আগুনে ছারখার হয়ে যাওয়া গাড়ি আজ দেশের গর্ব, কলকাতার বাসিন্দা বৃদ্ধ মার্সিডিজ
আগুনে নষ্ট হয়ে যায় গাড়ির বনেট, সামনের উইন্ডস্ক্রিন ফেটে যায় আর ছাদটি পুড়ে যায়। গাড়ির ইঞ্জিনটি সচল ছিল।
বয়স ৫৪ হলেও তাঁর সুঠাম দেহ এবং চলার রাজকীয় ভঙ্গি এখনও সম্ভ্রম জাগায়। কলকাতার রাস্তায় গ্রীষ্ম এবং শীতকালে তাঁকে দেখা যায়। তিনি মার্সিডিজ ডবলু ১১৫।
স্টুটগার্টে এই গাড়িটি কেনেন এম. টি. মেহতা। কলকাতাতে তিনি আসেন ১৯৭১ সালে। মেহতা সাহেবের কাছ থেকে গাড়িটি কেনেন বিখ্যাত গাড়ির সংগ্রাহক শালু চৌধুরী। সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি ও পাজামা পরিহিত শালুবাবু একসময় কলকাতার পুরনো গাড়ির জগৎ দাপিয়ে বেড়াতেন। শুধু গাড়ির সংগ্রাহকই নন, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি একজন অতি পরিচিত নাম। শালুবাবুর ইচ্ছে ছিল, এই গাড়িটি নিয়ে ইউরোপিয়ান র্যালিতে যোগ দেবার। একটি বিমান সংস্থার সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক কথা হয় এবং বিমান সংস্থাটি রাজি হয় তাঁকে স্পনসর করতে। শেষ মুহূর্তে বিমান সংস্থাটি বেঁকে বসে, এবং শালুবাবুর ইউরোপিয়ান র্যালিতে যোগদান স্বপ্নই থেকে যায়।
শালুবাবুর সোনায় গড়া মন। এই মার্সিডিজের বর্তমান মালিক সৌরজিৎ পালচৌধুরী শালুবাবুর কাছে যাতায়াত করতেন। পরিবারের একজন ছিলেন সৌরজিৎবাবু। নীল রঙের মার্সিডিজটি ওঁর খুব পছন্দ। শালুবাবুকে উনি বিনীতভাবে বলেন, যদি কখনও এই গাড়িটি বিক্রির কথা ভাবেন, যেন সৌরজিৎ বাবুকে তা একবার জানান। এই প্রস্তাবে শালুবাবু হেসে ওঠেন আর বলেন, “তোমার গাড়িটি এত পছন্দ, ঠিক আছে তোমাকে গাড়িটি দিয়ে দেব।"
আরও পড়ুন: ১০৮ বছর ধরে কলকাতার রাজপথে সচল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উলসলি-র চাকা
দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে যায়। সৌরজিৎবাবু ভাবেন শালুবাবু ভুলেই গেছেন ব্যাপারটা। হঠাৎ একদিন তিনি শালুবাবুর ফোন পান এবং তাঁকে অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
মার্সিডিজের জন্ম জার্মানিতে। এমিল জেলিনেক ছিলেন একজন নামকরা ব্যবসায়ী। তিনি ঘোড়াবিহীন ডেমলার গাড়ি সমাজের উচ্চবিত্তদের কাছে বিক্রি করতেন। আমেরিকাতে রকফেলারকে তিনি একটি ডেমলার গাড়ি বিক্রি করেন। ডেমলার কোম্পানিকে তিনি অর্থ দিয়েও সাহায্য করতেন। জেলিনেকের মোটর রেসিং-এর শখ ছিল। ডেমলার গাড়ি নিয়ে তিনি রেস জেতেন। ডেমলার কোম্পানিকে তিনি বলেন, তিনি এই নতুন গাড়ি বিক্রির সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবেন, যদি এই গাড়ির নাম তাঁর মেয়ে মার্সিডিজের নামে রাখা হয়। ডেমলার কোম্পানি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। ১৯০১ সালে মার্সিডিজ গাড়ি বাজারে এল এবং ১৯০২ সালে মার্সিডিজ ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রি করা হয়। সেই থেকে আজ অবধি এর জয়যাত্রা অব্যাহত। মে ২০২২-এ ১৯৫৫ সালের একটি মার্সিডিজ এসএলআর ১৪২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
হিটলার এবং জেনারেল রোমেলের ১২ সিলিন্ডারের মার্সিডিজ ছিল। মার্সিডিজের বনেটের ওপর তারা এই কোম্পানি জলে জলে এবং আকাশে চলতে বা উড়তে একইরকম স্বচ্ছন্দ। অর্থাৎ মার্সিডিজ গাড়ি, জাহাজ, এবং প্লেনের ইঞ্জিন তৈরি করে তারা, এবং এই তিন ক্ষেত্রে তাদের সুনাম আজও অক্ষুণ্ণ। জেনারেল হেরমান গোয়েরিংয়ের খুব পছন্দ ছিল মার্সিডিজ গাড়ি। তাঁর আকাশি নীল রঙের মার্সিডিজ গাড়িটির নাম ছিল ব্লু গুজ। ১৯৩৭ সালে গোয়েরিং এই গাড়িটি হাতে পান। তাতে বুলেটপ্রুফ কাচ বসে, দেহটিকেও বুলেটপ্রুফ করা হয়। গোয়েরিং যেদিন গাড়িটি প্রথম হাতে পান, সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফ্যুয়েরার।
৪ মে, ১৯৪৫ আমেরিকান সেনাবাহিনী গাড়িটিকে পায়। গোয়েরিংকে ন্যুরেমবার্গ বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আমেরিকান জেনারেল ম্যাক্সওয়েল টেলার এই গাড়িটি চড়তেন এবং তিনি এটিকে আমেরিকায় নিয়ে যান। ১৯৫৬ সালে গাড়িটি নিলামে ওঠে এবং এটি ২১৬৭ ডলারে কেনেন জ্যাক টিউনিক। তিনি দু'-বছর গাড়িটি চড়ে ডা. জর্জ বিটউডকে গাড়িটি ১৯৫৮ সালে বিক্রি করে দেন। তিনি গাড়িটিতে কালো রং করেন। পরে বিটউডের কাছ থেকে কার্জলাউজ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড কোম্পানি গাড়িটি কেনেন এবং এখনও গাড়িটি চালু আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হিটলারের এবং তাঁর নীতির তুমুল সমালোচনা হয় বিশ্বজুড়ে। নাৎসিবাহিনীর সমালোচনা হলেও নাৎসি সেনাধ্যক্ষদের ব্যবহার করা মার্সিডিজ গাড়িটির সুনাম এবং আভিজাত্য ক্ষুণ্ণ হয়নি। বিশ্বযুদ্ধ আরও দু'টি জার্মান গর্বকে সরিয়ে রাখেনি – জার্মান শেফার্ড কুকুর এবং মঁ ব্লাঁ কলম। আমেরিকান পুলিশ এখনও জার্মান শেফার্ড ব্যবহার করে পাহারা দিতে এবং অপরাধী ধরতে। আর মঁ ব্লাঁ না থাকলে তো আভিজাত্য সম্পূর্ণ হয় না।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় নিজে মার্সিডিজ চালাতেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্সিডিজ এসইউভি চড়েন।
পালচৌধুরী মশাইকে ডেকে যখন শালুবাবু মার্সিডিজটি দেখান, তখন সৌরজিৎবাবু চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। মার্সিডিজটিতে আগুন লেগে যায়। আগুনে নষ্ট হয়ে যায় গাড়ির বনেট, সামনের উইন্ডস্ক্রিন ফেটে যায় আর ছাদটি পুড়ে যায়। গাড়ির ইঞ্জিনটি সচল ছিল।
ধীরে ধীরে গাড়ির ক্ষত সারিয়ে তোলা হয়। ওই মডেলের অন্য একটি মার্সিডিজ থেকে কিছু পার্টস নিয়ে সৌরজিৎবাবুর গাড়িটি সেজে ওঠে। ২০১৪ সালে স্টেটসম্যান ভিনটেজ এবং ক্লাসিক কার র্যালিতে ‘বেস্ট মেনটেনড কার’-এর শিরোপা পায় সে। এ-পর্যন্ত ৫৩,০০০ কিমি চলেছে গাড়িটি।
পালচৌধুরীদের আদি বাড়ি নদিয়া জেলার মহেনগঞ্জে। মহেনগঞ্জে সে বহুবার গেছে। দিল্লি রোডের রাস্তাতেও তাকে প্রায়ই চলতে দেখা যায়।
বাঁদিকে স্টিয়ারিং-এর অরিজিনাল জার্মান গাড়িটি অতি অল্প জায়গাতে কাটানো যায়। এয়ারকন্ডিশনড নেই, কিন্তু জানলাগুলো এত বড় যে, গরম লাগে না।
সৌরজিৎবাবুর পিতৃদেব বিশ্বজিৎ বাবু ১৯৩২ সালে কলকাতা থেকে খাইবার পাস পর্যন্ত বাড়ির মার্সিডিজ গাড়িটি চালিয়ে গিয়েছিলেন। এমন জার্মান ইঞ্জিন যে, এতটা পথ গাড়িটি নির্বিঘ্নে যায়। কালের প্রভাবে সেই গাড়িটি হারিয়ে গেছে।
সৌরজিৎবাবুর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে গাড়িটি। উনি যদি আগুনে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িটিকে সুস্থ না করে তুলতেন, তবে একটি ইতিহাসের মৃত্যু হতো। দেশ ও জাতির গৌরব নিয়ে এখনও কলকাতা এবং হাইওয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।