আমির খান থেকে জ্যাকি শ্রফ, তারকাদের সওয়ার দাপিয়ে বেড়ায় কলকাতায়

ট্রায়াম্প বহু পুরস্কার পেয়েছে। দ্য স্টেটসম্যান ভিনটেজ অ্যান্ড ক্লাসিক কার র‌্যালিতে ট্রায়াম্প বহু প্রাইজ পেয়েছে। ভারতে ভিনটেজ কার র‌্যালির পথিকৃৎ এই শতাব্দীপ্রাচীন খবরের কাগজটি।

সময়টা সাতের দশকের শেষ ও আটের দশকের শুরুর কথা। মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভ তখনও এখনকার মতো ভিড়ে ঠাসা ছিল না। মেরিন ড্রাইভের বিশেষ আকর্ষণ ছিল একটি হুড খোলা লাল রঙের ব্রিটিশ ট্র্যায়াম্প গাড়ি ও তার চালক। চালক টু-সিটার গাড়িটি নিয়ে মেরিন ড্রাইভে আসতেন এবং খুব জোরে চালাতেন তার বাহনটিকে। চালকের নায়কোচিত চেহারা, একমাথা কালো চুল, চোখে সানগ্লাস। যাঁরা দেখতেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, এই ছেলেটি কে? এ কি কোনও সিনেমার হিরো! 

ছেলেটি তখনও সিনেমায় নামেনি, মডেলিং করে। ১৯৮২ সালে দেব আনন্দের 'স্বামী দাদা' ছবি দিয়ে তাঁর বলিউডে প্রবেশ। ১৯৮৩-তে সুভাষ ঘাইয়ের 'হিরো' ছবিতে তিনি নায়ক। জয়কিষণ কাকুভাই শ্রফ। কিন্তু এই নামে তাঁকে কেউ চেনে না; বন্ধুর দেওয়া নাম জ্যাকি তাঁর ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৮৩ সালের পর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতর এগিয়েছে জ্যাকির জীবন। এসেছে সম্মান, অর্থ। নিত্যনতুন গাড়ি কেনা তাঁর শখ। তবুও ভুলতে পারেননি লাল টু সিটার ট্রায়াম্পকে, আর অবসর পেলেই মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভে গাড়ি চড়া ছিল তাঁর শখ। প্রিয় গাড়িটি ১৯৬৩ সালের মডেল। চলত খুব জোরে আর দেখতে গাড়ির মালিকের মতোই আকর্ষণীয়। 

'জো জিতা ওহি সিকন্দর' সিনেমাটা মনে আছে? আমির খানের ছবি। দুই ভাইকে নিয়ে গল্প; একজন ধীর-স্থির, ভালো পড়াশোনাতে আর অন্যজন বোহেমিয়ান- হিন্দি ছবির খুব কমন ছকে বানানো ছবি। ছায়াছবিতে আমির খান একটি গাড়ি চালাতেন। রং ছিল ব্লু সিলভার-নীলের সঙ্গে রূপোলির এক মিশেল রঙ। ছায়াছবিতে যে গাড়ি ব্যবহার করা হয়, সেটি জ্যাকি শ্রফের ট্রায়াম্প টু-সিটার। 

আরও পড়ুন: ব্রিটিশদের আবিষ্কৃত গাড়ি এখন কলকাতার গর্ব কালোমানিক

জার্মানির ন্যুরেমবার্গ শহরের সিগফ্রিড বেটম্যান ১৮৮৫ সালে ট্রায়াম্প মোটর কোম্পানি শুরু করেন। বেটম্যান ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সাইকেল আমদানি করে বিক্রি করতেন লন্ডনে। ১৮৮৭ সালে বেটম্যান এক জার্মানি বন্ধু মর্টিজ সুটুলের সঙ্গে যৌথভাবে একটি কোম্পানি খোলেন। ১৮৮৯ সালে ইংল্যান্ডের কোভেন্ট্রিতে তাঁরা সাইকেল বানাতে শুরু করেন। সেই সাইকেলের নাম ট্রায়াম্প। 

১৯২৩ সালে ট্রায়াম্প প্রথম গাড়ি বানাতে শুরু করে। ১৯৬০ সালে লেল্যান্ড মোটরস কিনে নেয় ট্রায়াম্পকে। ট্রায়াম্প মোটরসাইকেল এখনও খুব জনপ্রিয়। ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকাতে পুরনো ট্রায়াম্প গাড়ির মালিকরা ট্রায়াম্প ক্লাব তৈরি করেন এবং প্রতি বছর তাঁরা একটি বা দু'টি শো আয়োজন করেন যেখানে পুরনো গাড়ির মালিকরা তাঁদের গাড়ি নিয়ে আসেন। এই শো দেখতে খুব ভিড় হয়। 

জ্যাকির ট্রায়াম্পটিকে একসময় তিনি বিক্রি করে দেন। সেটি কেনেন মুম্বইয়ের একজন নামকরা কালেক্টর। তিনিও কয়েকবছর পর এটিকে বিক্রি করে দেন আর একজন সংগ্রাহকের কাছে। যেহেতু নতুন কালেক্টর মালিকটির অনেক ক'টি গাড়ি ছিল, তাই তার কাছে কোনও পাত্তাই পেল না ট্রায়াম্প।

২০০৭-'০৮ এ কলকাতাতে এটিকে কিনে নিয়ে আসেন সৈকত দত্ত। সৈকত গাড়িপ্রেমিক। যখন গাড়িটি হাতে পেলেন, তখন তাঁর ইঞ্জিনটি অচল যাকে বলে নন-স্টার্টার। রং চটে গেছে। অযত্নে গাড়ির টায়ারগুলো বসে গিয়েছে। গাড়িটির যে কাপড়ের হুড, সেটিও নষ্ট হয়ে যায়।

সৈকত যখন ভাবছিলেন কীভাবে এই বৃদ্ধ মানুষটিকে আবার তার যৌবন ফিরিয়ে দেওয়া যায়‌। তখন এগিয়ে আসেন সৈকতের পারিবারিক বন্ধু ও বিখ্যাত পুরনো গাড়ির রেস্টোরার সঞ্জয় ঘোষ। দক্ষিণ কলকাতার ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে সঞ্জয়বাবুর ওয়ার্কশপ। বছরদুয়েক আগে তিনি গত হয়েছেন কিন্তু তাঁর হাতের ছোঁয়ায় বেঁচে আছে বুইক, ক্যাডিল্যাক, স্পাকার্ড, বা লিনসিয়া-ভি -লামডার মতো বিরল গাড়ি। 

ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সের গ্যারেজ হয়ে উঠল ট্রায়াম্প-এর নতুন বাড়ি। খুব খুঁতখুঁতে ধরনের মানুষ সঞ্জয়বাবু। প্রথমে শুরু হল ট্রায়াম্পের বডির কাজ। প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীর। একটু একটু করে তা সাজিয়ে তোলা হলো। ইঞ্জিনটি চালু করতে লেগে গেল বেশ কয়েক মাস। চার সিলিন্ডার ১২০০ সি.সি-র ইঞ্জিন। খুব ধরে কাজ না করলে বিপদ, হয়তো আর কোনওদিনই গাড়িটিকে চালানো যাবে না। একসময় ইঞ্জিন তার ছন্দে ফিরল। গাড়িতে ইঞ্জিন বসিয়ে কয়েক চক্কর ঘুরে দেখা গেল, তিনি গরম হচ্ছেন না এবং ঠিকঠাক চলছেন। এবার রং দেওয়ার পালা। লাল র‌ং দিয়ে ট্রায়াম্প নতুনভাবে সেজে উঠল। নতুন হুড লাগিয়ে ছোট্ট মানুষটির রূপ ঠিকরে বেরতে লাগল।

ট্রায়াম্প বহু পুরস্কার পেয়েছে। দ্য স্টেটসম্যান ভিনটেজ অ্যান্ড ক্লাসিক কার র‌্যালিতে ট্রায়াম্প বহু প্রাইজ পেয়েছে। ভারতে ভিনটেজ কার র‌্যালির পথিকৃৎ এই শতাব্দীপ্রাচীন খবরের কাগজটি। জানুয়ারি মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় রবিবার কলকাতাতে এই র‌্যালি হতো এবং রাস্তা দিয়ে অযান্ত্রিকেরা যেত। বহু মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতেন এদের দেখার জন্য। 

সৈকতবাবু বর্ষাকাল বাদে বছরের বাকি ক'টা মাস নিয়মিত ট্রায়াম্প চড়েন। "কে বলবে ওর ৬০ বছর বয়স হলো। যেমন গতি, তেমন ছন্দ, এখনকার গাড়ি হার মেনে যায়," বললেন সৈকত। বর্ষাকালে বৃদ্ধ পিতামহ থাকেন গ্যারেজে। বিশেষ নজর থাকে যেন কোনওভাবে বৃষ্টির জল না লাগে। চাকা খুলে জ্যাকের ওপর তার অবস্থান। বর্ষা থামলেই আবার তিনি রাস্তায় নেমে পড়েন নিজ অননুকরণীয় স্টাইলে। 

সৈকত বা সঞ্জয়বাবু না থাকলে কবেই হারিয়ে যেত জ্যাকি শ্রফের সাধের ট্রায়াম্প। ষাট বছরের মুম্বই এবং কলকাতার বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী এই চার চাকার বাহনটি- রূপে, রঙে, চলনে সে সত্যই অনন্য। 

 

More Articles