ঠেলাগাড়িতে চড়া অযান্ত্রিক থেকে কলকাতার রাজপুত্র, অস্টিন ১০ যে পথ পেরিয়ে এল

অস্টিন টেনবাবু যখন রাস্তা দিয়ে চলে, মনে হয় যেন এক চলমান ইতিহাস কথা বলছে।

দৃশ্যটা একবার কল্পনা করুন। উত্তর কলকাতার একটি রাস্তা দিয়ে একটা মালভর্তি ঠেলাগাড়ি চলেছে, আর তার পাশে ঠেলাচালকটিকে সঠিকভাবে ঠেলা চালানোর নির্দেশ দিতে দিতে চলেছে একটি যুবক। তার নজর ঠেলা থেকে যেন কোনও মাল পড়ে না যায়।

এই ঠেলায় চলেছে ১৯৩৯ সালে তৈরি অস্টিন টেন ট্যুরারের ভাঙাচোরা মূল কাঠামো আর চটের দুটো থলিতে গাড়ির যন্ত্রাংশ।

সালটা ২০০৮। অমিতাভ সাহা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতার এক আত্মীয়র বাড়ি। বিয়েবাড়িতে অনেক চেনা-পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা, হাসি, কথা বিনিময় চলছে। এমন সময় একজন এসে অভিতাভবাবুকে বললেন বাড়ির পিছনে যেতে। একটা ভাঙা গাড়ি পড়ে আছে। অমিতাভবাবুর গাড়িপ্রীতির কথা অনেকেই জানেন, তাই সেই ভদ্রলোক ভেবেছিলেন, এই যুবকের হয়তো গাড়িটা দেখতে ইচ্ছে হবে।

আরও পড়ুন: আগুনে ছারখার হয়ে যাওয়া গাড়ি আজ দেশের গর্ব, কলকাতার বাসিন্দা বৃদ্ধ মার্সিডিজ

Austin 10

ছবি সৌজন্য: লেখক

গাড়ি দেখতে গিয়ে অমিতাভবাবুর চক্ষু চড়কগাছ। ভাঙাচোরা যে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটি বিরল একটি ব্রিটিশ গাড়ি, হুডখোলা অস্টিন ১০। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটি সেপটিক ট্যাঙ্কের ওপর। অনাদর, অবহেলা, অবজ্ঞার ছাপ সারা দেহে। চারদিকে ময়লা পড়ে আছে, গাড়িটির মধ্যেও প্রচুর জঞ্জাল।

অমিতাভবাবু গাড়ি দেখে ফিরে এসেছেন বিয়েবাড়ির আসরে। একে একে অতিথিরা বিদায় নিচ্ছেন। বাড়ি যখন অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে, সংকোচের সঙ্গে অমিতাভবাবু গৃহকর্তাকে বললেন, গাড়িটি তিনি কিনতে ইচ্ছুক। অবহেলাতেই তো পড়ে আছে গাড়িটি, তাই যদি ওঁকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব অমিতাভবাবু পান।

ভদ্রলোক রাজি হলেন, তবে যে দায়িত্ব অমিতাভবাবুর কাঁধে দিলেন, তা হারকিউলিসের পৃথিবীকে কাঁধে নিয়ে থাকা বা পবনপুত্রর বিশল্যকরণী খুঁজতে যাওয়ার সঙ্গে তুলনীয়। হারকিউলিস তো অ্যাটলাসের কাঁধে পৃথিবীর বোঝা দিয়ে বেঁচেছিলেন, আর হনুমান একটি গাছ আনতে গিয়ে গোটা পাহাড় নিয়ে এসেছিলেন, যেটি থেকে সঠিক গাছটি বেছে নেওয়া হয় এবং লক্ষ্মণের প্রাণ বাঁচে। গৃহকর্তা বললেন, গাড়িটি তিনি দেবেন, তবে তার আগে অমিতাভবাবুকে গাড়ির অরিজিনাল কাগজ তৈরি করে আনতে হবে।

শুরু হলো অমিতাভবাবুর জুতোর শুকতলা ছেঁড়ার পালা। ১৯৩৯ সালের গাড়ির কাগজ পাওয়া কি সোজা কথা? বেলতলা মোটর ভেহিকলসের লোকজন প্রথমে ভাগিয়ে দিলেন অমিতাভবাবুকে। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি, সিঁড়ির পর সিঁড়ি পার হওয়া, রাইটার্স বিল্ডিংস-এ ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্ত্রী-আমলাদের জন্য অপেক্ষা করা, এমনভাবে চলল বেশ কিছুদিন। সকলেই একই কথা বলেন, মশাই, এইসব পুরনো জগদ্দলের কাগজ বানানোর দরকার কি?
একদিন হাতে কাগজ এল, এবং ২০০৮ সালে ঠেলাগাড়ি চেপে উনি পাড়ি দিলেন নতুন ঠিকানায়।

অস্টিন কোম্পানি ১৯৩৯ সালের মে মাসে অস্টিন টেন ট্যুরার বানাতে শুরু করে। ইংল্যান্ডের নামী গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা। এদিকে গোটা ইউরোপে তখন বিশ্বযুদ্ধের দামামা। অজানা ভবিষ্যৎ। জিনিসপত্রর আকাশছোঁয়া দাম, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এরই মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করল। অস্টিন কোম্পানি ঠিক করল, অস্টিন টেন আর বানাবেন না। পাঁচ মাসেই এক বিরাট সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটল।

অমিতবাবু যে গাড়িটিকে পেলেন, তার ছাদ ছিঁড়ে গেছে। গাড়ির সারা দেহ পচে গেছে এবং একটিও মিটার নেই। সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে গাড়িটিকে নামাবার চেষ্টা করতেই ঝুরঝুর করে খসে পড়ল গাড়ির বেসিস আর দু'-আধখানা হয়ে গেল। সবাই অমিতাভবাবুকে বললেন, বাবা, এই জিনিস নিয়ে আর বাড়ি যেও না ; মল্লিকবাজারও এই গাড়ি নেবে না।

একদিকে আত্মীয়কুল, অন্যদিকে একা কুম্ভ অমিতাভবাবু, মাঝে নকল কুঁদিগড়ের মতো অস্টিন টেন।

শুরু হলো আক্ষরিক অর্থে যমে-মানুষে লড়াই। আজ গাড়িটির একটি জায়গা মেরামত করা হলো, পরের দিন দেখা গেল আর একটি জায়গা ভেঙে পড়েছে। বিরাট ধৈর্যর লড়াই। শেষ অবধি গাড়িটি আবার চালু হবে তো? এই ভাবনা ভাবিয়েছে অমিতাভবাবুকে।

২০০৮ থেকে ২০১০- প্রায় দু'বছর লাগল গাড়িটির ইঞ্জিনটিকে সচল করতে। ইংল্যান্ডে অস্টিন কান্ট্রি ক্লাব আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। গাড়ির ইতিহাসের বই পড়ে অমিতাভবাবু অস্টিনের এক বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন। বিলেত থেকে এল গিয়ারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, ড্যাশবোর্ডের মিটারগুলো এবং ইগনিশন সুইচ। সঙ্গে এল কিছু মনোগ্রাম। কলকাতার গাড়ি সারাইয়ের মিস্ত্রিরা শাপভ্রষ্ট দেবতা। পৃথিবীর যে কোনও গাড়ি এঁদের হাতে কথা বলে; যে কোনও গাড়ি সারানোতে এঁরা সিদ্ধহস্ত, এঁরা বিশ্বকর্মার বরপুত্র। যাঁরা গাড়িটিকে প্রাণ দিলেন, তাঁরা ১৯৩৯ সালের কলকাতা দেখেননি, সে-যুগের গাড়ি সম্পর্কে কোনও ধারণা তাঁদের নেই, কিন্তু পরিশ্রম এবং সহজাত মেধা নিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একদিন সবাইকে অবাক করে অস্টিন টেন ডেকে উঠল। অমিতাভবাবুর উত্তেজনা চাঁদে প্রথম মানুষের পদার্পণের সঙ্গে তুলনীয়। সবুজ এবং কালো রঙে তিনি যেদিন সেজেগুজে বাড়ি থেকে বেরলেন, সেইদিন মনে হলো ৮৩ বছরের পিতামহ যেন অভিসারে চলেছেন।

গোটা পৃথিবীতে এই মডেলের অস্টিন টেন ট্যুরার মাত্র ছ’টি আছে– ইংল্যান্ডে তিনটি, অস্ট্রেলিয়াতে একটি, এবং ভারতে দু'টি– কলকাতায় একটি আর পুনেতে একটি।

অস্টিন টেন চেপে অমিতাভবাবু প্রায়ই কলকাতার বাইরে যান। যেমন, শান্তিনিকেতন, শক্তিগড়, বেলদা। অমিতাভবাবুর কথায় হুড নামিয়ে দিলে সে অনায়াসে ঘণ্টায় ১২০ কিমি গতিতে দৌড়তে পারে। বৃষ্টিবাদলা না হলে নিয়মিত কলকাতার পথে ওকে দেখা যায়।

গত কয়েক বছরে ওর পুরস্কার বা সম্মানও কম জোটেনি। ২০১২ সালে 'দ্য স্টেটসম্যান ভিনটেজ' এবং ক্লাসিক কার র‍্যালিতে শ্রেষ্ঠ রেস্টোরেশন পুরষ্কার এবং ২০১৩-তে ওই র‍্যালিতেই বেস্ট মেনটেনড পুরষ্কার। ২০২০ সালে এলএএআই বেস্ট জাজের পুরষ্কার।

অস্টিন টেনবাবু যখন রাস্তা দিয়ে চলে, মনে হয়, যেন এক চলমান ইতিহাস কথা বলছে। বহু ঘটনার সাক্ষী এই অযান্ত্রিক। স্বাস্থ্য এবং চাকচিক্য যেমন আছে, তাতে মনে হয় উনি শতাব্দী পার করবেন।

অমিতাভবাবু না থাকলে ইতিহাসের একটা পাতা না পড়া থেকে যেত। বেঁচে থাকুক অস্টিন টেন আরও বহু বছর। তার মাননীয় উপস্থিতি, আভিজাত্য অটুট থাকুক।

More Articles