নয়ের দশকের স্কুটার ফিরছে নয়া রূপে, নস্টালজিয়ার পুনর্জন্ম

নেটমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে কেরলের একটি বিশেষ বাজাজ চেতক। ১৯৯৩ সালের একটি পুরনো বাজাজ চেতক স্কুটারের মডেলকে একেবারে ঝাঁ-চকচকে নতুন স্কুটারের আদলে তৈরি করেছেন কেরলের মোটো ভ্লগার ধ্রুব।

করোনাভাইরাস পরবর্তী সময় ভারতীয় যানবাহনের পরিসর অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে বলা চলে। একটা সময় যেখানে ভারতের অধিকাংশ মানুষ বাস অথবা যে কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ ছিলেন, সেখানে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, সকলের প্রথম পছন্দই নিজের কোনও একটি নিজস্ব যান। শহর কিংবা শহরতলি থেকে শুরু করে গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের কাছেও এই মুহূর্তে রয়েছে একটা বাইক অথবা স্কুটার। এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের কাছে স্কুটারের বৈচিত্র‍্য প্রচুর। সস্তা অথচ বেশি মাইলেজবিশিষ্ট স্কুটার চাইলে যেখানে রয়েছে YAMAHA RAY ZR, বা TVS JUPITER; তেমনই কিন্তু আকর্ষণীয় ডিজাইনের ও অধিক ক্ষমতার ইঞ্জিনবিশিষ্ট স্কুটার চাইলে বিকল্প হিসেবে রয়েছে SUZUKI BURGMAN-এর মতো হাইব্রিড স্কুটার কিংবা TVS NTORQ।

তবে নয়ের দশকের সময়টায় এরকম অবস্থা ছিল না। তখন স্কুটার বলতে মাথায় আসত শুধুমাত্র একটি নাম, বাজাজ চেতক। নয়ের দশকে ভারতের অতি সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতেও প্রচলন ছিল এই স্কুটারের। এতটাই জায়গা থাকত যে, স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি খুবই সহজে দুই সন্তানকে নিয়েও চলা যেত একটি স্কুটারের মধ্যে, তাও আবার কোনও সাইডকার ক্যারি না করেই; তার পরও বাকি থাকত কিছুটা বুটস্পেস, যেখানে কিছু ছোটখাটো জিনিস রাখা সম্ভব! মহারানা প্রতাপের ঐতিহাসিক ঘোড়া চেতকের নামে নামাঙ্কিত হলেও এই ভিনটেজ স্কুটারটি তৈরি হয়েছিল মূলত ইতালিয়ান কোম্পানি ভেসপার স্প্রিন্ট নামের একটি ভিনটেজ স্কুটারের আদলে। ৬০ কিলোমিটার প্রতি লিটারের মাইলেজ এবং দামে অত্যন্ত সস্তা হওয়ার কারণে একটা সময় প্রায় প্রত্যেক সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির পরিচিত সদস্য হয়ে উঠেছিল বাজাজের এই জনপ্রিয় স্কুটারটি।

ভারতের বাইক এবং স্কুটারের ইতিহাসে চেতক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় রয়েছে। তবুও লঞ্চের সময় এই স্কুটারকে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই ১০ বছরের ওয়েটিং পিরিয়ডে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল এই স্কুটারের ডিজাইনে। তবে ২ স্ট্রোক ১৫০ সিসি ইঞ্জিন ছিল সেই সময় স্কুটারের জগতে একটা মাইলফলক।

আরও পড়ুন: অ্যাম্বাসাডর ফিরছে ইলেকট্রিক স্কুটার হয়ে! কেমন হতে চলেছে নয়া এই যান?

বর্তমানে অত্যাধুনিক ডিজাইন নিয়ে ইলেকট্রিক স্কুটার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, নয়ের দশকের সেই ঐতিহ্য এখনও অনেকের কাছেই অমলিন। নয়ের দশকের সেই পুরনো বাজাজ চেতককেই নতুনভাবে সামনে নিয়ে এসে তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ভারতীয় স্কুটারের জগতের এই মাইলফলকের গরিমাকে ধরে রেখে পুরনো মডেলে কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসে সেটিকে আবারও ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। পুরনো স্কুটারের ডিজাইনকে অপরিবর্তিত রেখে নতুন ইঞ্জিন এবং নতুন রঙে সাজিয়ে, ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী স্কুটারকে।

এই মুহূর্তে ভারতে বাজাজ চেতকের এরকম একাধিক স্কুটার রয়েছে। তারই মধ্যে নেটমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে কেরলের একটি বিশেষ বাজাজ চেতক। ১৯৯৩ সালের একটি পুরনো বাজাজ চেতক স্কুটারের মডেলকে একেবারে ঝাঁ-চকচকে নতুন স্কুটারের আদলে তৈরি করেছেন কেরলের এই মোটো ভ্লগার ধ্রুব। যখন তিনি এই পুরনো বাজাজ চেতকটিকে নিজের গ্যারেজে নিয়ে আসেন, তখন এটি ছিল একেবারে ভগ্নদশায়। খারাপ হয়ে গিয়েছিল চাকার পিন; সাসপেনশন থেকে শুরু করে গাড়ির অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ, সবকিছুই একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল বলা চলে। সেই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনে এই স্কুটারটিকে আবারও নিজের আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার কাজটা খুব একটা সোজা ছিল না তার পক্ষে।

এই স্কুটারের প্রধান সমস্যা ছিল সাইড প্যানেলের জং এবং উঠে যাওয়া পেন্ট। স্কুটারের প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশকে আলাদা করে কিছু যন্ত্রাংশ পাল্টে সেই জায়গাটা নিল নতুন পার্টস। উজ্জ্বল নীল রঙে পেন্ট করা হলো পুরো স্কুটারের বডি। প্রথম থেকেই এই বাজাজ চেতক স্কুটারের সঙ্গে ড্রাম ব্রেক সেটআপ আসে। সেই কারণে ব্রেকিং সেটআপে কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। তবে চাকার ক্ষেত্রে এসেছে বড় পরিবর্তন। আগেকার বাজাজ চেতক স্কুটারের চাকা সাধারণ নীল রঙে পেন্ট করা থাকত। কিন্তু, এই পরিবর্তিত স্কুটারের চাকা সম্পূর্ণরূপে স্টিল রঙে ক্রোমপ্লেটিং করা। পরিবর্তন করা হয়েছে সামনের সাসপেনশনের ক্ষেত্রেও। সেখানেও দেখা মিলেছে এই ক্রোম কোটিংয়ের কারসাজির। এছাড়াও সামনের চাকার কভারের ওপরেও ব্যবহার করা হয়েছে স্টিল রঙের ক্রোম প্লেটিং।

সামনের মাডগার্ডের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে এই একই ক্রোমপ্লেটিং টেকনোলজি। হেডল্যাম্প থেকে শুরু করে বাজাজ চেতকের পুরনো লোগো, সবকিছুই মুড়ে ফেলা হয়েছে রুপালি ক্রোম প্লেটিংয়ের মাধ্যমে। রেট্রো লুক দেওয়ার জন্য ওআরভিএমে ব্যবহার করা হয়েছে রাউন্ড ইউনিট এবং সেগুলিতেও রুপোলি ক্রোমের ফিনিশিং টাচ দেওয়া হয়েছে। নয়ের দশকের চেতক স্কুটারে ফুটস্ট্যান্ডের ওপর ব্যবহার করা হতো রাবার গ্রিপ, কিন্তু সেই জায়গায় এবার রয়েছে ধাতব পাত। রাবার ম্যাট পাল্টে নতুন মেটাল শিট বসানোর কারণে রেট্রো ফিনিশিং পেয়েছে এই স্কুটারটি। সঙ্গে এই মেটাল শিটের ওপরে রয়েছে একাধিক গ্রিপ, যার ফলে জল পড়লেও ফুট স্ট্যান্ড ঠিকভাবে কাজ করবে। পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু ওয়াটার চ্যানেল, যেখান দিয়ে জমা জল সরে যেতে পারে। এমনকী, একটি স্পেয়ার চাকাও তৈরি করা হয়েছে এবং সেখানেও আছে এই একইরকম ক্রোম ফিনিশিং।

নতুন করে সাজানো হয়েছে সিট সাসপেনশন এবং ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে। পুরনো ইঞ্জিনকে পাল্টে দিয়ে সেই একই স্পেসিফিকেশনে তৈরি হয়েছে নতুন ইঞ্জিন। ক্রোমপ্লেটিং এবং অন্যান্য নতুন যন্ত্রাংশে সম্মিলিতভাবে তৈরি হয়েছে এই নতুন ইঞ্জিন। তবে পাল্টানো হয়নি স্পেসিফিকেশন। এই ইঞ্জিনটি ১৪৫ সিসি ক্ষমতা বিশিষ্ট। ৪ স্পিড ম্যানুয়াল শিফটার এবং লেফট হ্যান্ড গ্রিপ থাকে এই ইঞ্জিনে। ৫৫০০ আরপিএম গতিতে ৭.৫ বিএইচপি পাওয়ার এবং ১০.৮ নিউটন মিটার টর্ক জেনারেট করতে পারে এই ইঞ্জিন। সামনে ১৫০ মিলিমিটার ফ্রন্ট ড্রাম ব্রেক এবং ১৫০ মিলিমিটার রিয়ার ড্রাম ব্রেক থাকছে। এই ইঞ্জিনের সর্বাধিক গতি ৮৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। তবে এই ইঞ্জিনের একটা বড় সমস্যা আছে। এই ইঞ্জিন ২ স্ট্রোকের ইঞ্জিন। এই ধরনের ইঞ্জিন একটু বেশি ধোঁয়া উৎপন্ন করে, তাই এই ইঞ্জিন ভারত সরকারের তরফ থেকে ব্যান করে দেওয়া হয়েছে। এই কারণেই মূলত ২০০৬ সালে এই চেতক স্কুটার তৈরি বন্ধ করতে বাধ্য হয় বাজাজ। তবে স্কুটার তৈরি বন্ধ হলেও এই স্কুটারের জনপ্রিয়তা যে কোনও অংশে কমেছে, সেটা বলা যাবে না। বরং যাঁরা ভারতের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে পছন্দ করেন কিংবা এই ধরনের ভিনটেজ স্কুটার সংগ্রহে রাখার শখ পালন করেন, তাঁদের কাছে এই ১৯৯৩ সালের বাজাজ চেতক যেন এখনও এক অমোঘ আকর্ষণের জিনিস।

 

More Articles