ব্রিটিশদের আবিষ্কৃত গাড়ি এখন কলকাতার গর্ব কালোমানিক

সুব্রতবাবুর গর্ব কালোমানিক। হাওড়া কদমতলা থেকে বেরিয়ে ক্যারি রোড, দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার হয়ে তিনি প্রায়ই নিউটাউনে ইকো পার্কে হাওয়া খেতে যান। না, একদিনের জন্যও রাস্তায় মরিস মাইনর বন্ধ হয়নি।

তিন বছর হলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে ভয়াবহ ছাপ ফেলেছে যুদ্ধ। ১৯৪৫-এ দেশের মানুষ ক্ষমা করেনি চার্চিলকে, নির্বাচনে তিনি হেরে গিয়েছেন। এইরকম দেশের অবস্থার মধ্যে ১৯৪৮ সালে লন্ডনে আর্লস কোর্ট মোটর শো আয়োজিত হল সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ। যুদ্ধের জন্য কয়েক বছর বন্ধ ছিল মোটর শো-টি। ১৯৪৮-এই ব্র্যাডম্যান ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। বিলেতের মাটিতে জীবনের শেষ ম্যাচে রানের ঈশ্বর বিদায় নিলেন শূন্য রানে।

সেদিনের শো দেখতে বহু মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন আর সকলের মন কেড়ে নিল ছোট্ট একটি কিউট গাড়ি– ব্রিটিশ ইকনমি কার। মধ্যবিত্তদের জন্য তৈরি গাড়িটির নাম মরিস মাইনর, সংক্ষেপে এমএম। ছোট্ট কালো রঙের গাড়ির কী তেজ! 'হাম দো, হামারা দো'- এই কনসেপ্টে বানানো মরিস মাইনর অচিরেই 'ডার্লিং অফ দ্য ক্রাউড' হয়ে উঠল। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত মরিস মাইনর গাড়ি বিক্রি হয়েছিল প্রায় ১৬ লাখের কাছাকাছি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ এমএম সেলুন; ১৯৫২-'৫৬ এমএম সিরিজ টু, আর ১৯৫৬ থেকে ১৯৭১ এমএম ১০০০। দু'দরজা, যাকে বলে টু-ডোর মরিস মাইনর, টু-ডোর কনভার্টিবল ছাদ খোলা গাড়ি এবং ১৯৫০ সালে চার দরজার গাড়ি ছেয়ে ফেলল ইংল্যান্ড।

সাদা এবং কালো মরিস মাইনর বাজারে এলেও পরে নানা রং যুক্ত হয়। মাইনরের পার্সেল ভ্যান এবং পিক আপ ভ্যান আর উড ফ্রেমড এস্টেট কার অচিরেই শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল ব্রিটিশদের। এস্টেট মরিস মাইনরে পিকনিক করতে যাওয়াটা একটা চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল মধ্যবিত্তদের। যে দেশ রোলস রয়েস, জাগুয়ার, অস্টিন, এম.জি বানিয়েছে, তারা প্রেমে পড়ল মরিসের।

আরও পড়ুন: বয়স ষাট, কলকাতার লাল-সাদা স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড লজ্জায় ফেলে ইনোভা-জাগুয়ারকেও

ভারতেও বহু মরিস মাইনর এসে পৌঁছল পাঁচের দশকের গোড়ায়। দেশ তখন তবে স্বাধীন হয়েছে। সস্তার গাড়ি, তাই কলকাতা-সহ বিভিন্ন শহরে মরিস মাইনর চলতে লাগল। ব্যায়ামাচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষের একটি মরিস মাইনর গাড়ি ছিল। গড়পারের বাড়ি থেকে তিনি কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় তাঁর প্রিয় বাহনটিতে চড়ে যেতেন। বিশালবপু মানুষটি এঁটেও যেতেন ছোট্ট মরিসে। সঙ্গে থাকত তাঁর প্রিয় শিষ্যরা– কখনও কমল ভাণ্ডারী, কখনও বা শান্তি চক্রবর্তী, হিমাংশু রায়। বিষ্ণুবাবুর দুপুরে একটু ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস ছিল, আর তার ব্যতিক্রম মরিস চালানোর সময়ও হতো না। স্টিয়ারিং-এর ওপর ঢুলে পড়তেন আর ব্যায়ামী ছাত্ররা বলতেন, বিষ্ণুদা, ঘুমিয়ে পড়লেন যে। সেই ডাক শুনে তাঁর ঘুম ভাঙত। আর গড়গড়িয়ে চলত মরিস মাইনর। কলকাতায় তখন গাড়ি-ঘোড়া কম তাই কোনও দুর্ঘটনা কখনও ঘটেনি। বিষ্ণুবাবুর গাড়ি চড়ে ঘুমের গল্প আমাকে শুনিয়েছিলেন কমল ভাণ্ডারী।

পাঁচের দশকে কলকাতার অবস্থাপন্ন এবং মধ্যবিত্ত- দুইয়েরই হাতে এসেছিল মরিস মাইনর। ১৯৫১ সালে উত্তর কলকাতার এক জমিদার পরিবার একটি মরিস মাইনর ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করে। বাড়িতে অন্যান্য বড় গাড়ি থাকলেও এই গাড়িটি জমিদারবাবুর খুব প্রিয় ছিল। বহুদিন চালানোর পর বাজারে নিত্যনতুন গাড়ি আসতে শুরু করে, আর দর কমতে থাকে মরিসের। এক সময় তা বিক্রি হয়ে যায়। উত্তর শহরতলিতে পৌঁছয় মরিস। কয়েক বছর পরে সেখানেও সে দর পায় না। পলিথিন কভারে ঢেকে বাড়ির এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকে এককালে শহর-কাঁপানো মরিস মাইনর। সারা শরীরে নানা ক্ষত; অবহেলার, অনাদরের ছাপ দেহের সর্বত্র। তখন ঘোর কোভিড চলছে, ২০২০ সালে খবরের কাগজে মরিস গাড়িটি বিক্রির একটা বিজ্ঞাপন বেরোয়।

হাওড়া কদমতলার সুব্রত সরকারের শখ ছিল একটা পুরনো গাড়ি চেপে দ্বিতীয় হুগলি সেতু দিয়ে কলকাতাতে আসবেন। মরিসের বিজ্ঞাপন দেখে তিনি পৌঁছে গেলেন উত্তর শহরতলির বাড়িটিতে এবং ৭১ বছরের বৃদ্ধটিকে ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে এলেন হাওড়াতে। হাওড়াতে তো তিনি এলেন, কিন্তু দেখা গেল, দীর্ঘদিন অযত্নের ফলে তার চারটি চাকাই আর ঘোরে না। ইঞ্জিনটিও অকেজো হয়ে গেছে আর সারা দেহে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট।

Moris Minor

 

সুব্রতবাবু আদা-জল খেয়ে লেগে গেলেন মরিস মাইনরকে তার আগের চেহারায় ফিরিয়ে দিতে। এ এক একান্ন বছরের ব্যক্তির ৭১ বছরের বৃদ্ধকে রাস্তায় নামানোর সংগ্রাম। সমস্যা হলো ভালো মিস্ত্রি যোগাড় করা, যারা এই গাড়ির কাজ একসময় করেছে। সুব্রতবাবুর বাবার আমলের এক বৃদ্ধ কারিগরকে পাওয়া গেল এবং একটু একটু করে মরিসের চাকচিক্য ফিরতে লাগল। একদিন ইঞ্জিন ডেকে উঠল, জানান দিল, আমি শিগগিরি আগের মতো আবার ছুটব। চাকা সারানো হলো এবং তা ঘুরতে লাগল। ইলেকট্রিক‍্যাল লাইনের কাজের শেষে সবাইকে অবাক করে চলতে লাগল ট্রাফিগেটর। আগেকার দিনের গাড়িতে ইন্ডিকেটর ছিল না। হাত দেখিয়ে গাড়ি ঘোরাতে হতো। কেউ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে ডানহাত দিয়ে তাকে চলে যাওয়ার সাইন দেওয়া হতো। গাড়ি বাঁদিকে ঘোরাতে গেলে ডানহাতের তর্জনী আর অনামিকা অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘোরানো হতো। সাহেবরা অনুভব করেন, এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। কারণ বর্ষাকালে গাড়ির কাচ নামালে গাড়িতে বৃষ্টির ছাঁটের জল আসে। তাই তারা ট্রাফিগেটর আবিষ্কার করল। ডানদিক এবং বাঁদিকের সামনের আর পিছনের দরজার মাঝখানে ট্রাফিগেটর বসানো থাকত। এমনিতে সেটিকে দেখা যেত না, গাড়ি ডানদিক বা বাঁদিকে ঘোরানোর আগে স্টিয়ারিং-এ লাগানো একটি ছোট ঘাট ঘোরালেই ট্রাফিগেটরটি বেরিয়ে আসত এবং পিছনের গাড়ির চালক বুঝতে পারতেন, আগের গাড়িটি ডানদিক বা বাঁ দিকে ঘুরছে। রাতে ট্রাফিগেটরে আলো জ্বলত।

 

এবারে ৭১ বছরের যুবককে রং দিয়ে সাজানোর পালা। অরিজিনাল যে কালো রঙ ছিল, সেই রঙে তাকে সাজানো হল। সূর্যপ্রতিম মিত্রের হাতের স্পর্শে স্মার্ট মরিস মাইনর যখন গাড়ির ওয়ার্কশপ থেকে বেরোল, কে বলবে তার ৭১ বছর বয়স।

সুব্রতবাবুর গর্ব কালোমানিক। হাওড়া কদমতলা থেকে বেরিয়ে ক্যারি রোড, দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার হয়ে তিনি প্রায়ই নিউটাউনে ইকো পার্কে হাওয়া খেতে যান। না, একদিনের জন্যও রাস্তায় মরিস মাইনর বন্ধ হয়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। নাতির বয়সি আই-টেন বা সুইফট ডিজায়ারের সঙ্গে সমান তালে ছোটে দাদু।

সুব্রতবাবু প্রতিদিন তাকে একবার স্টার্ট করেন আর ছুটির দিনে বেড়াতে নিয়ে যান। সুব্রতবাবু এগিয়ে না এলে এতদিনে কোথায় হারিয়ে যেত ব্রিটিশদের এই অভিনব আবিষ্কার। কলকাতার ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যেত মরিস মাইনর।

More Articles