রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আহতদের সারিয়ে তুলতে পারে তেলাপিয়া মাছ? বাঙালির মাছের বিশ্বজয়

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নতুন কোশের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা আছে তেলাপিয়া মাছের চামড়ার।

খাদ্যরসিক মেছো বাঙালি মাছ খেতে ভালবাসলেও, এই মাছটি সম্পর্কে অধিকাংশ বাঙালির প্রবল নাক-সিঁটকানো রয়েছে। তবে সম্ভবত অধিকাংশ বাঙালি জানেন না, এই মাছটির চামড়ার সাহায্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোন পর্যায়ে বিপ্লব ঘটে গেছে বছর কয়েক আগেই। কী সেই মাছ, যাকে নিয়ে এত কথা?

 

হ্যাঁ, আজ গল্প হবে তেলাপিয়া মাছকে নিয়ে। শরীরে চামড়া পুড়ে গেলে, সেই ক্ষততে তেলাপিয়া মাছের চামড়া লাগিয়ে গজানো হচ্ছে নতুন চামড়া। কিন্তু তেলাপিয়া মাছের চামড়া দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে কয়েক বছর আগেই বিপ্লব ঘটে গেলে, আজ হঠাৎ সেই নিয়ে কথা কেন?

 

খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। আম বাঙালি নিত্য-নতুন বিষয়ে মজে থাকলেও, যুদ্ধের রেশ তাদের কাছে স্তিমিত হয়ে এলেও, যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী যারা, তাদের কাছে যুদ্ধের মানসিক ক্ষত এখনও টাটকা। শারীরিক ক্ষতও হিসেবহীন। বোমা-বারুদের বিস্ফোরণে পুড়েছে একাধিক মানুষের শরীর। বাদ যায়নি শিশুও। পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রোজই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে, শুধু গণমাধ্যমে তা নিয়ে সচরাচর কথা ওঠে না বলে, আমরাও অজ্ঞানতার গহিন অন্ধকারে থাকি।

 

আরও পড়ুন: কোভিডের পর আবার বিশ্বজুড়ে হু হু করে ছড়াচ্ছে বিরল ভাইরাস! কতটা ভয়ংকর এই অসুখ?

 

কিন্তু বিস্ফোরণের ফলে দেহের কিছু অংশ পুড়লে, তা সারিয়ে তোলার জন্য তেলাপিয়া মাছের চামড়া ব্যবহার কি সম্ভব? কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলা হচ্ছে বলে মনে হতেই পারে। জার্নাল অফ সার্জিক্যাল কেস রিপোর্টস-এ, ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় একটি গবেষণা। যেখানে বলা হয় ব্রাজিলের একটি হাসপাতালে তেইশ বছরের এক যুবক ভর্তি হন শরীরের কিছু অংশ গানপাউডারের বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়ার কারণে। তেলাপিয়ার চামড়া দিয়ে তাঁর শরীরের পুড়ে যাওয়া অংশের চিকিৎসা করার পর, আবার নতুন করে তাঁর ক্ষততে চামড়া তৈরি হয়। সেই গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে, সঠিক পদ্ধতিতে তেলাপিয়া মাছের চামড়া শরীরের পোড়া অংশে প্রয়োগ করে, পুনরায় এপিথেলিয়াম অংশ গড়ে উঠছে বারো থেকে সতেরো দিনের মধ্যেই। আমাদের শরীরের কোনও অঙ্গ পুড়ে গেলে, বা তা কোনওরকমের তাপ-জনিত আঘাতের শিকার হলে, সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এপিথেলিয়াম। আমাদের শরীরের যে কোনও বাহ্যিক অঙ্গের ত্বক থেকে শুরু করে, দেহের আভ্যন্তরীণ অঙ্গের আবরণ হিসেবে কাজ করে এপিথেলিয়াম। লক্ষ লক্ষ কোশ দিয়ে তৈরি হয় এপিথেলিয়াম নামের এই কলা বা টিস্যু। এদিকে টিস্যু গঠনের একটি মুখ্য উপাদান কোলাজেন নামের একটি প্রোটিন। এপিথেলিয়াল টিস্যুর ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটে না। বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষেত্রে এপিথেলিয়ামের কাজ বিভিন্ন। ত্বকে উপস্থিত এপিথেলিয়ামের প্রাথমিক কাজ, বাহ্যিক আঘাত, আক্রমণ, সংক্রমণ থেকে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে রক্ষা করা।

 

যে কোনও কোশের মতো, এপিথেলিয়ামের কোশগুলি একত্রিত হয়ে এপিথেলিয়াম কলা গঠন করে। কিন্তু তার জন্য একটি কোশের পাশে আরেকটি কোশ এসে বসে, কোশগুলির একসঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে থাকা প্রয়োজন। আর কোশগুলিকে এইভাবে জোটবদ্ধ রাখে কোশের বাইরে থাকা সান্দ্র পদার্থ, যাদের বিজ্ঞানের পরিভাষায় এক্সট্রাসেলুলার ম্যাট্রিক্স বলে। ত্বকের এপিথেলিয়াল কোশের আশপাশে অবস্থিত এক্সট্রাসেলুলার ম্যাট্রিক্সের একটি অন্যতম উপাদান হল কোলাজেন। এক্সট্রাসেলুলার ম্যাট্রিক্স শুধু কোশগুলিকে পাশাপাশি সংঘবদ্ধ রাখে না, সঠিকভাবে তাদের সজ্জিত থাকতে সাহায্য করে, যাতে কোনও কলা থেকে অঙ্গ গঠনের সময়ে, অঙ্গগুলি সঠিক আকার ধারণ করতে পারে।

 

কোলাজেনের সহজলভ্য এবং সস্তা উৎস হলো তেলাপিয়া মাছের চামড়া। দেখা গেছে, তেলাপিয়া মাছের চামড়ায় উপস্থিত কোলাজেন পোড়া অংশে নতুন কোশ জন্মাতে সাহায্য করে, এবং নতুন তৈরি হওয়া কোশগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে সংঘবদ্ধ রেখে সুস্থ, ক্ষতহীন, নিরবচ্ছিন্ন নতুন ত্বক গঠনে সাহায্য করে।

 

চিকিৎসাবিদ্যার যে শাখাটিতে নতুন দেহে কোশ উৎপাদন; ক্ষতিগ্রস্ত কোশ, কলা বা অঙ্গের মেরামত বিষয়ক আলোচনা করা হয়, তাকে রিজেনারেটিভ মেডিসিন বলে। রিজেনারেটিভ মেডিসিন, অর্থাৎ চিকিৎসার মাধ্যমে দেহে নতুন কোশের জন্ম দিতে প্রয়োজন তিনটি উপাদানের: কোশ, পুষ্টি-উপাদান, এবং স্ক্যাফোল্ড মেটেরিয়াল। স্ক্যাফোল্ড মেটেরিয়ালগুলো একাধিক কোশের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে, তাদের কার্যকর টিস‍্যু বা কলাতে পরিণত হতে সাহায্য করে। দেহের ক্ষত বা পোড়া অংশে নতুন কোশ তৈরি হতে গেলে, এই তিনটি পদার্থের যুগপৎ প্রভাব থাকতেই হবে, একটিকে ছাড়া আরেকটি সম্ভব না।

 

কয়েক বছর আগে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে, তেলাপিয়ার চামড়ায় উপস্থিত কোলাজেন যখন আমাদের আহত ত্বকের সংস্পর্শে আসে, তখন সেই কোলাজেন আমাদের ত্বকে এপিডারমাল গ্রোথ ফ্যাক্টার এবং ফাইব্রোব্লাস্ট গ্রোথ ফ্যাক্টরকে কার্যকরী করে তোলে। এই দুই গ্রোথ ফ্যাক্টরের কারণে ত্বকে ফাইব্রোব্লাস্ট ও কেরাটিনোসাইট কোশ গঠন শুরু হয়। ফাইব্রোব্লাস্ট ও কেরাটিনোসাইট কোশ আবার ত্বকের গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ দু'টি কোশ। পুড়ে যাওয়া ত্বক পুনরায় তৈরি হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই দুই কোশ।

 

পাশাপাশি মৃদু বৈদ্যুতিক শক্তি প্রয়োগ করে, তেলাপিয়ার চামড়ায় থাকা কোলাজেন ফাইবারের গঠনগত পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সেই কোলাজেন শরীরের পোড়া অংশে প্রয়োগ করলে, তা কেরাটিনোসাইট কোশ তৈরি হতে সাহায্য করে।

 

২০১৬ সালে এলসিভিয়ার নামের জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, কোলাজেন পোড়া ত্বকের সংস্পর্শে এসে একাধিক জিনকে সক্রিয় করে তোলে, সেই জিনগুলি আবার ত্বকের সদ্য তৈরি হওয়া  কোশকে পরিণত হতে সাহায্য করে। ফলে ত্বক সুপরিণত গঠন লাভ করে।

 

তেলাপিয়ার চামড়ায় থাকা কোলাজেন, ইনভোলিউক্রিন, ফিলাগ্রিন জিনকে সক্রিয় করে তুলে, এই প্রোটিনগুলোকে নতুন করে তৈরি হতে সাহায্য করে। এই গবেষণাটি করেন চিনের শাংহাই জিয়াটং ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের একদল গবেষক। ইনভোলিউক্রিন, ফিলাগ্রিন- এই দু'টি প্রোটিনই ত্বকের গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় দু'টি প্রোটিন।

 

প্রশ্ন আসতে পারে, এত কিছু থাকতে তেলাপিয়া মাছেরই চামড়া কেন। স্ক্যাফোল্ড মেটেরিয়াল হিসেবে তেলাপিয়া মাছের চামড়া অত্যন্ত ভরসাযোগ্য। তার কারণ মূলত পাঁচটি। প্রথমত, এরা বায়োকম্প্যাটিবল অর্থাৎ, শরীরের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া এরা দেখায় না; দ্বিতীয়ত, এরা দেহের সংস্পর্শে এলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা সক্রিয় হয়ে ওঠে না, ফলে রোগপ্রতিরোধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। অন্য কোনও প্রাণীর চামড়া প্রয়োগ করলে এই দুইয়েরই প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নতুন কোশের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা আছে তেলাপিয়া মাছের চামড়ার।

 

অন্যান্য মাছের কোলাজেন খুব অল্প তাপমাত্রাতেই নষ্ট হয়ে যায়। এমনকী, মানুষের দেহের সংস্পর্শে এলেও এরা গলে যেতে আরম্ভ করে। অন্যদিকে তেলাপিয়া মাছের চামড়া ছত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অবধি নষ্ট হয় না।

 

তেলাপিয়ার মতো সস্তা, সহজলভ্য (এবং অবহেলিতও বটে) একটি প্রাণী যুদ্ধের শারীরিক ক্ষতকে অবলীলায় সারিয়ে তুলতে পারে।

 

More Articles