শুধু মাল নদীর হড়পা বান নয়, অতীতেও উৎসবের নামে হুজ্জুতি বদলে গেছে মৃত্যুর বিভীষিকায়
Mal River Flash Flood: নজরুল মঞ্চে সঙ্গীতশিল্পী কেকের মৃত্যুর পরে এই প্রশ্ন উঠেছিল ফের। অপর্যাপ্ত জায়গায়, অপরিমিত বন্দোবস্ত সত্ত্বেও নাছোড়বান্দা জনতার ভিড় সামলানোর পরিকাঠামো না থাকলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না
ভিড়ের মাঝে মৃত্যু নাকি মৃত্যুর মাঝে ভিড়! উৎসবের মাঝে হাহাকার নাকি হাহাকারের মাঝে উৎসব! দায় আমার-আপনার না উৎসবের, এই প্রশ্নের আবহেই চোখে ভাসছে এক হৃদয় বিদারক ছবি। প্রবল জলের তোড়, বেঁচে থাকার শেষ সম্বল হারিয়ে অমৃতলোকে বিলীন হতে হচ্ছে অকালেই। আমরা বলছি, বুধবার অর্থাৎ দশমীর রাতের সেই বিভীষিকার কথা। জলপাইগুড়ির মাল নদীতে তলিয়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনার কথা। যে বিপর্যয়ে ইতিমধ্যেই আহত হয়েছেন একাধিক। প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮ জন। দেবীর বিদায়ে গিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন ওঁরা। উমা ঘরে ফিরলেও নিশ্চিন্তে আশ্রয় খোঁজার সুযোগ পাননি ওই আটটি প্রাণ। ক্ষতিপূরণ ঘোষিত হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য প্রধানরা থেকে শুরু করে ছোট-বড়-মাঝারি রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা বেড়েছে মাল নদীর খাতে। শোকে বিহ্বল হয়েছে রাজ্য। আবার চোখের জল মুছেই সময়ের সঙ্গে জেলায় জেলায় কার্নিভালের দিকে এগিয়ে গিয়েছে সবটা। কেউ কেউ বলছেন, এটাই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়াটাই নিয়ম। কিন্তু! এই ভুলে যাওয়া যদি কম হত, যদি এই ভুলতে ভুলতে মাততে গিয়েই মনে পড়ত ইতিহাস! হারানোর, বেদনার একাধিক ছবি যদি কড়া নেড়ে যেত আবার! তাহলে হয়তো, পুরনো স্মৃতি আর আতঙ্কের আবহে একটু সতর্ক হলেই দুর্দিন দেখতে হত না আর। প্রিয়জন হারানো পরিবারের শোক দেখতে হত না, দেখতে হত না ধর্মের নামে ছেড়ে রাখা প্রশাসনকেও। তাহলে দোষ কি শুধু ধর্মের? উৎসবের? প্রকৃতির? না কি অন্য কিছুর? একাধিক প্রশ্নের অবতারণার মধ্যেই এর দায় কার, সেই বিতর্ককে উহ্য রেখে, এই টানাপোড়েন আর উৎসবের বেলাগাম ভিড় এবং ঠুনকো ব্যবস্থাপনার কিছু করুণ চিত্র তুলে ধরতে পারি আমরা।
১৯৯৯ সাল। কেরলের শবরীমালা মন্দির। যে মন্দিরে ঋতুমতী মহিলার প্রবেশাধিকার থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। এই মন্দিরেই সেদিন বিপুল ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন কমপক্ষে ৫০ জন পুণ্যার্থী। ঈশ্বর-দর্শনে গিয়ে ভিড়ের চাপে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ওঁদের।
এর পরেও শোধরায়নি শবরীমালা। ২০১১ সাল। জানুয়ারি। প্রায় একই রকম ঘটনা। মৃত্যু হয় ১০২ জনের। দেশজুড়ে শোরগোল ফেলে এই ঘটনা। অকালেই প্রাণ হারান শতাধিক।
২০১৩ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। কুম্ভ মেলায় পদপিষ্ট হন বহু পুণ্যার্থী। তার মধ্যে মৃত্যু হয় ১২ জনের। দায়, সেই অতিরিক্ত ভিড় আর অব্যবস্থা!
জুন। ২০১৩। ভারতের বিপর্যয় ইতিহাসে মারাত্মক এক কালো দিন। ১৩ জুন থেকে চলা অতিবৃষ্টি। তারপর ১৬ তারিখ হড়পা বান। মুহূর্তেই শেষ করে দেয় সমগ্র দেবভূমিকে। আচমকা জলের তোড়ে ভেসে যান হাজার হাজার মানুষ। কেদারনাথ তলিয়ে যায় পাথর আর কাদায়। ধ্বংস হয় একের পর এক বাড়ি। হোটেল। রাস্তা। আচমকা বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত প্রশাসন অব্যবস্থার অতলে পৌঁছয় ক্রমশ। ভারতের ধর্মীয় ক্ষেত্রে এই বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলাতে হিমশিম খায় ওই রাজ্যের সরকার। উদ্ধারে নামে সেনা। মৃত্যু ঘটে কয়েক হাজার মানুষের। যার মধ্যে ছিলেন বহু পুণ্যার্থী। কেদারনাথ-চারধাম দর্শনে গিয়ে অমৃতলোকে যেতে হয় প্রায় ৬০০০ মানুষকে। ধ্বংস হয় উত্তরাখণ্ডের একটা বড় অংশ। চিরাবারি হ্রদের সেই ভয়ানক জল ভাসিয়ে দিয়ে যায় সমগ্র এলাকা। আকস্মিক বিপর্যয়ে শেষ হন বহু। সেদিন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দোহাই থাকলেও অব্যবস্থা এবং আগাম সতর্কতা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন।
আরও পড়ুন- রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে! যেভাবে মিথ্যে খবরের জাল ছিঁড়েছেন এই দু’জন
২০১৩-র অক্টোবর। মধ্যপ্রদেশের এক মন্দিরে ১০৯ জনের মৃত্যু ঘটে, অতিরিক্ত ভিড়ের ফলে পদপিষ্ট হয়ে। চূড়ান্ত অসতর্ক মন্দির প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠে সেবারও।
জানুয়ারি। ২০১৪। মুম্বইয়ের এক মুসলিম ধর্মগুরুর প্রয়াণে সমবেত হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে কমপক্ষে মারা যান ১৮ জন।
২০১৫ সাল। জুলাই মাস। অন্ধ্রপ্রদেশের রাজমুন্দ্রি এলাকায় মহাপুষ্কারালু ধর্মীয় উৎসবের ভিড়ে আকস্মিক হুড়োহুড়ি। পায়ের তলায় পিষে মৃত্যু হয় ২৭ জনের।
১৯ অক্টোবর, ২০১৮। ফের ধর্মীয় উৎসবের আবহে নেমে আসে বিভীষিকা। পঞ্জাবের অমৃতসরে দশেরা উৎসবের আয়োজনে ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। রেললাইনে জমায়েতের উপর দিয়ে চলে যায় ট্রেন। প্রাণ যায় ৬০ জনের। আহত হন শতাধিক। আকস্মিক বিপর্যয়ে প্রশ্ন ওঠে সেদিনও।
ডিসেম্বর। ২০১৯। ধর্মীয় উৎসব ঠিক নয় তবুও এমনই এক উৎসবের বেলাগাম ভিড়ে, গোয়ার পঞ্জিমের সানবর্ন উৎসবে মৃত্যু হয় ৩ পর্যটকের।
এপ্রিল, ২০২২। তামিলনাড়ুর অপ্পার স্বামী মন্দিরে দুই শিশু-সহ ১১ জনের মৃত্যু ঘটে ওই মন্দিরেই তড়িদাহত হয়ে।
১২ জুন, ২০২২। এই রাজ্যের পানিহাটিতে তিন জনের মৃত্যু হয়, চিড়ে উৎসবের প্রবল ভিড়ে।
১৯ অগাস্ট, ২০২২। দিল্লির ভিলেপার্লে এলাকায় দহি হান্ডি উৎসবের ভিড়ে আহত হন একাধিক। মারা যান এক ব্যক্তি।
সেপ্টেম্বর। ২০২২। এই রাজ্যের কোচবিহারে জল্পেশ মন্দিরে যাওয়ার পথে গাড়িতেই তড়িদাহত হয়ে মৃত্যু হয় ১০ জনের। প্রশাসনের ভূমিকা এই ঘটনায় না থাকলেও বেলাগাম উৎসবের আমেজ আর ভিড় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
২০২২। সেপ্টেম্বর। মহারাষ্ট্রজুড়ে, গণেশ বিসর্জনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কারণে মৃত্যু হয় ১৯ জনের।
এই দশমীতেই শুধু মাল নদী নয়, এই রাজ্যেই জলে ডুবে মুর্শিদাবাদের সাতুই এলাকায় মৃত্যু হয় দু'জনের।
এই মাসের ৩ তারিখ কেরলের মাল্লাপুরমে এক মহিলার মৃত্যু হয় হড়পা বানে।
সম্প্রতি মেঘভাঙা বৃষ্টি আর বানে উত্তরাখণ্ডের তেহরি এলাকায় মৃত্যু হয় ৪ জনের।
কয়েক দিন আগেই কেদারনাথ যাওয়ার বেস ক্যাম্পে বিপদ ঘটিয়েছে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
একই কারণে হিমাচল প্রদেশের চাম্বাইয়ে মারা গিয়েছেন ৩ জন। উত্তরাখণ্ডের পিথরাগড়ে মৃত্যু হয়েছে ১ জনের।
শুধু এই দেশ নয়, হড়পা বানে এই সেপ্টেম্বর মাসেই ইতালিতে মারা গিয়েছেন ১৬ জন। দশমীর দিন অসমের শোণিতপুরেও হড়পা বানের কবলে পড়েন অনেকেই।
আরও পড়ুন-আজও বিসর্জনে মিলে যায় দুই বাংলা! কেমন ছিল এবারের ইছামতীর ভাসান?
হিমাচল থেকে মধ্যপ্রদেশ। উত্তরাখণ্ড থেকে অসম, বাংলা। সমস্ত জায়গাতেই উৎসব, অতিরিক্ত ভিড়, মৃত্যু এবং উৎসবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ইতিহাস রয়েছে। মাল নদীর এই ঘটনা সেই পুরনো স্মৃতিই তাজা করছে ফের। এখানেই উঠছে প্রশ্ন। বিপর্যয় আকস্মিক, এই দোহাই দিয়েই বারবার মাফ হবে সাতখুন! না কি প্রশ্ন উঠবে দায় কার, তা নিয়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আকস্মিক হলেও পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা কি আগে থেকেই আটকানো যায় না? আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয় আসার ইঙ্গিত থাকলেও আগেভাগে সতর্ক হলে কি আটকানো যায় না কিছুটা? প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম আমরা। তাঁদের একাংশের দাবি; মাল নদীর ঘটনা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিদর্শন হলেও এই ক্ষেত্রেও অবশ্যই আগে থেকেই সাবধান হওয়া সম্ভব ছিল। কীভাবে? বলা হচ্ছে, ভৌগলিক পরিবেশ অনুযায়ী মাল নদী খরস্রোতা। অনেকেই বলেন এই নদী নাকি পাগল নদী। যখন-তখন যা কিছু হয়। ঠিক সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে হড়পা বান যে আসতে পারে এমন আশঙ্কা থাকে প্রতিবারই। ঠিক এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন বিসর্জন এবং ভিড় সামলানোর ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে পারত। যেখানে নদীখাতে দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেত। তাহলে আচমকা বানের জলে এত মানুষ ভাসতেন না। আবার বিপরীত দিক থেকে একটি অংশের দাবি, সাম্প্রতিক সময়ের দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে ভিড়, কল্যাণীর টুইন টাওয়ার দেখতে ছোটাছুটি, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে চেঁচামেচি, আবার শ্রীভূমিতে আগে ঢোকার চেষ্টায় বেপরোয়া দৌড়- একটা বড় অংশের জনতা অসচেতনতার বশবর্তী হয়ে এসব কাণ্ড ঘটান বারবার। যার ফলে প্রশাসনের কাজের ক্ষেত্র কঠিন হয়ে যায় আরও। হঠাৎ এই দৌড়ের মধ্যে কেউ যদি পড়ে যান, সেখান থেকেই বড় কোনও বিপদের আশঙ্কা থাকে। ঠিক যেমন হয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার কচুয়ায়। লোকনাথ মন্দিরের কাছেই। আবার এইরকমই দেখা যায় উত্তর ২৪ পরগনার টাকির ইছামতি নদীতে দুর্গা প্রতিমা ভাসানের ক্ষেত্রে। যেখানে একের পর এক নৌকায় অতিরিক্ত লোকের ভিড়ে অনেকসময় বিপদ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ঠিক এই অবস্থাতেই অসচেতন ভাবমূর্তিতে নষ্ট হয় খেই, বিপদ ঘটে পুজো বা যে কোনও উৎসবে।
আবার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তারা অথবা কোনও অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের অপরিমিত আয়োজন, অতিরিক্ত ভিড় সামলানোর অদক্ষতা বিপদ ঘনিয়ে নিয়ে আসে বারবার। সম্প্রতি কলকাতার নজরুল মঞ্চে সঙ্গীতশিল্পী কেকের মৃত্যুর পরে এই প্রশ্ন উঠেছিল ফের। অর্থাৎ অপর্যাপ্ত জায়গায়, অপরিমিত বন্দোবস্ত সত্ত্বেও নাছোড়বান্দা জনতার ভিড় সামলানোর পরিকাঠামো না থাকলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, এই প্রশ্ন উঠেছে মাল নদীর এই ঘটনার পরে। যা চিরন্তন। অনেকেই বলছেন, উৎসব ভালো। আনন্দ দেয় নিরন্তর। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দোষ এবং প্রশাসনের ভুল না ধরে একটু সতর্ক হলেই খানিকটা এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে অপ্রীতিকর ঘটনা। অন্তত উৎসবের মতোই আনন্দে বাঁচতে পারেন দেবতারাও। তাই কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলছেন, বিষাদে ভরায় চোখ, বেদনাশ্রু জলে, প্রতিবার বেলাগাম হলে মরবে অকালে! আর সেই মৃত্যুর দায় যে জনতার উপরেই বর্তাবে তা স্পষ্ট করে ভারতের ধর্মীয় উৎসবে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা। তাই, ধর্মস্থানে বাঁচতে প্রকৃতির দোষ শুধু নয়, ফেলে আসা স্মৃতি জেনে সতর্ক হোন আপনিও, বলছেন কেউ কেউ।