সাধারণ পেটের সমস্যা না কি...? বিপদ এড়াতে সতর্ক হোন আজই

ভারতে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা আবার বাড়ছে হু হু করে। এবারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কোভিডাক্রান্ত রোগীদের মধ্যে কোভিডের লক্ষণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে ডায়রিয়া।

দিল্লির অ্যাপোলো হসপিটালের রেস্পিরেটরি মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসক, ড. নিখিল মোদির মতে দিল্লির কুড়ি শতাংশ কোভিড রোগীর মধ্যেই সাম্প্রতিককালে ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

কোভিডের অন্যান্য লক্ষণ, যেমন কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিঃশ্বাসে সমস্যা বা জ্বরের মতো সমস্যা নেই অনেক কোভিড রোগীর মধ্যে, কিন্তু শুধুমাত্র ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ফলে বহু রোগীই স্রেফ ডায়রিয়া ভেবে কোভিড পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আবার অনেকের ক্ষেত্রেই প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে ডায়রিয়া দেখা দিলেও, পরবর্তীকালে জ্বর, সর্দি, কাশি বা শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে কোভিডের তথাকথিত সমস্যার পাশাপাশি ডায়রিয়ার ঘটনাও দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: করোনার XE সাব-ভ্যারিয়েন্ট কী? কতটা ক্ষতিকর ভাইরাসের এই নতুন রূপ?

মুম্বইয়ের চিকিৎসক সিদ্ধার্থ ললিতকুমারের মতে, ওমিক্রনের সাব-ভ্যারিয়েন্টগুলি এবার পেটের সমস্যার কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে কোভিড রোগীদের মধ্যে ডায়রিয়ায় ভোগার প্রবণতা কি আগে দেখা যায়নি? কোভিড অতিমারী শুরু হওয়ার প্রাক্কাল থেকেই বহু রোগী এই সমস্যার শিকার হয়েছেন, বাদ যায়নি শিশুরাও। তবে এইবারে সেই সংখ্যা এতই বেশি যে, গত এপ্রিলে ন্যাশানাল হেলথ সার্ভিস অবশেষে ডায়রিয়াকে কোভিডের অন্যতম লক্ষণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করল।

কিন্তু কোভিডের জন্য ডায়রিয়া! এ-ও কি সম্ভব? তাহলে খাদ্যনালীতেও নভেল করোনাভাইরাসের প্রবেশ করতে পারে কী?

প্রথমেই জানতে হবে, কোভিডের জন্য দায়ী নভেল করোনাভাইরাস বা সার্স-কোভ-২ কী আমাদের দেহকোশে কীভাবে প্রবেশ করে।

ফুসফুসের কোশের প্রাচীরে উপস্থিত ACE-2 রিসেপ্টর দিয়েই মূলত আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে নভেল করোনাভাইরাস। সোজা কথায়, রিসেপ্টর হল প্রোটিন-নির্মিত কিছু দরজা, যা ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও একাধিক রাসায়নিক পদার্থ কোশের ভেতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। ACE-2 রিসেপ্টর বা অ্যাঞ্জিওস্টেনিন কনভার্টিং এনজা়ইম-2 রিসেপ্টরের সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের বাইরে উপস্থিত কাঁটার মতো দেখতে অংশটির রাসায়নিক আদান-প্রদানের ফলেই কোশের ভেতর ভাইরাসের প্রবেশের দরজা অর্থাৎ রিসেপ্টরটি খুলে যায়। এই কাঁটার মতো দেখতে অংশটিকে বলে স্পাইক প্রোটিন।

দ্য হিউম্যান প্রোটিন অ্যাটলাস নামক ওয়েবসাইটটি থেকে জানা যাচ্ছে, ACE-2 রিসেপ্টর কেবল যে ফুসফুসের কোশেই আছে, এমনটা কিন্তু নয়। তার উপস্থিতি রয়েছে আমাদের খাদ্যনালীতে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে খাদ্যনালীর  ক্ষুদ্রান্ত্র এবং মলাশয় অংশে এই রিসেপ্টরের অবস্থান নজরে এসেছে। শুধু এসি ই-২ রিসেপ্টরই নয়, নভেল করোনাভাইরাস প্রবেশ করতে পারে  ট্রান্সমেমব্রেন প্রোটিয়েজ় সেরিন টাইপ ২ নামক আরও একটি রিসেপ্টরের দরজা দিয়ে। এবং এটিও দেখা যাচ্ছে ক্ষুদ্রান্ত্র, মলাশয়, এমনকী পাকস্থলীতে উপস্থিত কোশে।

এই দুই রিসেপ্টরের খাদ্যনালীতেও উপস্থিত থাকার ঘটনাকে মাথায় রেখে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো এবং ইউহান ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ধারণা করছেন, এই রিসেপ্টরের পথ ধরে এই ভাইরাস আমাদের খাদ্যনালীর কোশে প্রবেশ করতে পারে।

খাদ্যনালীতে প্রবেশ করার আগে মুখগহ্বরের মাধ্যমে ভাইরাস প্রবেশ করেছে মুখের ভেতর। থুতু, লালারসের মাধ্যমে নভেল করোনাভাইরাস মুখে প্রবেশ করলেও, মলের মাধ্যমে এর সংক্রমণ ঘটতে পারে, এরকমও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই গবেষকরা।

আমেরিকান জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিতে ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যার কোভিড রোগীদের মলে নভেল করোনাভাইরাসের জিন পাওয়া গেছে। এবং এঁদের মধ্যে প্রত্যেকেরই কোভিডের লক্ষণ হিসেবে ডায়রিয়াও দেখা গিয়েছিল। এই গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা মল এবং মুখগহ্বরের মাধ্যমে কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন ২০২০ সালেই।

ডায়রিয়ার পেছনে কি আমাদের দেহের রোগ-প্রতিরোধী কোশেরও হাত থাকতে পারে?

শরীরে বাইরে থেকে সামান্য কিছু প্রবেশ করলেই, শত্রু ভেবে তাকে প্রতিহত করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে আমাদের রোগ-প্রতিরোধী কোশগুলি। ভাইরাস প্রবেশ করলে তার ব্যতিক্রম ঘটে না। ভাইরাস প্রবেশ করলে আমাদের রোগ-প্রতিরোধী কোশ বা ইমিউন সেলগুলো সাইটোকাইন নামের ছোট-ছোট প্রোটিনের অণু তৈরি করে। সেগুলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করলেও, দেহের বিভিন্ন কোশকে নষ্ট করে।

শুধু তাই নয়, সাইটোকাইন কাজ শুরু করলে জ্বর, গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথা, ফুসকুড়ি বেরোনো বা শরীরের একাধিক জায়গা লাল হয়ে যায়। একে বলে সাইটোকাইনের ইনফ্ল্যামেটরি এফেক্ট বা প্রদাহজনিত ফলাফল।

কোভিডের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হল ইনফ্ল্যামেশন। গবেষকদের মতে, খাদ্যনালীতে, বিশেষ করে ক্ষুদ্রান্ত্রে, ইনফ্ল্যামেশনের ফলে ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

২০২০ সালের একাধিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, ডায়রিয়ার পাশাপাশি বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব, ক্ষুধামান্দ্য এবং পেটে ব্যথার সমস্যাতেও ভুগছেন বহু কোভিড রোগী।

ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, কোভিডের ফলে লিম্ফোসাইটিক কোলাইটিসের মতো ঘটনাও দেখা দিয়েছে। এই গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন ইউনিভারর্সিটি হসপিট্যালস বার্মিংহ্যাম এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের গবেষকরা। এই অসুখের কারণে পেটে প্রদাহজনিত সমস্যা দেখা দেয়, সঙ্গে দেখা যায় ডায়রিয়া ও পেটের তীব্র যন্ত্রণা।

প্রতিকার কী?

ডায়রিয়া যেহেতু কোভিডের কারণেই হচ্ছে, তাই কোভিড প্রতিরোধের জন্য যা যা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, প্রাথমিকভাবে তা-ই করতে হবে। কোভিডজনিত কারণে ডায়রিয়া দেখা গেলে, ভাইরাস-প্রতিরোধী চিকিৎসা আরম্ভ হলেই শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়, এমনটাই গবেষণায় দেখা গিয়েছে।

যাদের মধ্যে পেটের সমস্যা লেগেই থাকে, তাদের বর্তমানে সাবধানতা অবলম্বন করতে হতে পারে, যেহেতু ভারতে সাম্প্রতিককালে কোভিডের হার আবার বাড়ছে, আর লক্ষণ হিসেবে ডায়রিয়া দেখা যাচ্ছে। তাই শারীরিক জটিলতা কমাতে তাঁদের ক্ষেত্রে সহজপাচ্য খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা।

 

More Articles