১০৮ বছর ধরে কলকাতার রাজপথে সচল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উলসলি-র চাকা
কলকাতাতেই উলসলি-টির লীলাক্ষেত্র। এই শহর তার শৈশবের সাক্ষী, যৌবনের উপবন এবং বার্ধক্যের বারাণসী।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আমলে ভারতকে চালনা করার ক্ষেত্রে সর্বময় কর্তা ছিলেন সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া। ইংরেজ শাসনে ১৯৩৫ সাল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর, কারণ গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট নিয়ে আসে ব্রিটিশ সরকার। এই আইনে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করার কথা প্রথম বলা হয় এবং ফেডারেল লিস্ট, প্রভিনশিয়াল লিস্ট এবং কনকারেন্ট লিস্টের কথা উঠে আসে এই আইনের মধ্য দিয়ে। বি. আর. আম্বেদকর রচিত ভারতের সংবিধান অনেকটাই ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট থেকে নেওয়া।
১৯৩৫ থেকে ১৯৪০ সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া ছিলেন দ্য আর্ল অফ রোনাল্ডসে। এর আগে ১৯১৭ থেকে ১৯২২ তিনি ছিলেন গভর্নর অফ বেঙ্গল। তিনি বাংলার গভর্নর থাকাকালীন যে উলসলি লিমুজিন ল্যান্ডোলেট গাড়িটি চড়তেন, সেটি এখনও কলকাতাতে আছে এবং ১৯১৪ সালে নির্মিত গাড়িটি আবহাওয়া ভালো থাকলে কলকাতার রাস্তায় পদচারণা করেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের প্রাক্কালে ১০৮ বছরের বৃদ্ধ প্রপিতামহ কেমন আছেন দেখা যাক।
গত শতকের আটের দশকের গোড়ায় অসমের ডিব্রুগড়ের একটি আশ্রমে এই অযান্ত্রিককে খুঁজে পান শশীকুমার কানোরিয়া। শশীবাবু ছিলেন প্রাচীন গাড়িকে প্রাণ দেওয়ার জাদুকর। ভিনটেজ গাড়ির দুনিয়ায় তিনি ছিলেন একছত্র অধিপতি এবং তাঁর কাজ ছিল জাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের সঙ্গে তুলনীয়। আজ হয়তো ওঁর ওয়ার্কশপে আপনি একটা ভাঙাচোরা গাড়ি দেখলেন; দেখা গেল, মাসছয়েক পরে গাড়িটি সেই সময়ের ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ ওঁকে বললেন, কোনও এক ধনী ব্যক্তি ওদের গাড়িটি দান করেছেন, কিন্তু সেই দাতার নামধাম কিছুই তারা বলতে পারেনি।
আরও পড়ুন: আদর করে রাখা নাম জগদ্দল, জঙ্গলের রাস্তায় ছুটে বেড়ায় বুড়ো জিপগাড়ি
আটের দশকে তিনি কলকাতাতে পদার্পণ করলেন। শশীবাবু শুরু করলেন ইতিহাসকে কথা বলানোর কাজ। ১৯৮৯ সালে উলসলেটি যখন দ্য স্টেট্সম্যান ভিনটেজ ও ক্লাসিক কার র্যালিতে যোগ দিল, তখন সকলের তাক লেগে গেল। এমারেল্ড গ্রিন এবং কালো রঙে গাড়ির রূপটি এমন খুলেছে যে, কেউ আর চোখ ফেরাতে পারল না। প্রথম আবির্ভাবেই শিহরণ, উলসলি জয় করে নিল দ্য স্টেট্সম্যান ট্রফি। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি দ্য স্টেট্সম্যান কলকাতা ও পরে দিল্লিতে ভিনটেজ এবং ক্লাসিক কার র্যালি শুরু হয়। এমন জনপ্রিয় হয়েছিল এই র্যালি যে, পশ্চিমবঙ্গের বার্ষিক গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের মধ্যে এটিও গণ্য হতে থাকে।
ভারতের দুর্ভাগ্য যে, শশীবাবু অকালে চলে যান। ইতিহাসপ্রেমী এই মানুষটি রেখে যান তাঁর পুত্র শ্রীবর্ধনকে। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, ভারতে শ্রীবর্ধন বর্তমানে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রেস্টোরার। শশীবাবু উলসলির অরিজিনাল চাকাটি পাল্টান। শ্রীবর্ধন আবার সেই মূল যে চাকা ব্যবহার করা হতো, সেটিকে ফেরত নিয়ে আসেন। শ্রীবর্ধনের কাজের ধারা হচ্ছে, ইতিহাস যেন কোনওভাবে বিঘ্নিত না হয়। যেমন আসল গাড়িটি ছিল অবিকল যেন সেইরকমই থাকে।
রাজপ্রতিনিধির গাড়ি বলে কথা। কলকাতার ডাইকস অ্যান্ড কোম্পানি গাড়িটিকে তৈরি করেন। বিলেত থেকে ইঞ্জিন এসেছিল। তার ওপর আরামদায়ক গাড়িটি ডাইকস তৈরি করেন এমনভাবে, যাতে বাংলার গরম আবহাওয়ার মধ্যেও গাড়িতে যে মহামান্য অতিথিরা রয়েছেন, তাঁদের যেন কোনও কষ্ট না হয়। গাড়িটি যেমন দেখনদার তেমনি আরামদায়ক। চড়লে মনে হয় যেন ঘোড়ার গাড়ি চড়ে হাওয়া খেতে বেড়িয়েছি।
২৪/৩০ বি এইচ পি মডেলের ১৬৮৫টি গাড়ি ১৯১০-'২৪-এর মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল; এদের মধ্যে মাত্র ১৩টি টিকে আছে গোটা পৃথিবীতে। যেগুলো বর্তমানে আছে, তার মধ্যে উলসলে লিমুজিন ল্যান্ডোলেট আবার সমাদৃত তার সৌন্দর্যের জন্য।
২০১৭ সালে উলসলিটি বেস্ট অফ শো আখ্যায় ভূষিত হয় কার্টিয়ার ট্রাভেল উইথ কনকরস দ্য এলিগেন্স প্রতিযোগিতায়। গাড়িটির রূপে মুগ্ধ হয়ে মাননীয় লর্ড মার্চ অফ গডউড এই গাড়িটির ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, এবং তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন শ্রীবর্ধন। শ্রীবর্ধন শুধু পুরনো গাড়ির রেস্টোরার নন, তিনি একজন অসাধারণ চিত্রকর। তিনি স্কেচ করাতে সিদ্ধহস্ত। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া শ্রীবর্ধন ১৯৯৬ সালে উলসলের একটি স্কেচ করেন এবং ফেসবুকে উলসলি-র যে পাতাটি আছে, সেখানে তুলে দেন। শ্রীবর্ধনের স্কেচটি দেখে অ্যানডার্স ক্লসাগের এবং অ্যান্ডি পামার শ্রীবর্ধনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ব্রিটিশ মোটর মিউজিয়াম থেকে গাড়িটির বংশতালিকা পাঠিয়ে দেন।
১৯০১ সালে উলসলির জন্ম ইংল্যান্ডে। এই গাড়িটির সৃষ্টির পিছনে ভিকার্স অর্মামেন্টস এবং হারবার্ট অস্টিনের অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। ১৮৯৭ সালে তিন চাকার উলসলি অটো কার তৈরি হয় এবং ১৮৯৯ সালে চার চাকার উলসলি বাজারে আসে। ১৯০১ থেকে গাড়ি বিক্রি হতে শুরু হয়। ১৯০৪ সালে ডেনমার্কের রাণী অ্যালেকজান্দ্রা উইলসে চড়তেন তার হাল ফ্যাশনের চেহারার জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অফিসারদের ব্যবহারের জন্য ৩৬০০টি গাড়ি বিক্রি করে উলসলি এবং বহু অ্যাম্বুলেন্স বিক্রি করে।
১০৮ বছরেও দমেনি উলসলি, যাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে প্যালেস অন উইলস– চলমান রাজপ্রাসাদ। এই বয়সেও তিনি প্রায়ই বেড়াতে বের হন। আবহাওয়া ভালো থাকলে শনি ও রবিবারে তাঁকে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায়।
একটি চলমান ইতিহাসের সাক্ষী উলসলি-টি। দুটো বিশ্বমহাযুদ্ধ, দেশ ভাগ, বাংলাদেশের জন্ম, দেশময় নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সাক্ষী লিমুজিন ল্যান্ডোলেট।
শ্রীবর্ধন এই গাড়িটিকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্বর্গত পিতা শশীকুমার কানোরিয়াকে এবং কলকাতাবাসীকে। কলকাতাতেই উলসলি-টির লীলাক্ষেত্র। এই শহর তার শৈশবের সাক্ষী, যৌবনের উপবন এবং বার্ধক্যের বারাণসী। যদি কেউ কলকাতার একটি সম্পূর্ণ ইতিহাস লেখেন, তবে তাঁকে অবশ্যই উলসলি লিমুজিন ল্যান্ডোলেটকে নিয়ে লিখতেই হবে, কারণ ওঁর মাননীয় উপস্থিতি ছাড়া এই শহরের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।