পিজ্জা-বার্গারের খিদে কমবে শরীরচর্চাতেই, হাতেনাতে প্রমাণ গবেষণায়

এই ব্যস্ত ছোটাছুটির জীবনে খাওয়াদাওয়া বেশ কিছু ক্ষেত্রে সারতে হয় বাড়ির বাইরেই। হালকা কিছু অথবা ভাজাভুজিই (যা মোটেও হালকা নয়) এক্ষেত্রে সম্বল। মোটের ওপর সহজে তৈরি খাবার পেয়ে যাওয়ার সুবিধে ইত্যাদি জাঙ্ক ফুডের একটি বিরাট বাজার তৈরি করেছে। অপরদিকে ঘরে থাকলেও চিপস, বার্গার, চিজ বল জাতীয় খাবারের চাহিদা কমে যায় না। বরং সমীক্ষা বলছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে একাকী, উদ্বিগ্ন মানুষ খায় স্বাভাবিক পরিমাণের থেকে বেশি। একে 'স্ট্রেস ইটিং' বলে। বস্তুত, বর্তমান বিজ্ঞান এই খাওয়ার নেশা বা চাহিদাকে ড্রাগের নেশার মতোই দেখে থাকে। ক্যালোরি জমানোর এক ধরনের বিশেষ নেশা সৃষ্টির পিছনে হাত কিন্তু সেই জাঙ্ক ফুডেরই। অথচ দিনের পর দিন এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। পুঁজির দুনিয়ায় কাটতি বেশি এমন দ্রব্যের উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব নয়। কাজেই কীভাবে একে এড়িয়ে চলা যায়, সেই বিষয়ে মানুষেরই সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

দীর্ঘদিন এই নিয়ে নানা রকমের গবেষণা হয়েছে। বর্তমানে দু'টি গবেষণা জাঙ্ক ফুডের বিকল্প খুঁজে পেয়েছে। এবং শুনলে আশ্চর্য হবেন, সেই বিকল্প ক্যালোরি জমানোর সম্পূর্ণ উলটো পথ, ক্যলোরি বার্ন বা ক্যলোরি ঝরানো। এবং তার মাধ্যম কী? এই বিষয়ে একমত দু'টি গবেষণাই। মাধ্যম হল, এক্সারসাইজ। অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা স্নেহজাতীয় খাবারের এই নেশা নিয়ে খুব সম্প্রতি একটি পরীক্ষা চালায় ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি। ২৮টি ইঁদুরকে একটি বিশেষ ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের শেখানো হয়, একটি বিশেষ ধরনের লিভারে চাপ দিলে আলো জ্বলবে এবং একটি আওয়াজ হবে। আলো ও শব্দের পরপরই তাদের প্রচুর ফ্যাটসম্পন্ন খাবার দেওয়া হতে থাকে প্রতিবার। এতে করে ইঁদুরেরা লিভারে চাপ দিয়ে খাবার খেতে চাওয়ার প্রক্রিয়া রপ্ত করে নেয়। এবারে গড়ে কতবার তারা এই লিভার চেপে খাবার আদায়ের চেষ্টা করছে তার একটা পরিসংখ্যান নেওয়া হয়। এরপরে ইঁদুরদের দু'টি দলে ভাগ করা হয়। এক দলকে নিয়ম মেনে তাদের দৈনিক কার্যকলাপ করতে ছাড় দেয় বৈজ্ঞানিকেরা। আরেক দলকে প্রচণ্ড বেগে ট্রেডমিলে দৌড় অভ্যেস করানো হয়। এই তিরিশ দিন প্রচুর ফ্যাটজাতীয় খাবার ইঁদুরগুলিকে দেওয়া হয় না। মাসের শেষে ফুড লিভারটি ফের ফিরিয়ে আনা হয় ইঁদুরের খাঁচার মধ্যে। কিন্তু খাবার এবারেও দেওয়া হয় না। কারা কতবার খাবার চায়, সেটাই ছিল দেখার বিষয়। এতে দেখা যায়, যে ইঁদুরগুলি এক্সারসাইজ করেনি, তারা লিভারে চাপ দিল, অর্থাৎ সেই জাঙ্ক ফুড খেতে চাইল অনেক বেশি। তুলনামূলকভাবে যেসব ইঁদুর ছোটা প্র্যাকটিস করেছিল, তারা সেভাবে খেতে চাইল না। গবেষকরা এর থেকে অনুমান করছেন, এক্সারসাইজ দ্বারা জাঙ্ক ফুড ক্রেভিং বা জাঙ্ক ফুডের প্রচণ্ড চাহিদা কমানো সম্ভব।

পাশাপাশি ২০১৬ সালে হওয়া একটি গবেষণার কথা বলি। সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই গবেষণা করেছিলেন। বিজ্ঞান ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, ঘুম কম হওয়ার সঙ্গে খাওয়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে। রাতের ঘুম ঠিকমতো না হলে বা অত্যন্ত কম হলে, দেখা গিয়েছে, অতিরিক্ত মিষ্টি বা স্নেহজাতীয় খাবার খাওয়ার একটা ঝোঁক দেখা যায় মানুষের মধ্যে। এই ঝোঁক কীসে কাটানো যায়, তাই নিয়ে গবেষণা চলছিল। ঘুম স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওজন কমানোর পরিকল্পনা করার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘুমটাকে হিসেবের মধ্যে রাখতেই ভুলে যায় মানুষ। দীর্ঘদিন স্বাভাবিক মাত্রায় ঘুম না হলে, অর্থাৎ সাত ঘণ্টারও কম ঘুম ব্যপক ওজনবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জাঙ্ক ফুডের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার এটি অন্যতম প্রধান কারণ। সুইডিশ গবেষকদের দলটি কয়েকজন মানুষের ওপর পরীক্ষা চালান। প্রাথমিকভাবে পরীক্ষায় তাদেরই অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হয়, যাদের স্বাস্থ্য বেশ ভালো, এবং এন্ডোক্যানাবাইনোডিসের মাত্রাও স্বভাবিক। এন্ডোক্যানাবাইনোডিস একটি মস্তিষ্কনিঃসৃত রস, যা মানুষের শরীরে অবস্থিত স্নায়বিক রিসেপ্টরগুলিকে জাগিয়ে তোলে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে মানুষের শরীরে এন্ডোক্যানাবাইনোডিসের মাত্রা বাড়ে এবং সেই কারণেই জাঙ্ক ফুড খাওয়ার দিকে প্রবল ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়।

আরও পড়ুন: তাপমাত্রা ৪০ পার! তীব্র তাপপ্রবাহে সুস্থ থাকতে এই খাবারগুলি ভুলেও খাবেন না

গবেষণাগারে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ‘স্বাভাবিক’ সময় ধরে (সাড়ে আট ঘণ্টা) ঘুমোনোর সুযোগ দেওয়া হয় এবং পরীক্ষা করা হয়। এরপরে তিনদিন লাগাতার চার ঘণ্টামাত্র ঘুমোনোর সুযোগ দেওয়া হয়। খাবারদাবার এবং দৈনিক কাজকর্ম দুই ক্ষেত্রেই এক রাখা হয়। বারে বারে রক্ত পরীক্ষা করে এন্ডোক্যানাবাইনোডিসের মাত্রা মাপা হতে থাকে। শেষের দিন স্বল্প পরিসরের প্রচণ্ড এক্সারসাইজ করিয়ে তারপরে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, ঘুমের ঘাটতি ঘটায় রক্তে '২-অ্যারাকিডোনয়েলগ্লিসারল’ বেড়ে গয়েছে প্রচুর, প্রায় ৮০ শতাংশ। মাথা থেকে নিঃসৃত এন্ডোক্যানাবাইনোডিসগুলির মধ্যে এটির ক্ষরণই সব থেকে বেশি। যাই হোক, শেষের দিন ৩৫ মিনিট প্রচণ্ড বেগে এক্সারসাইজ করার পর রক্ত পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, এর মাত্রা কারও ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ, কারও ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশই নেমে গিয়েছে। অর্থাৎ, আবার স্বাভাবিক স্তরে ফিরে গিয়েছে এন্ডোক্যানাবাইনোডিসের মাত্রা। খেলাধুলো, এক্সারসাইজ স্ট্রেস কাটাতে সাহায্য করে বহুল পরিমাণে। স্থায়ী অনিদ্রার রোগে এক্সারসাইজ স্বাভাবিক ঘুমে ফেরার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। যাই হোক, দিনের শেষে দুই দল বিজ্ঞানীই একমত। জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবল আকর্ষণ এড়াতে চাইলে রোজ ভালো করে ঘুমান, এবং এক্সারসাইজ করুন।

 

More Articles