বিধান রায় বললেন, চাকরি নেই, ট্যাক্সি চালাও! যুবকদের ভরসা ছিল স্ট্যান্ডার্ড টেন গাড়ি
ইংল্যান্ড থেকে অরিজিনাল হেডলাইট এসে গেছে। আরো চাকচিক্য বাড়বে ওঁর। নতুন চেহারা আর নবযৌবনপ্রাপ্ত স্ট্যান্ডার্ড টেন ছুটবে কলকাতার রাস্তা দিয়ে।
দেশভাগের দগদগে ঘা তখনও শোকায়নি। দেশের দু'টি অংশ বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করে স্বাধীনতা এল। যাদের গোলাভরা ধান ছিল, আনন্দে দিন কাটছিল, তারা হঠাৎ দরিদ্র হয়ে গেল, বাধ্য হল দেশ ছাড়তে। শিয়ালদহ স্টেশনে আশ্রয় নিল বহু মানুষ, অনিশ্চয়তা হয়ে উঠল জীবনের নিত্যসঙ্গী। এই যন্ত্রণার মধ্যে দেশ গড়ার কাজ শুরু হল। কিছু কলকারখানা তৈরি হলো, দেশে নতুন সংবিধান এল, জীবন বইতে লাগল নতুন ছন্দে।
পাঁচের দশকে ভারতে তিনটি গাড়ি তৈরির কারখানা স্থাপিত হলো। উত্তরপাড়াতে হিন্দুস্থান মোটরস, মাদ্রাজ, অধুনা চেন্নাইতে স্ট্যান্ডার্ড মোটরস আর মহারাষ্ট্রে প্রিমিয়ার অটোমোবাইলস। ভারতে তখন বড় বড় আমেরিকান গাড়ি ট্যাক্সি হিসেবে চলত, যেমন- ডজ, শেভ্রোলে, পন্টিয়াক, হাডসন। এদের বলা হতো ম্যাক্সি ট্যাক্সি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় উদ্বাস্তু সমস্যা, আকাশছোঁয়া বেকারত্ব আর খাদ্যসংকট ডা. রায়ের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। বেকার ছেলেরা কোনও না কোনও নেতাকে ধরে ওঁর কাছে পৌঁছত চাকরির আশায়। একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দিন স্যর, কাতর আবেদন বেকার যুবকদের। অজানা ভবিষ্যৎ, জানে না আগামীকাল কেমন যাবে, তাই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চাইত বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। ডা. রায়ের সাফ জবাব– দেখো, বাবা চাকরি কোথায়, চাকরি দিতে পারব না। গাড়ি চালানো শেখো, আমি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দেব। আর শোনো, কোনও কাজ ছোট না, ভাবছ ভদ্রলোকের ছেলে বলে কীভাবে ট্যাক্সি চালাব, লোকে কী বলবে। আমিও দু'বছর ডাক্তারি পাশ করে ট্যাক্সি চালিয়েছিলাম। ডা. রায়ের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে বহু বেকার ছেলে গাড়ি চালানো শিখল এবং ট্যাক্সি চালাতে লাগল। কালো হলুদ ট্যাক্সি, যাকে বলা হতো মিনি ট্যাক্সি যেমন স্ট্যান্ডার্ড টেন, ফিয়াট ছেয়ে ফেলল বাজার। এল অ্যাম্বাসাডরও। দেখা গেল, স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৫৭-'৫৮ সালের মধ্যে কলকাতাতে ম্যাক্সি ট্যাক্সির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেল। শুরু হলো দেশি ট্যাক্সির যুগ।
আরও পড়ুন: বিধানচন্দ্র রায় থেকে জ্যোতি বসু, এই মডেলের ফিয়াট পছন্দ ছিল সকলেরই
দক্ষিণ কলকাতাতে তপন মুখোপাধ্যায় ভোম্বলদা নামেই খ্যাত। ওঁর একটি স্ট্যান্ডার্ড টেন ট্যাক্সি ছিল। ১৯৫৫ থেকে প্রায় চল্লিশটি বছর গাড়িটি কলকাতার রাস্তায় চলেছিল। ভোম্বলদা খুব টিপটপ করে গাড়িটিকে রাখতেন। গাড়িটি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার-সূত্রে ওঁর বাবার কাছ থেকে। স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পরে প্রফুল্ল মুখোপাধ্যায় চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে যখন কোনও ব্যবস্থাই করতে পারলেন না, তখন কংগ্রেস নেতা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তদানীন্তন পুলিশ মন্ত্রী কালীপদ মুখোপাধ্যায়কে ধরে বললেন, দাদা একটা ব্যবস্থা করে দিন। কালীপদবাবু যুবক প্রফুল্লকে ডা. রায়ের কাছে নিয়ে গেলেন। ডা. রায়ের নির্দেশে গাড়ি চালানো শিখে ফেলল প্রফুল্ল এবং ডা. রায়ের ব্যবস্থাপনায় হাতে উঠল স্ট্যান্ডার্ড টেন গাড়ি। ঠিক হলো, প্রতি তিনমাস অন্তর রাইটার্স বিল্ডিংসে ডা. রায় যুবকদের সঙ্গে বসবেন, যারা ট্যাক্সি চালাচ্ছে। মিটিংগুলো একজন অভিভাবকের সঙ্গে পুত্রসম ছাত্রদের মিটিং। ডা. রায় প্রতিটি যুবকের কাছে জানতে চাইতেন তারা কী খায়, কতটা জল খায়, কতক্ষণ গাড়ি চালায়, কতটা বিশ্রাম নেয়। কলকাতাতে কোন রাস্তায় গাছ আছে, যেখানে দুপুরে গাছের ছায়াতে তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারবে, সেকথাও তিনি বলে দিতেন। কিছুদিনের মধ্যে ডা. রায় প্রতিটি যুবকের আত্মীয় হয়ে উঠলেন। এই যুবকরাও কোনওদিন ডা. রায়কে ভোলেননি। প্রতিটি গাড়িতে ডা. রায়ের ছবি থাকত এবং ধূপ জ্বেলে ওঁর ছবিতে প্রণাম করে ওই যুবকরা ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তায় নামতেন।
স্ট্যান্ডার্ড টেনের জন্ম ইংল্যান্ডে। ৯৪৮ সিসি ইঞ্জিনের গাড়িটি অত্যন্ত শক্তপোক্ত। চারজন মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারত। সামনের দু'টি সিটের মাঝে ছোট্ট লাট্টু গিয়ার, ছোট্ট স্টিয়ারিং খেলনার গাড়ির মতো দেখতে। প্রথমে কালো গাড়ি ইংল্যান্ডের বাজার ছেয়ে ফেলেছিল। তারপর নানা রঙের গাড়ি বাজারে এল যেমন– ছাই, সাদা, নীল।
সল্টলেকবাসী যুবক সৌম্য বসুর শখ পুরনো গাড়ি কিনে সেটিকে সারিয়ে চড়ার। সৌম্যবাবুর বয়সে যখন সবাই আধুনিক গাড়ি নিয়ে ছোটে, উনি চালান পুরনো অ্যাম্বাসাডর বা ফিয়াট বা স্ট্যান্ডার্ড টেন।
স্ট্যান্ডার্ড টেনটি সৌম্যবাবু কেনেন শ্যামবাজারের একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে। গাড়িটি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয়নি। ইঞ্জিন বসে গিয়েছিল। যিনি মালিক ছিলেন, তিনি অ্যাম্বাসাডরের হেডলাইট লাগিয়েছিলেন। ২০২১ সালে ৭০ বছরের বৃদ্ধটি নতুন মালিকের কাছে এলেন ক্রেনে চেপে, তার নিজের পায়ে চলার শক্তি নেই।
সৌম্যবাবুর যত্নে আস্তে আস্তে পুরনো শক্তি ফিরে পেতে লাগলেন স্ট্যান্ডার্ডবাবু। পুরনো গাড়িকে আবার রাস্তায় নামাতে অত্যন্ত ধৈর্যর দরকার। আজ বেশ স্টার্ট নিল, কিন্তু আগামীকাল বাবুর যে কি মেজাজ হলো, তিনি স্টার্টই নিলেন না, নট নড়নচড়ন, নট কিছু। তখন রেগে গেলে চলবে না।
সৌম্যবাবু ধৈর্যর পরীক্ষায় পাশ করে চালাতে লাগলেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ যুবকটিকে। কলকাতাতে এই মুহূর্তে হয়তো হাতে গোনা কয়েকটি স্ট্যান্ডার্ড টেন আছে। এ বছর পুজোর পরেই বাবুর ঠাটবাট বদলে যাবে। ইংল্যান্ড থেকে অরিজিনাল হেডলাইট এসে গেছে। আরো চাকচিক্য বাড়বে ওঁর। নতুন চেহারা আর নবযৌবনপ্রাপ্ত স্ট্যান্ডার্ড টেন ছুটবে কলকাতার রাস্তা দিয়ে।
সৌম্যবাবুর মতো মানুষরা ইতিহাসের বড় রকমের সেবক। পুরনো ইতিহাস এঁদের হাতের জাদুতে বেঁচে থাকে তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে, সৌন্দর্য আর আভিজাত্য নিয়ে। সৌম্যবাবুর কাছে অযান্ত্রিকটি প্রাণময়। বুঝতেই তো পারেন, ওর বয়স হয়েছে, তাই খুব ধরে চালাতে হয়, সবসময় খেয়াল রাখতে হয় যেন ওর কোনও কষ্ট না হয়। সৌম্যবাবুর শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর যত্ন নিয়ে বেঁচে থাক স্ট্যান্ডার্ড টেন, ডা. রায়ের প্রিয় বেবি ট্যাক্সি।