পাড়ি জমিয়েছিল কলকাতা থেকে লন্ডন, শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসেও তরতাজা বেবি অস্টিন ৭
১৯৩১ থেকে ২০২২-এ কম ঘটনার সাক্ষী আমাদের পিতামহ বেবি অস্টিন ৭ নন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশভাগ, বাংলাদেশের জন্ম- সব ঘটনার নীরব সাক্ষী তিনি।
দক্ষিণ কলকাতার বলরাম মল্লিকের মিষ্টির দোকানের সামনে প্রায়ই একটি ছোট্ট গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গাড়ির খাদ্যরসিক-মালিক, সাংবাদিক প্রদীপ গুপ্তু যখন রকমারি মিষ্টি কিনতে ব্যস্ত, তখন বাইরে তার গাড়িকে ঘিরে ভিড় জমেছে। ওরে এই গুবরে পোকাটাকে দেখ– বলে উঠলেন ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও ব্যক্তি। আবার কেউ বললেন– এটা নিশ্চয়ই ফোর্ড গাড়ি। আবার কেউ বললেন, না, না এটা অস্টিন। এরই মধ্যে প্রদীপ এসে গম্ভীর মুখে গাড়িটিকে স্টার্ট করে মধ্য কলকাতায় তার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছে।
নেভি ব্লু আর কালো রঙের যুগলবন্দি ৯১ বছরের বেবি অস্টিন ৭, বৃদ্ধটির জৌলুস যে অনেকটা বাড়িয়েছে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ছোট্ট গাড়িটির কী তেজ রে বাবা! এখনও ২৫-২৮ মাইল গতি নিয়ে কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে কলকাতা।
পূর্ব বর্ধমান জেলার অগ্রদীপের জমিদার চুণীলাল চৌধুরী গাড়িটি কেনেন ১৯৩১ সালে। অগ্রদীপ একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। এখানকার দোল মন্দির বিখ্যাত। ১৯১৩ সালে তৈরি ব্যান্ডেল-কাটোয়া সেকশনের একটি স্টেশন অগ্রদীপ। অগ্রদীপের উল্টোদিকে নবদ্বীপ চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান। সব মিলিয়ে বর্ধমান জেলার প্রাচীন জনপদটি বেশ বিখ্যাত।
আরও পড়ুন: বিধান রায় বললেন, চাকরি নেই, ট্যাক্সি চালাও! যুবকদের ভরসা ছিল স্ট্যান্ডার্ড টেন গাড়ি
চুণীলালবাবু এমন গাড়ি খুঁজছিলেন, যে গাড়িটি তাঁর দেশের বাড়ির অঞ্চলে চালানো যায়। অধিকাংশ বেবি অস্টিন হুডখোলা গাড়ি, কিন্তু এই গাড়ি চড়লে ধুলো খেতে খেতে অস্থির হয়ে যেতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলেন ঢাকায়, ১৯৩১ সালের অস্টিন ৭। কালো রঙের ছোট্ট গাড়ি। খুব শক্তপোক্ত। গরমের সময় ছোটখাটো নদী সে অনায়াসে পার হয়। বর্ষাকালে গ্রামের রাস্তায় কাদা জমে। কুছ পরোয়া নেই, কোদাল দিয়ে কাদা সরিয়ে পথ করে দিলে বেবি অস্টিন দিব্য চলে যায়। জমিদারবাবুর খুব প্রিয় এই ছোট্ট গাড়িটি; হয়তো দেখনদার নয়, কিন্তু খুব কেজো গাড়ি।
ইংল্যান্ডে অস্টিন ৭-এর জন্ম। সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের সবাই আদর করে ডাকত বেবি অস্টিন বলে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯২৩ সালে প্রথম এই গাড়িটিকে লন্ডনের রাস্তায় চলতে দেখা যায়। প্রথম আবির্ভাবেই শিহরণ। অতি অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে বেবি অস্টিন। ইংল্যান্ডের যেমন গর্ব রোলস রয়েস, তেমনই বেবি অস্টিন। ১৯২৩ সালে ২৫০০ বেবি অস্টিন ৭ তৈরি হয়। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৯ এই ১৬ বছরে ২,৯০,০০০ বেবি অস্টিন ৭ তৈরি হয়। শুধু ইংল্যান্ডে নয়, এর সুনাম ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৯২৭ সালে জার্মানির বি. এম. ডবলু. ডিক্সি আসলে অনুমোদিত অস্টিন ৭। ফ্রান্সে ১৯২৮ সালে যে রোজেন গার্টস গাড়ি তৈরি হয়েছিল, সেটিও অস্টিন ৭-এর অনুমোদিত মডেল। আমেরিকাতে যেমন মধ্যবিত্তদের গাড়ি ফোর্ড মডেলটি গাড়ির শিল্পে একটা বিপ্লব এনেছিল, ইংল্যান্ডে তেমনই বেবি অস্টিন। ইংল্যান্ডের জাতীয় গর্ব হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট অযান্ত্রিক, নিজ গুণে, নিজ মহিমায়।
চৌধুরীমশাই ১৯৩১ থেকে ১৯৫০ সাল অবধি চুটিয়ে তার প্রিয় বেবি অস্টিন ৭-টিকে চালান। গ্রামের নানা পথে, বর্ধমান শহরের নানা রাস্তায় তার ছিল অবাধ বিচরণ। জমিদারবাবুর বয়স হচ্ছিল, আর তিনি নিজে গাড়ি চালাতে পারতেন না। তার প্রিয় গাড়িটির স্থান হলো উত্তর কলকাতার অগ্রদীপ ভবনে। প্রথমে একটু আধটু আদর-যত্ন করা হলেও পরে তাকে একটি ময়লা ফেলার ভ্যাটে রূপান্তরিত করা হয়। ছাদের সান রুফটি খুলে গাড়ির মধ্যে ভাঙা শিশিবোতল ফেলা হতো। এইভাবে উনি অনাদরে, অবহেলায় পড়েছিলেন প্রায় ১৫ বছর। শেষে একদিন এসে পড়লেন গুপ্তুদের কাছে।
সালটা ১৯৭০। সবাই বলল, গাড়ির মাথা কেটে ওকে ট্যুরার বানিয়ে দাও। বেঁকে বসলেন গাড়ির মালিক অজিতকুমার গুপ্তু। ১৯৭০ থেকে ১৯৮২, বারো বছর ধরে চলল বৃদ্ধ পিতামহকে সারিয়েসুরিয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে আবার নতুন করে রাস্তায় নামানোর লড়াই। গুপ্তুদের যত্নে অল্প দিনেই সে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। প্রথমেই সারিয়ে তোলা হলো সানরুফটিকে। গরমকালে সানরুফটি খুলে দিলে গাড়ির সওয়ারিদের মনেই হয় না, এই গাড়ি এয়ার কন্ডিশনড নয়। প্রকৃতির বাতাস মাত করে দেয় যাত্রীদের। এমনভাবে সানরুফের ঘাটটি আছে যেন বৃষ্টির জল না জমে, তাহলে এটি অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। ইঞ্জিন বসে গিয়েছিল, সেটিকেও সারিয়ে তোলা হল। প্রতি পদক্ষেপে ধৈর্যের পরীক্ষা। চার সিলিন্ডার সাত অশ্বশক্তির ইঞ্জিন।
এই গাড়ির দুটো মজা আছে। প্রথমটি হলো– এর ব্রেকটি তারের আর দ্বিতীয়টি, গাড়িটিকে লক করা যায় না। যখন গাড়িটি বাজারে আসে, তখন দিনকাল অন্যরকম। দরজা খোলা রাখলেও কেউ নিজের মনে করে নিয়ে যাবে না। যেহেতু তারের ব্রেক, তাই এখনকার ট্রাফিকে খুব সাবধানে চালাতে হয়।
অজিতবাবু ১৯৮০-র দশকে একটি অসমসাহসের পরিচয় দিয়েছিল। নিজের শ্যালক প্রভাত সেন মহাশয়কে সঙ্গে করে বেনারস পাড়ি দিয়েছিলেন বেবি অস্টিন ৭-এ করে।
কলকাতা থেকে বেনারস প্রায় ৪০০ মাইল। আড়াই দিনে বেবি অস্টিন ৭ চেপে গুপ্তু মশাই এবং সেনমশাইকে পৌঁছে দিয়েছিলেন মন্দির শহরে। তখন তো স্বর্ণ চতুর্ভুজ হয়নি, তাহলে হয়তো আরও একটু কম সময় লাগত। ফেরার সময় সামান্য দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু অকুতোভয় বেবি অস্টিন ৭ তাতে দমে যায়নি। তার মালিককে নিশ্চিন্তে সে তাঁদের মধ্য কলকাতার নিবাসে পৌঁছে দেয়।
এখন গাড়িটি চালায় প্রদীপ গুপ্তু, অজিতবাবুর পুত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র প্রদীপের নানা বিষয়ে শখ আছে, বেবি অস্টিন ৭ চালানো তার মধ্যে অন্যতম। এই গাড়িতে রয়েল এনফিল্ডে বুলেট মোটরসাইকেলের চাকা লাগানো যায়, তবে এখন ইংল্যান্ডে এর অরিজিনাল টায়ারও পাওয়া যাচ্ছে।
প্রদীপ জানালেন, ৫২ বছর আগে, ১৯৭০ সালে গাড়িটি কেনার পর ইঞ্জিনের কাজ করানো হয়েছিল, তারপরে সম্প্রতি ২০২২ সালে ইঞ্জিনের কাজ করানো হয়। এতেই বোঝা যায়, গাড়িটি কতটা শক্তপোক্ত।
আর কয়েক বছর পরেই তিনি শতবর্ষের মুখ দেখবেন। গুপ্তু পরিবার না থাকলে এতদিনে তার অন্তর্জলি যাত্রা সম্পন্ন হতো। ইতিহাসের ছাত্র প্রদীপ একটি ইতিহাসকে ধরে রেখেছেন। ১৯৩১ থেকে ২০২২-এ কম ঘটনার সাক্ষী আমাদের পিতামহ বেবি অস্টিন ৭ নন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশভাগ, বাংলাদেশের জন্ম- সব ঘটনার নীরব সাক্ষী তিনি। দেশ যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করছে, তখন আমরাও বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জানাই বেবি অস্টিন ৭-কে।