্রতিবারের খাবারে এই উদ্ভিদজাত উপাদানটি রাখা উচিত।অল্প খরচে ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়ামের মত প্রয়োজনের উপাদান রয়েছে এই ধরনের খাবারে।

গোটা দানাশস্য

গোটা দানাশস্য সবথেকে কম প্রক্রিয়াজাত খাদ্যগুলির অন্যতম। বার্লি,বাজরা,ওটস এবং ব্রাউন রাইস রাখতে পারেন প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। লেগুমের মতোই গোটা দানাশস্যে কপার, জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়ামের মত থাকায় তা টাইপ- টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমায়।

• বহু শতাব্দী ধরে ভেষজ উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন মশলা তাদের ঔষধি গুণের জন্য ব্যবহার করা হয়। দারুচিনি, রসুন,আদা ও হলুদ খাবারের মধ্যে রাখতে পারেন।

•এছাড়াও, তুলসী, তেজপাতা, লবঙ্গ, জিরা, মৌরি, ল্যাভেন্ডার, পুদিনা, ওরিগানো, পার্সলে, গোলমরিচ, রোজমেরি এবং থাইমের মতো তাজা ভেষজগুলি মেডিটেরেনিয়ন ডায়েটে তাজা, স্বাদযুক্ত খাবার তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়।

• বাড়িতে ঘরোয়া পদ্ধতিতে টক দই, পনির বানিয়েও খেতে পারেন যাতে প্রোটিন থাকে।তবে ভুলেও দোকানের মিষ্টি দই খাবেন না এই ডায়েটে।

কী ভাবে শুরু করবেন এই ডায়েটে?

পুষ্টিবিশারদের মতে, এই ডায়েট পদ্ধতি যেহেতু উদ্ভিদভিত্তিক তাই খাবারের তালিকায় ৭৫% শতাংশ শাকসবজি রাখতে হবে। বাকি ২৫% এর মধ্যে দই,মাছ , মুরগি, ডিম রাখতে পারেন।

More Articles