হু হু করে বাড়ছে দুর্ঘটনায় মৃত্যু! পথ সুরক্ষা নিয়ে ঠিক কী ভাবছে সরকার

Road Accidents: পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু এড়াতে কী পদক্ষেপ করছে সরকার?

If tomorrow I tell the press that a gangbanger will get shot, or a truckload of soldiers will be blowing up, nobody panics..because it's all part of the plan. But when I say one little old mayor will die, everybody loses their minds...
-The Dark Knight, 2008

২০২১ সালে পথদুর্ঘটনায় ১,৫৫,৬২২ জনের মৃত্যু হয়েছে ভারতে। তার মধ্যে ২৩,৫৩১ জনের মৃত্যু গাড়িতে বা গাড়ির কারণে। কারও টনক নড়েনি। সরকার এক ইঞ্চিও নড়েচড়ে বসেনি। কোনও নতুন নিয়ম প্রবর্তিত হয়নি। সরকারবাহাদুরের টনক নড়াতে সাইরাস মিস্ত্রিকে প্রাণ হারাতে হলো। টাটা সনস-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর সরকারের মনে হলো, এবার কিছু করা প্রয়োজন। অন্তত দেশের বিত্তবান মানুষ, যাঁরা চার চাকায় যাতায়াত করেন, তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া যাক। কিছু মানুষের তো প্রাণ বাঁচবে। কী সুরক্ষা দিচ্ছেন তাঁরা গাড়ির সওয়ারিদের?

প্রস্তাব এসেছে, গাড়িতে ছ'টি এয়ারব্যাগ থাকা বাধ্যতামূলক করার। যাতে যাত্রীসুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। যদিও গাড়ি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলে তবেই এই এয়ারব্যাগ বেরিয়ে আসে আরোহীদের প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু সেই দুর্ঘটনা কীভাবে এড়ানো যাবে, কীভাবে রাস্তাঘাটকে আরও সুরক্ষিত করা যাবে, তা নিয়ে সরকারের না আছে কোনও দিশা, না পরিকল্পনা। কেন্দ্রীয় পরিবহণমন্ত্রী নীতিন গড়করি টোল ট্যাক্স আদায় করার অত্যাধুনিক উপায় তো বের করে ফেলছেন। কিন্তু নিরপরাধ মানুষ এবং তাঁদের পরিবারের প্রাণ কীভাবে বাঁচবে, সেই নিয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। আপাতত এয়ারব্যাগের সংখ্যা বাড়িয়েই তাঁরা দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন।

 

 

Cyrus Mistry

সাইরাস মিস্ত্রি

তাও সেই রক্ষাকবচ, অর্থাৎ ছ'টি এয়ারব্যাগের নিয়ম চালু হতে এখনও অপেক্ষা করতে হবে এক বছর। এখনই বিত্তবান বা মধ্যবিত্তদের চারচাকা যাত্রা সুরক্ষিত করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিবহণমন্ত্রী এই বছরের ১ অক্টোবরেই বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছিলেন এই নিয়ম। কিন্তু পণ্য উৎপাদন বা আমদানির জটিলতার কারণে তাঁকে পিছিয়ে আসতে হলো বলেই তিনি জানাচ্ছেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ট‍্যুইটারে গড়করি লেখেন, মোটরগাড়িতে যাতায়াত করা সকল যাত্রীর সুরক্ষা নিশ্চিত করাই তাঁর সরকারের অগ্রাধিকার। তাঁর বক্তব্য, আমাদের দেশের গাড়ি উৎপাদকরা বিদেশে যখন গাড়ি রফতানি করছেন তখন ছয়টি এয়ারব্যাগ থাকছে। কিন্তু দেশের বাজারে তা করতে দ্বিধা বোধ করছেন নির্মাতারা। বিশেষ করে ছোট এবং কমদামি গাড়ির নির্মাণের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণটা যদিও সহজেই অনুমেয়। একজন চারচাকা গাড়ির নির্মাতা যখনই ছ'টি এয়ারব্যাগ গাড়িতে লাগবেন, তখনই তার উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে, যার ফলে বাড়বে গাড়ির দামও। একেই গাড়ি বিক্রির সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি উৎসবের মরশুমেও। তার ওপর অতিরিক্ত এয়ারব্যাগ লাগিয়ে অনেকেই ব্যবসায় মন্দা আনতে নারাজ।

আরও পড়ুন: শুধু মাল নদীর হড়পা বান নয়, অতীতেও উৎসবের নামে হুজ্জুতি বদলে গেছে মৃত্যুর বিভীষিকায়

কেন্দ্রীয় পরিবহণমন্ত্রী এখানেই তাঁর উষ্মা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, নির্মাতারা কীভাবে মানুষের প্রাণের আগে অর্থনৈতিক লাভকে রাখতে পারেন। কিন্তু তিনিও তো নতুন পরিবহণমন্ত্রী নন। গত বছর দেশে পথ দুর্ঘটনায় ঘণ্টায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে অনেক মৃত্যু হয়েছে শুধুমাত্র সিটবেল্ট না পরার কারণে। কোথায় সেই সংক্রান্ত নিয়ম? কেন এয়ারব্যাগের সঙ্গে সিটবেল্ট পড়া নিয়ে কড়া আইন প্রণয়ন করছে না কেন্দ্র? এই বিষয়ে নীতিন ট‍্যুইট করছেন না কেন? সাইরাস মিস্ত্রি তো দুর্ঘটনার সময়ে সিটবেল্ট পড়ে ছিলেন না। যেটা তাঁর মৃত্যুর অন‍্যতম কারণ। আসলে সিটবেল্ট নিয়ে নিয়ম আনলে তা নিয়ে কড়া নজরদারি করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় পরিবহণমন্ত্রী কি তাঁর দেশের আইন-রক্ষকদের নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নন?

সেই সঙ্গে এই প্রসঙ্গে সবথেকে বড় প্রশ্ন- গাড়ি কোথাও ধাক্কা মারলে ছ'টি এয়ারব্যাগ খুলে যাবে, কিন্তু গাড়ির চালককে অতিরিক্ত গতিতে চালানো থেকে কে আটকাবে? কোথায় কড়া শাস্তির নিদান? একজন কোটিপতি ব্যবসায়ীর মৃত্যুতে সরকার নতুন নিয়মের কথা ভাবছে। কিন্তু যখন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ চলে যায়? শেষ হয়ে যায় তাঁর গোটা পরিবার? দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ চারচাকা বা বাইকের বেপরোয়া গতির কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রাণ হারাচ্ছেন রাস্তায় থাকা খানাখন্দর জন্যে। নীতিনবাবুর কাছে কি সেইসব খবর পৌঁছয়?

জাতীয় সড়ক, যা নিয়ে নীতিনবাবুর সরকার খুব গর্ব করেন, পরিসংখ্যান বলছে, দেশের পথ দুর্ঘটনার সবথেকে বেশি ঘটে সেখানেই, ৩০.৩%। সবথেকে বেশি মৃত্যুও ঘটে জাতীয় সড়কেই। শুধু ২০২১ সালে ৫৩,৬১৫ জন জাতীয় সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন। তার মধ্যে সিংহভাগ দুর্ঘটনাই ঘটেছে অতিরিক্ত গতির জন্য। কোনও টুইট? কোনও নিয়ম? না, নেই। কেন নেই? কারণ সেই নিয়ম বলবৎ করতে প্রচুর পরিশ্রম, নিষ্ঠা প্রয়োজন। মন্ত্রী যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নন সেই বিষয় বলেই অনুমান করা যায়।

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, দেশের সব মানুষ চারচাকা চড়েন? দেশের সব রাস্তা কি চারচাকার কথা ভেবেই তৈরি? বাকি যাঁরা দেশের রাস্তা ব্যবহার করেন? যাঁরা অন্য যানবাহন ব্যবহার করেন? তাঁদের সুরক্ষা? তাঁদের দোষ কি গাড়ি কেনার যথেষ্ট অর্থ না থাকা? যে দেশের সরকার পথসুরক্ষা বাড়াতে শুধুমাত্র এয়ারব্যাগের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলেন, সেই দেশে আশা খুবই কম। প্রত্যেকের নিজেদের জীবন নিজেদেরই রক্ষা করতে হবে। আমরা রোজ পথে বেরোই। কিন্তু তাঁদের মধ্যে সবাই নিজের গৃহে ফেরেন না। পথ দুর্ঘটনা তাঁর বা তাঁদের প্রাণ কেড়ে নেয়। বড় জোর খবরে কয়েক লাইন বা কয়েক মিনিট। ব্যস, শেষ হয়ে যায় পরিবার। রোজ বেঁচে বাড়ি ফেরাকে মূল্য দিতে শেখা প্রয়োজন। কারণ আমাদের দেশের পথঘাট আজও মৃত্যুফাঁদ।

More Articles