আদর করে রাখা নাম জগদ্দল, জঙ্গলের রাস্তায় ছুটে বেড়ায় বুড়ো জিপগাড়ি
এখন এসইউভি-র রমরমা। এই সময় দাঁড়িয়েও দেখতে হয় সিজে৩বি-র বুড়ো হাড়ে ভেলকি। সামনে থেকে না দেখলে বা না চড়লে বোঝা যাবে না সিজে৩বি-র ম্যাজিক।
আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, আমাদের মধ্যে একটা ধারণা ছিল যে অঙ্ক এবং সংস্কৃতর মাস্টারমশাইরা ভীষণ রাগী হন। কথায় কথায় ডাস্টার ছুড়ে মারেন, কান মুলে দেন এবং মাথায় এমন গাঁট্টা দেন যে সাতদিন ব্যথা থাকে। অন্যদিকে বাংলার মাস্টারমশাইরা স্নিগ্ধ, শান্ত– 'গরু তুমি সরো আমি যাব' টাইপের। এর যে ব্যতিক্রম ছিল না, তা নয়, কিন্তু এমন একটা ধারণা আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম।
বাংলার মাস্টারমশাইরা যে কতটা ডাকাবুকো হতে পারেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণ বীরভূম জেলার অজয় নদীর পাড়ে একটি স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই রিক চক্রবর্তী। এই মাস্টারমশাই তাঁর ১৯৬৪ সালের সিজে৩বি জিপগাড়িটিকে নিয়ে ইলামবাজারের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। খোয়াইয়ের রাস্তায় চড়াই-উতরাই পথে ছোটান তাঁর প্রিয় জগদ্দলকে। জগদ্দল নামটি সুবোধ ঘোষের 'অযান্ত্রিক' উপন্যাস থেকে নেওয়া। ঋত্বিক ঘটক পরে এই উপন্যাসকে ভিত্তি করে তাঁর কালজয়ী ছায়াছবি 'অযান্ত্রিক' নির্মাণ করেন। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী রিক তাঁর জগদ্দলের সঙ্গে কথা বলেন, বুঝতে পারেন, কখন ৫৮ বছরের বৃদ্ধটির মন খারাপ হয়েছে, বা কখন সে হাসছে। রিকের সঙ্গে জগদ্দলের এক অদ্ভুত সম্পর্ক!
হঠাৎই শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ। বন্দরে তখন হাজার হাজার আমেরিকান ফোর্ড বা উলিইস জিপ পড়ে আছে। ক্রেতা নেই, কারণ লোকের হাতে পয়সা নেই। কলকাতা বন্দরেও বহু জিপ পড়েছিল। খোলা গাড়িটাই ভদ্রলোকে কিনতে রাজি হলেন না, গাড়িতে কোনও প্রাইভেসি নেই বলে। কিছু গ্রামের জমিদারবাবুরা জিপ কিনলেন শিকার করার সময় ব্যবহার করবেন বলে।
আরও পড়ুন: পাড়ি জমিয়েছিল কলকাতা থেকে লন্ডন, শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসেও তরতাজা বেবি অস্টিন ৭
১৯৫৩ সালে উইলিস কোম্পানি নিয়ে এল সিজে৩বি জিপগাড়ি। সিজে অর্থাৎ সিভিলিয়ান জিপ। এই জিপ এমনভাবে বানানো হলো, যাতে গাড়িগুলো চাষবাসে সাহায্য করতে পারে, অর্থাৎ ট্রাক্টরের বিকল্প। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৮- উইলিস ওভারল্যান্ড কর্পোরেশন এই গাড়ি বানাতে লাগল। সিজে৩বি-র চারটে বৈশিষ্ট্য আছে। পেট্রল ইঞ্জিন, বাঁদিকে স্টিয়ারিং, যা আমেরিকান গাড়িতে থাকে (যদিও ভারত বা ইংল্যান্ড, যেখানে বাঁদিক ধরে গাড়ি চালাতে হয়, সেই দেশগুলোর জন্য ডানদিকে স্টিয়ারিংয়ের আমেরিকান গাড়ি এসেছে), খুব ছোট জায়গায় ঘুরতে পারে আর ফোর হুইল ড্রাইভ। মনে রাখতে হবে, জিপগাড়ির সৃষ্টি ঘোড়ার বিকল্প হিসেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘোড়া কামান টেনে নিয়ে যেত। অনেক সময় লেগে যেত। তাই মিত্রশক্তি এমন গাড়ি তৈরির কথা ভাবে, যাতে কামান টেনে নেওয়া যাবে অতি সহজেই। দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধের জিপগাড়িতে নানারকম যন্ত্র লাগানো থাকত, যাতে শত্রুর মুখে পড়ার আগে যেন চালক এই যন্ত্রগুলি দিয়ে জিপটিকে নষ্ট করে দেন, যাতে শত্রুরা এইরকম গাড়ি বানাতে না পারে।
রিকবাবুর ইচ্ছা হলো, এইরকম সিজে৩বি একটি জিপ কিনব। রিক শাম্মি কাপুর, বিশ্বজিৎকে ছোটবেলায় দেখেছিলেন সিনেমায় জিপ চালাতে আর বড় হতেই মনে হলো, ওই গাড়ি একটা হলে ভালো হয়। 'শ্রীকান্ত'-তে শরৎচন্দ্র লিখেছেন “লাও তো বটে কিন্তু আনে কে?" এই গাড়ি জোগাড় করা কি মুখের কথা নাকি! সবই তো কাটাই হতে চলে গেছে। শেষে, ২০১০ সালে সরকারি নিলাম থেকে একটি ভাঙাচোরা সিজে৩বি পাওয়া গেল। রিকের আনন্দ আর ধরে না– সবাই চলে গেছে, একটি মাধবী তুমি এখনও তো ঠিকই ফুটে আছ।
সিজে৩বি-র প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্রতাপ চৌধুরী। তিনি ছিলেন নামকরা রেস্টোরার। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য যে, প্রতাপবাবু অকালে চলে যান। লরির মাথায় সিজে৩বি এল প্রতাপবাবুর হাওড়ার ওয়ার্কশপে। একটি স্ক্র্যাপ গাড়িকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া খুব কঠিন এবং জটিল ব্যাপার। রিককে সহায়তা করেন বিখ্যাত জিপ কালেক্টর উদয়ভান সিংহ।
প্রতাপবাবু তিনজনকে লাগিয়ে দেন সিজে৩বি-কে সারিয়ে এবং সাজিয়ে তুলতে। কিছু ছিল না গাড়িটার। শুধু একটা ফ্রেম আর সবকিছুই ভাঙা। খুব যত্নে প্রথমে গাড়িটার শরীর মেরামত করা হল।
পুরনো গাড়িকে প্রাণদানের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় কুমোরটুলির প্রতিমা নির্মাণ। বাঁশ আর খড়ের কাঠামোর ওপর মাটি লেপে মূর্তি বানানো হলো। সেই মূর্তিতে রঙ পড়ল, চুল লাগানো হলো, চোখ আঁকা হলো। তখন সেটি দেবী।
পুরনো গাড়িও ঠিক এইভাবে তৈরি করতে হয়। ইঞ্জিনটা মাটিতে পড়ে আছে, কেউ এসে খবর দিল, জানেন তো, হাওড়ার অমুক গোডাউনে ঠিক এর জোড়া ইঞ্জিন পড়ে আছে। ছোট ছোট সে গুদামে দেখা গেল, তিনি মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। তাকে এনে সারিয়েসুরিয়ে স্টার্ট করা হলো। সবচেয়ে সমস্যা হয়, পুরনো মিটার খুঁজে পেতে। মল্লিকবাজারে কোনও ব্যক্তির কাছে হয়তো পুরনো গাড়ির দুটো মিটার পড়ে আছে। তাকে দরদস্তুর করে কেনা- সে এক বিরাট আর্ট।
প্রতাপবাবু দু'বছরের চেষ্টায় সিজে৩বি-কে দাঁড় করালেন। ২০১২ সালে গাড়িটি রাস্তায় বেরোনোর উপযুক্ত হয়। ২০১০ থেকে ২০১২- দু'বছর রিকের বাড়ি হয়ে উঠেছিল প্রতাপবাবুর হাওড়ার উনসানীর ওয়ার্কশপ। আজ গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক স্টার্ট নিল, কালই দেখা গেল স্টার্ট নিচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ সমস্যাটা কোথায়! আবার সমাধানসূত্রও চলে এল।
সিজে৩বি উইঞ্চ বলে একটি যন্ত্র লাগানো আছে। এই জিপগুলো যেহেতু অফ রোড ড্রাইভিং-এ সিদ্ধহস্ত, তাই গাড়িটি কোনও খারাপ রাস্তা বা জলের মধ্যে আটকে গেলে আগে পাশের কোনও গাছে মোটা তারের তৈরি উইঞ্চটি আটকানো হয়। গাড়ির সমস্ত শক্তি তখন উইঞ্চে পৌঁছে গেছে। তাই অনায়াসে গাড়ি থেকে টেনে তোলা যায়। এই উইঞ্চের সাহায্যে অন্য গাড়িকেও কাদা বা খারাপ রাস্তায় আটকে গেলে টেনে তোলা হয়।
সিজে৩বি অসম্ভব শক্তিশালী একটি বাহন। যত বয়স বাড়ছে, তত যেন জোশ বাড়ছে। রিক মাঝে মাঝেই ইলামবাজার জঙ্গলের মধ্যে খারাপতম রাস্তা দিয়ে জগদ্দলকে চালান এবং জগদ্দলও প্রভুকে কোনওরকম বিপদে না ফেলে ঠিক ওই রাস্তা দিয়ে চলে ফিরে বেড়ায়।
রিকের দিদা রাধারানি রক্ষিতের বয়স হল ৯৯ বছর। একশো ছুঁই ছুঁই এই মানুষটি প্রায়ই নাতির সঙ্গে জগদ্দলে চড়ে ঘুরে বেড়ান। রিক স্ত্রী ও কন্যা মেঘনা ও ইদাকে নিয়ে প্রায়ই লম্বা সফরে জগদ্দলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আলাপচারিতার সময় রিক বলছিলেন, কী বলব দাদা, কোনওদিন জগদ্দল আমাদের কোনও বিপদে ফেলেনি। একবার জঙ্গলে একটু আটকে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেও আমরা ঠিক চলে আসি।
অধিকাংশ চালক চান, রাস্তা হবে মসৃণ আর তার ওপর দিয়ে গাড়ি হু হু করে ছুটবে। রিকবাবু যে মসৃণ রাস্তায় গাড়ি চালাতে ভালবাসেন না তা নয়, তবে তার প্রিয় অফ রোড ড্রাইভিং। কোনও রাস্তা থাকবে না, মাটির পথ। দু'টি গাছের মধ্য দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে হবে। কোথাও এমন ঢাল যে মনে হবে এই বুঝি গাড়িটি উল্টে গেল, কিন্তু তিনি ওলটান না। বহাল-তবিয়তে নিজের ওপর আস্থা রেখে অফ রোড ড্রাইভিং এ রিককে সঙ্গ দেন।
রিক, প্রতাপবাবু এবং উদয়ভান সিংহ এবং তিনজন কারিগর না থাকলে কবে সিজে৩বি হারিয়ে যেত। এখন এসইউভি-র রমরমা। এই সময় দাঁড়িয়েও দেখতে হয় সিজে৩বি-র বুড়ো হাড়ে ভেলকি। সামনে থেকে না দেখলে বা না চড়লে বোঝা যাবে না সিজে৩বি-র ম্যাজিক। বিরাট এক ইতিহাসকে বহন করে নিয়ে চলেছে জগদ্দল। রিকের জগদ্দল আর জগদ্দলের রিক মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।