'কাশ্মীর ফাইলস' ছবিজুড়ে 'অশ্লীল প্রচার'! ইজরায়েলি পরিচালকের মন্তব্যে দেশজুড়ে শোরগোল

The Kashmir Flies: ইফির মঞ্চে ইজরায়েলি পরিচালকের বক্তব্য ফের বিতর্কে উস্কানি দিল। 'কাশ্মীর ফাইলস' নিয়ে এখন চলছে নানা তরজা...

আইএফএফআই বা ইফি। পুরো নাম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল অফ ইন্ডিয়া। আপাতত নেট দুনিয়ায় ট্রেন্ডিংয়ের শীর্ষে আন্তর্জাতিক সিনেমার এই মঞ্চ। কারণটা কী? এই বছর পানাজিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৫৩ তম আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভাল অফ ইন্ডিয়া। সেখানেই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রির ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’। এই বিভাগ নিয়ে কথা বলতে গিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত। জুড়ি বিভাগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইজরায়েলি পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার নাদাভ লাপিড। সেখানেই তিনি প্রকাশ্যে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটির বিরুদ্ধেকথা বলেন। তাঁর মতে, এই বিভাগের অন্য ১৪ টি সিনেমা অত্যন্ত ভালো। কিন্তু ‘কাশ্মীর ফাইলস’ একটি ‘অশ্লীল’, ‘প্রোপাগান্ডামূলক’ ছবি। তাঁর ভাষায়, “এই সিনেমাটির জায়গা পাওয়া নিয়ে আমরা অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছি।” আন্তর্জাতিক মঞ্চে শিল্পের জয়গান গাইতে গিয়ে কোনওভাবেই এই ছবিকে তিনি নিজের ভাবনায় রাখতে পারছেন না। তিনি এও বলেছেন, শিল্পের স্বার্থে সবরকম গঠনমূলক সমালোচনাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

আগুনে ঘি ফেলার জন্য এটুকু বক্তব্যই ছিল যথেষ্ট। যার রেশ এখনও চলছে সর্বত্র। সিনেমাটির অভিনেতা অনুপম খের, দর্শন কুমাররা কড়া সমালোচনা করেছেন এমন মন্তব্যের। ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে ময়দানে নেমে পড়েছে ইজরায়েল সরকারও। ইজরায়েলের কাউন্সিল জেনারেল টুইট করে জানিয়েছেন, নাদাভ লাপিডের সঙ্গে তিনি একেবারেই একমত নন। ভারতে ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূত নাওর গিলনও টুইটারে খোলা চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ভারতের মতো অতিথিকে অসম্মান করেছেন পরিচালক। ভারত আর ইসরায়েলের সম্পর্ক খব ভালো। তাই নাদাভ লাপিডকে অবিলম্বে ক্ষমা চাইতে হবে।    

আরও পড়ুন : কাশ্মীর ফাইলসের পর রামসেতু! বিনোদনই তবে বিজেপির ব্রেনওয়াশের মূল অস্ত্র! 

অবশ্য ‘কাশ্মীর ফাইলস’-কে নিয়ে এমন অভিযোগ নতুন নয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে মুক্তির পর থেকে নাগাড়ে চলছে বিতর্কের রেশ। প্রোপাগান্ডাভিত্তিক সিনেমা – এই অভিযোগও আগে করা হয়েছে। সিনেমার মূল প্লট দাঁড়িয়ে আছে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০-এর কাশ্মীরে। সেখানকার কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ওপর হওয়া অত্যাচার এবং তাঁদের উৎখাত হওয়ার ঘটনাই সিনেমাটির মূল উপজীব্য। বিষয়টি নিজের দিক থেকেই যথেষ্ট বিতর্কিত, এবং প্রবলভাবে রাজনৈতিক। সেই সময় থেকে আজও বারবার ভারতের রাজ্য রাজনীতির চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কাশ্মীর এবং কাশ্মীরী হিন্দিদের ওপর হওয়া নিপীড়ন। মনে রাখা ভালো, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির প্রচার ইস্তেহারের অন্যতম প্রধান অংশই ছিল কাশ্মীর। তারপরেই আমরা দেখেছি ৩৭০ ধারা বাতিল। দেখেছি কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা। ইতিহাস সাক্ষী থেকেছে অনেক অত্যাচারের। সেই সমস্ত ঘটনাই একে একে এসে হাজির হয়েছে ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর সূত্র ধরে।

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, ১৯৮৯-১৯৯০ সালে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ওপর হওয়া অত্যাচারের ঘটনা একেবারেই অমূলক নয়। সিনেমায় কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ওপর হওয়া অত্যাচারের যে দৃশ্যগুলি দেখানো হয়েছে, তার সবগুলোই অত্যন্ত বাস্তব। মহিলাদের ধর্ষণ, আট থেকে আশি সবাইকে গুলি করে হত্যা করা, গিরিজা টিক্কুকে ধর্ষণ করে জীবন্ত অবস্থায় শরীর দু’ভাগ করে দেওয়া – সমস্তটাই সত্যি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় এল লাখ হিন্দু কাশ্মীরী পণ্ডিতরা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। প্রায় ৮০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। অবশ্য ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অন্তত ২১৭ জন কাশ্মীরী হিন্দুদের খুন করা হয়েছিল। ইসলাম জিহাদের ঘটনায় এমন হত্যাকাণ্ড, সেটাও ইতিহাস স্বীকার করে। ‘রালিভ গালিভ ইয়া চালিভ’ কিংবা ‘আল-সাফা বাট্টে দাফা’র মতো শ্লোগানও সত্য।

আরও পড়ুন : কুখ্যাত ২২ অক্টোবরের স্মৃতি আজও দগদগে! কোনও দিন কি ফুরোবে কাশ্মীরের ‘কালো অধ্যায়’?

কিন্তু এমন ভয়ংকর সত্যের আড়ালে থেকেই খুব সূক্ষ্মভাবে চালানো হয়েছে ‘প্রোপাগান্ডা’। না, এমনটা লেখকের বক্তব্য নয়। খোদ পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রিই বলেছেন, তিনি নিছক গল্প বলার জন্য সিনেমা বানান না। তাঁরও একটি নির্দিষ্ট ‘এজেন্ডা’ আছে। ব্যক্তিমানুষের অবশ্যই রাজনৈতিক মতামত থাকবে। তাঁর মতামতটি কী? ‘কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তি পাওয়ার পর একটি ভিডিওতে তিনি কংগ্রেস সহ ভারতের বিরোধীদের ‘সবক’ শেখাচ্ছেন। সেখানে বলছেন, বিরোধীদের সমস্ত রকম অপপ্রয়াস ও এজেন্ডা ব্যর্থ। ২০১৮ সালে তিনি টুইটারে ঘোষণা করলেন, বিবিসির সমীক্ষা অনুযায়ী কংগ্রেস নাকি পৃথিবীর দ্বিতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দল। সেখানেও না থেমে তিনি বললেন, কানহাইয়া কুমার নাকি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। বক্তব্যের সত্যতা দেখানোর জন্য একটি ভিডিও পেশ করেন তিনি। পরে অবশ্য জানা যায়, ভিডিওটি সম্পূর্ণ ভুয়ো। তাঁর দাবি ছিল, জওহরলাল নেহরু ১৯৬৫-এর ভারত-চিন যুদ্ধের ফলাফলের জন্য দায়ী। অথচ, নেহরু প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে!

ঘটনা আরও আছে; কিন্তু তথ্যের ভার বাড়ানো কাম্য নয়। ঠিক কোন রাজনীতি, কোন এজেন্ডা, প্রোপাগান্ডাকে সমর্থন করেন বিবেক অগ্নিহোত্রি? ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এ ইতিহাসের রাংতার আড়ালে আসল ‘মশলা’টাই বা কী? সেটা জানতে গেলে সিনেমার আরেকটি অংশে যেতে হবে। সেখানে দেখানো হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যার নাম ‘এএনইউ’। যেখানে ‘আজাদি’র শ্লোগান ওঠে, যেখানে গাওয়া হয় ‘হাম দেখেঙ্গে’। সেই বিশ্ববিদ্যালয়তেই পড়ে এক কাশ্মীরী ছাত্র, যার পরিবার কাশ্মীরের জেনোসাইডের শিকার। দেখানো হয়েছে, কাশ্মীরে গিয়ে সে ‘আসল সত্য’ খুঁজে পায়। এবং এও জানতে পারে, তাঁর ‘এএনইউ’ বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক মহিলা অধ্যাপক ‘জঙ্গি’দের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আছেন। তার আগেই কাশ্মীরী পণ্ডিতের হাতে (অনুপম খের অভিনীত চরিত্র) দেখা যায় ৩৭০ ধারা বাতিলের ব্যানার।

আরও পড়ুন : কাশ্মীর থেকে করোনা, ভারতের প্রকৃত ছবি লেন্সে ধরার মাশুল গুনতে হচ্ছে সানা ইরশাদ মাট্টুকে?

এই পুরো গল্পটি চেনা পরিচিত লাগছে, তাই না? এএনইউ যে দিল্লির জেএনইউ বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আজাদির শ্লোগানও সেখানেই উঠেছিল। এর আগে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি বারবার জেএনইউকে এই বিষয়ে আক্রমণ করে গিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদের শিক্ষা দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান, এটাই ছিল ‘এজেন্ডা’। এর পাশাপাশিই সামনে আসে আরবান নকশালের মতো শব্দবন্ধ। যেটা সম্ভবত পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রিরও খুবই পছন্দের। যারাই এমন মতামতের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাঁদের এই তকমা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁরা সেকুলার, হিন্দুবিদ্বেষী। কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ইস্যু তুলে ধরে বারবার প্রচার চালিয়েছে বিজেপি। সেই প্রচারেরই কি মুখপত্র হিসেবে উঠে এল ‘কাশ্মীর ফাইলস’? মুক্তির পরপরই সিনেমাটিকে কর ছাড়ের ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও, ‘ওপরমহলের নির্দেশমতো’ বিজেপি নেতারা সবাই বাসে করে, দলে দলে সিনেমা হলে গিয়ে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ দেখেন। অন্য কোনও সিনেমার ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা কি করেছেন তাঁরা? মনে তো পড়ে না…

আরও পড়ুন : একদিকে জঙ্গিদের হুমকি, অন্যদিকে প্রশাসন || কাশ্মীরে যেভাবে বাঁচেন সাংবাদিকরা

বিবেক অগ্নিহোত্রিকে একটাই প্রশ্ন, গুজরাট সম্পর্কে আপনার ‘এজেন্ডা’ আপনাকে কী বলে? নতুন কোনও চিত্রনাট্য সামনে আসে কি? ইফির দর্শকাসনে বসেছিলেন বিজেপি নেতা ও ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। সেই অনুরাগ ঠাকুর, যিনি শাহিনবাগের আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে, সিএএ-কে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘গোলি মারো শালো কো।’ এখানে কীসের এজেন্ডা সামনে আসে? শেষে আসা যাক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা। ‘কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তির পর তিনি বলেছিলেন, “সত্যিকে অনেকদিন ধরে চেপে রাখা হয়েছে। যে সেই সত্যকে সামনে তুলে আনছে, তাঁকে সবাই মিলে আক্রমণ করছে। যারা ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের কথা বলেন, তাঁরা এখন সমস্যায় পড়েছেন।”

‘কাশ্মীর ফাইলস’-এ কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ওপর হওয়া অন্যায়ের কথা বলা হয়েছে, সত্য। তার ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, এও সত্য। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করার স্পর্ধা কারও নেই। কিন্তু সেই নৃশংস ইতিহাসকে ঢাল করে যে তত্ত্ব দেখানো হয়েছে, সেটা কি সত্য? ‘প্রোপাগান্ডা’, ‘এজেন্ডা’র মতো শব্দ সেই অংশে এসে বসছে। এর ফলে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের কান্না এখনও থামেনি। ভোটের ইস্যু হয়েই থেকে গিয়েছেন তাঁরা।

More Articles