আজীবন ঝর্না কলমের চরম বিরোধী মহাত্মা গান্ধী, যে কথা মনে রাখেনি কেউ
Mahatma Gandhi: ১৯৪৭ সালেই ছাত্রদের ঝর্না কলমের দামের প্রসঙ্গে বলছেন, প্রায় পঞ্চাশ টাকা। এখনকার মূল্যে প্রায় পনেরো হাজার টাকা।
আজকাল ঝর্না কলম কেউই আর ব্যবহার করেন না। বর্তমান প্রজন্ম ডট এবং জেলের যুগ পেরিয়ে এসে ঠেকেছে ইউজ অ্যান্ড থ্রো-তে। একমাত্র উপহারের ক্ষেত্রটিতেই টিকে গিয়েছে ঝর্না কলম। ফলে সব নামীদামী ব্র্যান্ড। আবার তা যদি হয় লিমিটেড এডিশন, তাহলে দাম আশি হাজার থেকে লাখ টাকার উপরেও হতে পারে। সেসব সাধারণত কেউ ব্যবহার করেন না, প্রায় অলংকারই বলা চলে। মন্টব্ল্যাঙ্ক, পেলিকান, ডেল্টা, ক্যারাঁ দি'এক বা অরোরা ব্র্যান্ড এমন কিছু কলম আজও তৈরি করে থাকে।
এই কিছুদিন আগেই মন্টব্ল্যাঙ্ক তাদের একটি বিশেষ সংস্করণের ঝর্না কলমের নাম দিয়েছিল গান্ধী কলম। তা নিয়ে মামলা টামলা হয়ে একাকার কাণ্ড। প্রশ্ন উঠেছিল, যে মানুষটা আজীবন দরিদ্রদের জন্য দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়ে গেলেন, আজ এক বিলাসদ্রব্যের সঙ্গে তাঁর নাম জুড়ে দিলেই হল? কেরল হাইকোর্টে জোর সওয়াল। তিন হাজারটি পেনের একটি বিশেষ সংস্করণ। সিলভার এবং গোল্ড, সঙ্গে গান্ধীর ২৪১ মাইল ডাণ্ডি মার্চের ভিত্তিতে লিমিটেড এডিশন ২৪১—তাতে মোট ২৪১টি কলম তৈরি করেছিল কোম্পানি। সাকুল্যে দু'টি সংস্করণ। তাই নিয়েই গোল বাধে। কারণ দু'টি সংস্করণের নিবেই গান্ধীর ছবি খোদাই করা ছিল। আইনত গান্ধীর মুখ যেখানে সেখানে ব্যবহার করা যায় না। লাখ টাকার কলমে তো যায়ই না। এর ভিত্তিতেই মামলা হয়। কিন্তু জানেন কি, গান্ধী স্বয়ং ঝর্না কলম একেবারেই পছন্দ করতেন না? আজীবন ঝর্না কলমের বিরুদ্ধে রীতিমতো লড়াই চালিয়ে গেছেন গান্ধী। বরং খাগের কলম ছিল তাঁর প্রিয়। বারবার দোয়াতে ডুবিয়ে লেখাতেই ছিল তাঁর তৃপ্তি। নিজে তো ব্যবহার করতেনই না, উপরন্তু পরিচিত সবাইকে রীতিমতো বারণ করতেন। গুচ্ছের চিঠিতে এই বয়ান পাওয়া যায়। পরশরাম মেহরোত্রাকে ২০ মার্চ ১৯৩২ চিঠিতে লিখছেন, "মেয়েরা ঝর্না কলম ব্যবহার করবে কেন? বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। আশ্রমের কারোর এ কলম ব্যবহার করা উচিত নয়। এত তাড়া কীসের? ছাত্রদের জন্য এ অভ্যাস ভয়ানক ক্ষতিকর। গুজরাতিতেই লিখুক, কী হিন্দি, কী উর্দু—খাগের কলমের ওপর আর কলম নেই।"
আরও পড়ুন-বিজেপির গান্ধী-মুক্ত ভারতের কৌশল না কি মোদি আমলেই যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন নেতাজি!
সেই বছরেই মে মাসে মীরাবেনকে লিখছেন, "ঝর্না কলম যদি না ব্যবহার করো, খুশি হব।" ১৭ এপ্রিল, অমৃত কউরকে লেখা চিঠিতে পাচ্ছি, "খাগের কলম যে এই বারবার দোয়াতে ডোবাতে হয়, এ একটা ভালো দিক। এতে ক্লান্তি আসে না। ঝর্না কলম সময় বাঁচায় বলেই তা খুব ভালো, তা নয়। গ্রামে তৈরি খাগের কলম এবং কালি অবশ্যই অনেক বেশি উন্নতি ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু তার জন্যে তোমার আমার মতো লোককে এ জিনিস ব্যবহার করতে হবে।" পরের বছর অক্টোবরে লীলাবতী অসরকে লিখছেন, "মহাদেবের মতো হতে যেও না। ওর ঝর্না কলমের উৎপাত সহ্য করি কারণ ও লেখক। তুমি তো আর লেখক নও, হবেও না কোনও দিন। কাজেই তোমার ওসব কলমের ব্যবহার কিন্তু আমি মোটেই সহ্য করব না।" তখনও তেজ রয়েছে। কিন্তু এক দশকের মধ্যে ধীরে ধীরে গান্ধীকে ব্রাত্য করে ফেলবে কংগ্রেস। তার ছাপ আমরা পরবর্তী লেখাপত্তরে দেখব। ৪৭-এর জুলাই মাসে একটি শিশুকে লিখছেন, "পেন্সিল বা ঝর্না কলমে এই যে লিখতে এত ভালোবাসো, এই শখটি তোমায় ছাড়তে হবে। হাতের লেখা যদি ভালো করতে চাও, খাগের কলম ব্যবহার করো। এদেশে সব ছাত্রের কি সে ক্ষমতা আছে যে তারা ঝর্না কলম ব্যবহার করবে? নিশ্চয়ই জানো, এক একটা কলমের কী ভীষণ দাম। আমি যদি মাস্টার হতুম, ক্লাসে ও জিনিস আনাই নিষিদ্ধ করে দিতুম। কিন্তু আমার কণ্ঠ তার জোর হারিয়েছে। বড় একা। আমার কথা আজকাল কেউ শোনে না। তোমার বন্ধুরা যদি তোমার কথা শোনে, তাদের বোলো, যত পারে খাগের কলম ব্যবহার করুক।" পার্থক্যটা লক্ষণীয়। আগের দাপট এ সময় ম্রিয়মান হয়ে এসেছে। দলের মধ্যেই গান্ধী ক্রমে হয়ে পড়ছেন অপাংক্তেয়। সেই হতাশা ফুটে উঠছে কলমেও।
এবার প্রশ্ন ওঠে কেন? কেন এই আধুনিক প্রযুক্তির বিরোধিতা? এভাবে তো প্রযুক্তিকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু সে বিচার করে ফেলার আগে গান্ধীর স্বদেশী চিন্তা সম্বন্ধে একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। একদিকে ঝর্না কলমের দাম ছাত্রদের মধ্যে একটা বিভেদ তৈরি করবে—এই আশঙ্কা তাঁর ছিলই, তার সঙ্গে ছিল গ্রামীণ অর্থনীতি এবং জাতীয় পণ্য ব্যবহারের তাগিদ। এই ভাবনার শিকড় আমরা দেখব ১৯৩৪-এ লেখা তাঁর গ্রামীণ অর্থনীতি সম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধে। লিখছেন, "গাঁয়ে উৎপাদিত সামগ্রী কেনা অত্যন্ত দরকার। হতে পারে রুক্ষ, মোটা দাগের কাজ। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত তাদের কর্মপদ্ধতির শিক্ষা দেওয়া, দক্ষ কারিগর তৈরি করা। বিদেশি বা শহুরে জিনিসের লোভে ওদের তৈরি সামগ্রী যদি পুরোপুরি বর্জন করি, তবে ওরা কোথায় দাঁড়ায়? শহরের বড় বড় কারখানা রয়েছে, তাদের অনেক ক্ষমতা। কিন্তু গ্রামের উৎপাদনকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি যদি সঠিক বলে মনে করি, আমরা মিলের পেপারের বদলে হাতে তৈরি কাগজ কিনতে পারি, খাগের কলম ব্যবহার করতে পারি, যতটা সম্ভব ঝর্না কলম বা কলমদানি এড়িয়ে গাঁয়ে তৈরি কালি ব্যবহার করতে পারি।"
আরও পড়ুন- গান্ধীজির ইচ্ছায় তৈরি হলো স্বদেশি কালি, স্বাধীনতার ৭৫-এ অনুপ্রেরণা হতে পারে সুলেখা
এমনকি প্রয়োজনে যখন নিজেকেও ঝর্না কলম ব্যবহার করতে হয়েছে, সঙ্গে বাক্সবন্দি একটি খাগের কলম রাখতেন গান্ধী। কারণ, যতবার ঝর্না কলম ব্যবহার করবেন, আদর্শের সঙ্গে আপোস করবেন, ততবার যেন অনুতাপ হয়। খাগের কলমের কথা মনে পড়ে। গাঁয়ের মানুষের কথা মনে পড়ে। ১৯৪৭ সালেই ছাত্রদের ঝর্না কলমের দামের প্রসঙ্গে বলছেন, প্রায় পঞ্চাশ টাকা। এখনকার মূল্যে প্রায় পনেরো হাজার টাকা। আপত্তির কারণ ছিল। যুক্তিতে বল ছিল। কিন্তু ওভাবে তো প্রযুক্তিকে আটকানো যায় না। বৃহৎ পুঁজি, খুচরো পুঁজি এবং জমিদার-জোতদারদের যে শাসন ব্যবস্থা ভারতে গড়ে উঠেছিল, (অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় যাকে বলছেন 'সিজারিজম') সে ব্যবস্থায় শহরের শিল্প উৎপাদন ছিল অনিবার্য। ফলে, দলে দলে মানুষ গ্রাম ছেড়ে যেমন শহরে আসতে বাধ্য হন, তেমনি ঝর্না কলম তৈরি করা শুরু করে দেশি কোম্পানিগুলি। দাম কমে। সাধারণের আয়ত্তে আসে সেই কলম। অর্থাৎ দামের প্রসঙ্গে গান্ধীর বিরোধিতার যুক্তি আর ধোপে টেকে না। কিন্তু শহরের কারখানায় প্রস্তুত সেই সব কলম গাঁয়ের অর্থনীতিকে স্বতন্ত্র করে তুলতে আর কোনও ভূমিকা পালন করে না। গান্ধীর সে স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়।