কোভিডের পর আবার বিশ্বজুড়ে হু হু করে ছড়াচ্ছে বিরল ভাইরাস! কতটা ভয়ংকর এই অসুখ?
মাঙ্কি পক্সের সংক্রমণ রুখতে খুব সম্ভবত কনটেনমেন্ট স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করতে হবে না, কোভিডের ক্ষেত্রে যা আবশ্যক ছিল।
বর্তমানে আফ্রিকার বাইরে অন্তত এগারোটি দেশে ১২০-র বেশি মানুষ মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত করা হয়েছে বা আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।সাধারণত আফ্রিকার বাইরে হয় না যে অসুখ, সেই অসুখ বর্তমানে ছড়িয়ে পড়ছে নানা দেশে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলেসের এপিডেমিওলজিস্ট অ্যান রিমোয়েন এক দশকের বেশি সময় যাবৎ আফ্রিকার কঙ্গোতে মাঙ্কি পক্স নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, মাঙ্কি পক্সের এই ধরনের সংক্রমণ বেশ চিন্তার।
কীভাবে ছড়ায় মাঙ্কি পক্স?
১৯৫৮ সালে গবেষণাগারে রাখা বাঁদরদের মধ্যে প্রথম এই রোগের সন্ধান পাওয়া যায়। আর সেই জন্যই নাম রাখা হয় মাঙ্কি পক্স। ভাইরোলজিস্টদের ধারণা ছিল, এই মাঙ্কি পক্স বন্যপ্রাণী, যেমন ইঁদুরগোত্রীয় জীব থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এবং মাঙ্কি পক্সে সংক্রমিত মানুষের থেকে অন্য মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
আফ্রিকায় প্রায় প্রতি বছরই গড়ে কয়েক হাজার মানুষ মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত হন, বিশেষ করে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বাসিন্দারা।
আরও পড়ুন: পৃথিবীজুড়ে ফিরছে এই সংক্রামক রোগ, আক্রান্ত ভারতও! কতটা ক্ষতিকর, প্রতিকার কী?
কিন্তু আফ্রিকার বাইরে মাঙ্কি পক্স সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বিরল। কিন্তু ১৯৭০ সালে যখন সর্বপ্রথম মাঙ্কি পক্স মানুষকে সংক্রমিত করে, তারপর থেকে আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডের বাইরে এই প্রথম এতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আর যেভাবে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিজ্ঞানীদের কাছে ভ্রূকূটির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাঙ্কি পক্স কি কোভিডের মতোই আতঙ্কের?
এখনও অবধি যা দেখা গেছে, মাঙ্কি পক্সের ভাইরাস, নভেল করোনাভাইরাসের মতো সংক্রমিত ব্যক্তিদের থেকে খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে না। নভেল করোনাভাইরাস ছড়ায় মূলত এরোসলের মাধ্যমে, কিংবা কথা বলা, হাঁচি-কাশির সময়ে, মুখ বা নাক থেকে নির্গত থুতু বা সর্দির কণা, যা বাতাসে কয়েক কিলোমিটার অবধি ভেসে যেতে পারে বা বাতাসে ভাসমান থাকতে পারে বেশ কিছু সময়, তার থেকেই। মাঙ্কি পক্সের ভাইরাস লালারস বা দেহরস থেকে ছড়ালেও, এই ভাইরাস বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকে না। অর্থাৎ, নভেল করোনাভাইরাসের মতো একসঙ্গে অনেক মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা মাঙ্কি পক্সের নেই।
তাছাড়া পক্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী টীকাকরণও হয়েছে। পক্স ভাইরাস-বিরোধী টিকা বা ভ্যাকসিন, মাঙ্কি পক্সের হাত থেকেও সুরক্ষা প্রদান করে।
এখনও অবধি মাঙ্কি পক্সের জিনগত তথ্য বলছে, পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে পাওয়া মাঙ্কি পক্স ভাইরাসের স্ট্রেনের সঙ্গে জিনগত মিল আছে পশ্চিম আফ্রিকায় পাওয়া মাঙ্কি পক্স ভাইরাসের স্ট্রেনের।
আফ্রিকার এই স্ট্রেনটির থেকে হওয়া মাঙ্কি পক্সের প্রাবল্য ভীষণ কম এবং মৃত্যুর হারও অত্যন্ত কম। আর এই স্ট্রেনটি সচরাচর আক্রমণ করে অনুন্নত এলাকার গরিব জনসংখ্যার এক শতাংশকে। অন্যদিকে মাঙ্কি পক্স ভাইরাসের অন্যান্য স্ট্রেনগুলি আফ্রিকার অনেক বেশি জনসংখ্যাকে আক্রমণ করে। তবে বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া ভাইরাস স্ট্রেনটির সাথে, পশ্চিম আফ্রিকায় পাওয়া স্ট্রেনটির জিনগত মিল কত শতাংশ, তা এখনও অজানা।
ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের এপিডেমিওলজিস্ট রায়না ম্যাকলেন্টায়ারের মতে, নভেল করোনাভাইরাসের মতো মাঙ্কি পক্স ভাইরাস এত দ্রুত মিউটেট করে নতুন স্ট্রেন গঠন করতে পারে না। তার অন্যতম কারণ, এই দু'টি ভাইরাসের মধ্যস্থ নিউক্লিক অ্যাসিডের তারতম্য। নভেল করোনাভাইরাসের শরীরে নিউক্লিক অ্যাসিড হল আরএনএ বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। এই আরএনএ-ই নভেল করোনাভাইরাসের জেনেটিক বস্তু। অন্যদিকে, মাঙ্কি পক্স ভাইরাসে নিউক্লিক অ্যাসিড হিসেবে উপস্থিত থাকে ডিএনএ বা ডি-অক্সি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। মাঙ্কি পক্সের ক্ষেত্রে আবার ডিএনএ-ই এদের জেনেটিক বস্তু। ডিএনএ ভাইরাস, আরএনএ ভাইরাসের মতো এত দ্রুত এবং এত সহজে মিউটেট করতে পারে না। আরএনএ-তে মিউটেশন বা রাসায়নিক পরিবর্তন যত সহজে হয়, ডিএনএ-তে তা হয় না। আর নতুন স্ট্রেন তৈরি হয় মিউটেশন হলেই। তাই অন্যান্য ডিএনএ ভাইরাসেও মাঙ্কি পক্সের মতো এত সহজে নতুন স্ট্রেন তৈরি হয় না।
তাছাড়াও কোভিড লক্ষণহীণ বা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হতে পারে,।মাঙ্কি পক্সের ক্ষেত্রে কিন্তু স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায়। তাই সেক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা কোভিডের থেকে অনেক সোজা হয়।
তবে মাঙ্কি পক্সের প্রবণতা কুড়ি থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সি পুরুষদের মধ্যে বেশি, বিশেষত যারা সমকামী, উভকামী বা পুরুষদের সঙ্গে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হন। যদিও মাঙ্কি পক্স ভাইরাসকে যৌনতার মাধ্যমে বাহিত ভাইরাস বলা যায় না, কিন্তু তা কেন দু'টি পুরুষের যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে ছড়ায়, তা এখনও অজানা।
মাঙ্কি পক্স প্রতিরোধের উপায়?
১৯৭০ সাল নাগাদ যখন প্রথমবার মাঙ্কি পক্স ভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করা শুরু করে, তখন থেকেই স্মল পক্স বা গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে সতর্কতা প্রচারের সময়, মাঙ্কি পক্সের সংক্রমণের বিরুদ্ধেও সতর্ক করা হতো আফ্রিকায়।
তবে আফ্রিকায় বেশ বড় মাপের মাঙ্কি পক্স সংক্রমণ ঘটেছে ২০১৭ সালেই। অন্যদিকে, আফ্রিকার বাইরের মহাদেশগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঞ্চলে ২০০৩ সালে ছড়ায় মাঙ্কি পক্স।
সুতরাং, মাঙ্কি পক্স ও তার প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিষয়ে ভাইরোলজিস্টরা একেবারে অজ্ঞ নন। জৈব সন্ত্রাস রুখতে কিছু পরিমাণ স্মল পক্সের ভ্যাক্সিন সবসময় মজুতও থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজি়জ়্ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর পক্স ভাইরাস টিমের মুখ্য ভাইরোলজিস্ট অ্যান্ড্রিয়া ম্যাককোলামের মতে, সেই সুবিধা হয়তো বহুল পরিমাণ মানুষ পাবেন না। তাঁর মতে, মাঙ্কি ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে হয়তো 'রিং ভ্যাক্সিনেশন' পদ্ধতির প্রচলন করা হবে। অর্থাৎ, সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে যাঁরা আসবেন, তাঁদেরই একমাত্র ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
ম্যাককোলামের মতে, মাঙ্কি পক্সের সংক্রমণ রুখতে খুব সম্ভবত কনটেনমেন্ট স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করতে হবে না, কোভিডের ক্ষেত্রে যা আবশ্যক ছিল। তবে তাঁর মতে, মাঙ্কি পক্স একটি বিরল অসুখ এবং যেভাবে অসুখটি আফ্রিকার বাইরে ছড়াচ্ছে, তা যথেষ্ট চিন্তার। তবে, আতঙ্কের নয়।