রিকশায় ঘুরেছেন ভারত, কলকাতার সত্যেন দাস স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অনেককে

একটি প্ল্যাকার্ড এবং তার রিকশা। তাতেই তিনি দুনিয়াকে পাল্টানোর স্বপ্ন দেখেন। তার পেট চালানোর একমাত্র সম্বল সেই রিকশা নিয়েই তিনি ঘুরে ফেলেছেন পুরী, লাদাখ, বৈষ্ণোদেবী, দার্জিলিং। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বার্তা, পরিবেশকে রক্...

মালালা ইউসুফজাই বলেছিলেন, "One book, one pen, one child, and one teacher can change the world." আমাদের কলকাতার সত্যেন দাসের সেইটুকুরও প্রয়োজন নেই। একটি প্ল্যাকার্ড এবং তার রিকশা। তাতেই তিনি দুনিয়াকে পাল্টানোর স্বপ্ন দেখেন। তার পেট চালানোর একমাত্র সম্বল সেই রিকশা নিয়েই তিনি ঘুরে ফেলেছেন পুরী, লাদাখ, বৈষ্ণোদেবী, দার্জিলিং। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বার্তা, পরিবেশকে রক্ষা করার।

কিছুদিন আগেই দার্জিলিং ম্যাল রোডে ছিলেন তিনি। নিজের রিকশা নিয়ে। তাতে পৃথিবীকে বাঁচানোর নানা বার্তা দেওয়া। পথচলতি উৎসুক মানুষ তাঁকে দেখছিলেন, অনেকে এসে কথা বলে যাচ্ছিলেন। সাইকেল, বাইক নিয়ে অনেককেই দেখা যায় হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে। রিকশা নিয়েও আগে কেউ করেননি তা নয়, কিন্তু সংখ্যাটা এতটাই কম যে, সহজে চোখে ধরা পড়ে না।

সময়টা ১৯৯৩। তাঁর গ্রামের কিছু বন্ধু পুরী যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। বাজেট ছিল ৪০০ টাকা করে, কিন্তু রিকশা চালিয়ে তাঁর যা উপার্জন হতো, তাতে ৪০০ টাকা দিয়ে পুরী যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিলেন না তিনি সেই সময়ে। সেই সময়ে তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে সাইকেলে করে পুরী যাওয়ার বুদ্ধি দেন। তিনি নিজে কলকাতা থেকে হরিদ্বার সাইকেলে ভ্রমণ করেছিলেন। এমন একজন মানুষের থেকে পরামর্শ পেয়ে সত্যেন আর ভাবেননি। বন্ধুর থেকে সাইকেল ধার করে বেরিয়ে পড়েন এবং আড়াই দিনে পৌঁছে যান পুরী। সেই যাত্রা থেকে আত্মবিশ্বাস পেয়ে ওই বছরই তিনি সাইকেলে দার্জিলিং এবং হরিদ্বার যান।

আরও পড়ুন: অশান্ত কাশ্মীর ভরিয়ে তুলছেন সবুজে, দু’লাখের বেশি গাছ লাগিয়েছেন ‘বৃক্ষমানব’

১৯৯৪-এর ডিসেম্বরে তিনি ভারতভ্রমণে বেরনোর পরিকল্পনা করেন। সঙ্গী বলতে ভারতের ম্যাপ, গাইড বই এই অবশ্যই সাইকেল। সাইকেলের সামনে প্ল্যাকার্ড ঝুলছিল, 'সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ইসাহি, জৈন, সাব এক।'

তিনি উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, পণ্ডিচেরি, কেরল, কর্নাটক, গোয়া, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, সিকিম, আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়, সব ঘুরে ফেলেন। সময় লেগেছিল ৪০৩ দিন।

তারপর কিছুদিন তিনি বিশ্রাম নেন। বিবাহ করেন, কিছুদিন পর তাঁর কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। ২০০৭ সালে তাঁর স্ত্রী মুন্নি এবং কন্যা সুকন্যাকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। এবার গন্তব্য পুরী এবং পরিবার নিয়ে যাত্রা, তাই বাহন রিকশা। সেই রিকশাতেই ২০০৮ সালে বৈষ্ণোদেবী, এবং সেই বছরেই রোটাং পাস, যার জন্য লিমকা বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম ওঠে তাঁর।

তাঁর স্বপ্নের গন্তব্য ছিল লাদাখ। কিন্তু অনেকেই তাঁকে নিরুৎসাহ করেছিলেন, কারণ তাঁদের আশঙ্কা ছিল অত চড়াই রাস্তাতে তিনি রিকশা নিয়ে উঠতে পারবেন না। কিন্তু ২০১৪ সালে তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেন। রাস্তায় তীব্র কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও তিনি লাদাখ পৌঁছে যান।

২০১৮ এবং ২০২১ সালে তিনি আবার লাদাখে ফেরত যান। সিয়াচেনের সেনাছাউনি অবধি পৌঁছে যান তিনি। সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং একজন সেনার শুশ্রুষাতে সুস্থ হন। অনেক কষ্ট করে সেখানে পৌঁছলেও, ওখানকার মানুষ এবং পর্যটকদের থেকে তিনি প্রভূত ভালবাসা পেয়েছিলেন। এমনকী, তাঁর এই লাদাখ ভ্রমণের ওপর একজন তথ্যচিত্রও বানিয়েছেন। নাম 'লাদাখ চলে রিকশাওয়ালা'।

২০১৪ সালে SECMOL বা Students' Educational and Cultural Movement of Ladakh-এর ক্যাম্পাসে তাঁকে আমন্ত্রণ করেন সোনাম ওয়াংচুক, যাঁর অনুপ্রেরণাতে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত সিনেমা 'থ্রি ইডিয়টস'। সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেন সত্যেন এবং ছাত্রদের সঙ্গে বিশ্বশান্তি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে ওঁর সেই রিকশা নিয়ে আর ফেরত আসতে পারেননি তিনি। ওই ক্যাম্পাসেই স্মারক হিসেবে তা রাখা আছে।

সারা দেশ ভ্রমণ করার সময়েই তিনি নিজের পরিবেশপ্রেম উপলব্ধি করেন। দূষিত শহর, এবং পরিচ্ছন্ন গ্রাম- সবই দেখেছেন তিনি। দেখেছেন প্রান্তিক গ্রামগুলিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সেইসব দেখেই তাঁর মনে হয় যে, পরিবেশ রক্ষার বার্তা দেওয়া খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন মানুষকে সচেতন করা।

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। জল সংরক্ষণ করতে বলা, বৃক্ষরোপণ করতে বলা, এইসব বার্তা ছড়িয়ে দিতে থাকেন তিনি। লাদাখ যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে তিনি খেজুরগাছের বীজ নিয়ে বেরোন এবং সেগুলি রোপণ করেন। দার্জিলিং যাওয়ার পথেও তিনি অশোক ফুল গাছের বীজ নিয়ে বেরোন।

তাঁর কন্যা এখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। পিতার মতোই সেও প্রকৃতিপ্রেমী এবং স্নাতকে সে পরিবেশবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়।

প্রত্যেকবারই বেরনোর আগে তাঁর কিছু প্রস্তুতি থাকে। খরচ হিসেব করে নেওয়া, যাত্রাপথ বুঝে নেওয়া, আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণা করে নেওয়া। তবে আলাদা করে শরীরচর্চার প্রয়োজন পড়ে না, তিনি দাবি করেন, তিনি খুবই ফিট। সে দাবি খুবই ন্যায়সংগত। যে মানুষ রিকশা নিয়ে লাদাখ যেতে পারেন, তাঁর কারও থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।

সেই সঙ্গে তিনি রিকশাকে ভালো করে পরীক্ষা করে নেন। সব যন্ত্রাংশ ঠিকমতো চলছে কি না, দেখে নেন। কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তা থেকেই যায়। যেমন, খারাপ আবহাওয়া, চুরি হয়ে যাওয়ার চিন্তা, বন্যপ্রাণীর বিপদ বা যদি কোনওভাবে উচ্চতার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নিজেকে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মে বেঁধেছেন। যেমন, যাত্রাপথে তিনি সব সময় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, এবং তাঁদের পরামর্শমতোই এগোন। তাছাড়া তিনি রাতে ভ্রমণ করেননা।

তবে এতগুলি সফরের খরচ কীভাবে জোগান তিনি?

মাসে দশ থেকে পনেরো হাজার তাঁর রোজগার। সেখান থেকেই তিনি ভ্রমণের জন্য অর্থ বাঁচান। সাধারণত খরচ বলতে খাওয়া এবং থাকা। বেশিরভাগ সময়েই তিনি কোনও স্কুল, ক্লাব, মন্দির, বাস স্ট্যান্ড বা পুলিশ স্টেশনে রাত কাটিয়ে নেন। তাতে অনেকটাই অর্থ সাশ্রয় হয় তাঁর। তবে ওঁর দার্জিলিং সফরের খরচ বহন করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া ক্লাব। আগের সফরগুলিতেও অনেক বাইকার তাঁকে তাঁবু, পোশাক এবং মোবাইল ফোন দিয়ে সাহায্য করেছেন।

আপাতত তিনি ফিরে এসেছেন কলকাতায়। গীতাঞ্জলি মেট্রো স্টেশনের সামনের রিকশা স্ট্যান্ডে গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে। তবে বেশিদিন নয়। মনের ভেতর এখন কেদারনাথ যাওয়ার বাসনা। আগামী বছরেই তিনি বেরিয়ে পড়বেন। সেই সঙ্গে থাকবে পরিবেশ বাঁচানোর বার্তা।

মানুষ সেই বার্তা চোখ দিয়ে দেখতে তো পায়, কিন্তু পড়ে কি? কে জানে!

More Articles