টুইন টাওয়ারের জায়গায় এবার রামমন্দির?

Noida Twin Tower: বাসিন্দারা ওই জায়গায় স্কুল বা হাসপাতাল তৈরির কথা ভাবলেন না কেন? এর পেছনে অন্য কোনও রাজনীতি কাজ করছে না তো? যে রাজনীতির নাম মন্দির রাজনীতি।

মাত্র ৯ সেকেন্ড। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল নয়ডার টুইন টাওয়ার। দুপুরের খাওয়া সেরে রবিবাসরীয় দিবানিদ্রার প্রস্তুতি নয়, এদিন দুপুরটা কেটেছিল অন্যভাবে। একরাশ কৌতূহল নিয়ে জোড়া জোড়া চোখ নিবিষ্ট হয়েছিল টিভির পর্দায়। রিমোটে আঙুলের আলতো চাপ। একটা বিস্ফোরণ। চোখের নিমেষে ধুলোয় মিশে গেল ১০০ মিটারের বেশি লম্বা টুইন টাওয়ার। মাত্র ৯ সেকেন্ডে সব শেষ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নয়ডায় এভাবেই ভেঙে ফেলা হয়েছে বেআইনিভাবে তৈরি ৪০ তল বিশিষ্ট যমজ বহুতল। তারপর থেকেই আমজনতার মনে প্রশ্ন ছিল, তাহলে টুইন টাওয়ারের বিশাল জায়গা এবার কোন কাজে লাগানো হবে? জানা গিয়েছে, ওই বিশাল এলাকায় এবার রামমন্দির বানানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মন্দির সংলগ্ন এলাকায় বাচ্চাদের খেলার জন্য পার্কও বানানো হতে পারে।

অযোধ্যার বুকে তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। বারবার এই রাম জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। আর তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বিজেপি। একসময়ে লালকৃষ্ণ আদবানিরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার উত্তরাধিকার নিপুণভাবে বহন করছেন আজকের মোদি, যোগীরা। ফলে অযোধ্যায় রামমন্দির হচ্ছে। এতে তো বিজেপির জয়ের আনন্দ পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এরপরে আবার মন্দির এবং তাতে রামলালাকে স্থাপনের প্রয়োজন ছিল কি? দেশ কি তাহলে মন্দিরময় হয়ে উঠবে?

টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার পরে ওই জায়াগাটি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে সেপ্টেম্বরের গোড়াতে একটি বৈঠকে বসেন ওই হাউজিংয়ের বাসিন্দারা। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ফের নতুন করে আবাসন গড়ে তোলা হতে পারে। তবে তার জন্য আদালতের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। সেখানেই প্রস্তাব দেওয়া হয়, বিশাল বড় একটি মন্দির গড়ে তোলা যেতে পারে। সেখানে মূলত রামলালা এবং শিবের মূর্তি রাখা হবে। তাছাড়াও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তিও রাখা হতে পারে।

আরও পড়ুন- আজীবন ঝর্না কলমের চরম বিরোধী মহাত্মা গান্ধী, যে কথা মনে রাখেনি কেউ

পরিবেশ সচেতনতার বার্তা দিতে বিশাল একটি পার্ক তৈরি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা রাখা হবে। তাছাড়াও সাধারণ মানুষ সবুজের সমারোহে যেন কিছুটা সময় কাটাতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা হবে। জানা গিয়েছে, মন্দির এবং পার্ক বানানোর প্রস্তাবে এলাকার বাসিন্দারা সকলেই সহমত পোষণ করেছেন। ওই জমির মালিকানা এখনও নির্মাণ সংস্থা সুপারটেকের হাতেই রয়েছে। হাউজিংয়ের বাসিন্দারা টাওয়ার ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে কী তৈরি হবে, তার সিদ্ধান্ত নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়। বাসিন্দারা ওই জায়গায় স্কুল বা হাসপাতাল তৈরির কথা ভাবলেন না কেন? এর পেছনে অন্য কোনও রাজনীতি কাজ করছে না তো? যে রাজনীতির নাম মন্দির রাজনীতি।

কেন ভাঙা হয় টুইন টাওয়ার?

নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি নয়ডার বহুতল। আবাসন আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্ট বহু কোটি টাকার এই টাওয়ার ভাঙার নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভাঙা হয় নয়ডার কোটি টাকার টুইন আবাসন। নয়ডার এমারেল্ড কোর্ট প্রজেক্ট এলাকায় এই বহুতল সুপারটেক বিল্ডিং নামে পরিচিত। বহুতল নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের জেরে আগামী তিন মাসের মধ্যে এই নির্মীয়মাণ বহুতল ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত (সুপ্রিম কোর্ট গত বছর এই রায় দেয়)। পাশাপাশি ১২% সুদ-সহ গোটা টাকা সেই বহুতলে ফ্ল্যাট বুকিং করা গ্রাহকদের ফেরত দিতে নির্দেশ দেন বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছিল, “নয়ডা কতৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আগামী ৩ মাসের মধ্যে এই ভাঙার কাজ শুরু করতে হবে। তাদের পরামর্শদাতা হিসেবে থাকবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। গোটা প্রক্রিয়ার খরচ বহন করবে সুপারটেক সংস্থা।”

সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, নয়ডা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে সুপারটেক সংস্থা এই বহুতল নির্মাণ করছে। ৪০ তলার এই বহুতলে ৯১৫টি ফ্ল্যাট এবং দোকানঘর রয়েছে। কিন্তু অবৈধ এই নির্মাণ নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সঠিক। তাই হাইকোর্টের বহুতল ভাঙার রায়কেই কার্যকর রাখে সুপ্রিম কোর্ট।

আরও পড়ুন- ‘সংখ‍্যালঘুরা আজও শাসকের কাছে শুধুই ভোটব‍্যাঙ্ক’: নৌশাদ সিদ্দিকি

চলতি বছরেই এই নির্মাণের বিরোধিতা করে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম অভিযোগ, “বিল্ডিং প্ল্যান গ্রাহকদের হাতে তুলে না দেওয়া।” বারবার প্ল্যান চাইলেও গড়িমসি করে সেই আবেদন খারিজ করেছে সুপারটেক কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি নানাভাবে পরিবেশ এবং আবাসন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগেও মামলা দায়ের হয়েছে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে। যে অট্টালিকার গায়ে অবৈধ তকমা, যে অট্টালিকা আবাসন আইন মানেনি, সেই অট্টালিকা নয়ডার বুকে মাথা তুলে আকাশ স্পর্শ করলেও, তাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে কসুর করেনি সুপ্রিম কোর্ট।

রাম লালার সঙ্গে বিজেপির যোগ নিবিড়। তবে এখানে হাউজিংয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে বিজেপির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ আছে কিনা তা জানা নেই। তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এলাকায় হাসপাতাল বা স্কুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না হাউজিংয়ের বাসিন্দারা? তাঁদের কাছেও বড় হয়ে দাঁড়াল মন্দিরই? ধর্মের আস্তরণ নয়ডার আকাশ ছেয়ে ফেলার পেছনে আসল কারণটা কী?

বিজেপি উন্নয়নের কথা বললেও মন্দির রাজনীতি ছাড়তে পারেনি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগেই নিজেদের ইস্তেহারে রামমন্দির তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শুরু হয়েছে সেই মন্দির নির্মাণের কাজ। সেই কাজ শেষ হতে ২০২৫। কিন্তু ২০২৪ সালে লোকসভা ভোটের আগেই পুণ্যার্থীদের জন্য মন্দিরের একাংশ খুলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সেখানে তাঁরা পুজার্চনা সারতে পারবেন। এমনটাই জানিয়েছেন রামমন্দির ট্রাস্টের সাধারণ সচিব চম্পত রাই। অযোধ্যার বুকে তৈরি হওয়া রামমন্দির বিজেপির তুরুপের তাস। বিজেপির রাজনীতি মানে খোল, করতাল, গোমাতা এবং অবশ্যই রামলালা। মোদি জানেন, নতুন ভারত কাজ চায়। হিন্দুত্বে এই ভারতের মন ভিজবে না। তাই বারবার উন্নয়নের কথা বলতে হয় বিজেপিকে। কিন্তু নয়ডা কেন রামলালাতে আত্মসমর্পণ করতে চলেছে?

More Articles