কাশ্মীর ফাইলসের পর রামসেতু! বিনোদনই তবে বিজেপির ব্রেনওয়াশের মূল অস্ত্র!
Ram Setu Movie: এক নাস্তিক ইতিহাসবিদের রাম সেতুর অলৌকিকতা নস্যাতের দায়িত্ব পালন এবং ক্রমশ সেই দায়িত্ব পালনের মধ্যেই ফিরে পাওয়া আস্তিকতা এবং এক বিশ্বাসের আবহ তৈরি করেছে এই সিনেমা।
সিনেমা-সমাজ, সংস্কৃতি। চলমান সভ্যতায় এর প্রভাব নিরন্তর। প্রত্যেক মুহূর্তে একাকী হয় প্রত্যেকটি অনুষঙ্গ। আর ঠিক এই অনুষঙ্গের সূত্রেই বারবার বিবর্তিত হয় বিনোদনের মাধ্যম, বিনোদনের নির্ভরতা। এর মধ্যেই জড়িয়ে যায় রাজনীতি, বিতর্ক এবং জল্পনা। আর এই আবহেই ফের সিনেমার রাজনীতি, রাজনীতির সিনেমা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে। এবারও প্রশ্ন উঠছে এক-একটি সিনেমার মধ্যে দিয়ে কীভাবে নির্দিষ্ট ভাবনা, নির্দিষ্ট একটি দলের সত্তা-নীতি, আদর্শের বিচ্ছুরণ ঘটছে বারবার!
কেন বলা হচ্ছে এমন?
রাজনৈতিক মহলের একাংশ শুধু নয়, বঙ্গের সিনেমা মহলের একাধিক মহীরুহ বলছেন, আজ নয় বরং অনেক আগে থেকেই এক অংশের প্রভাবশালীরা নিজের অথবা নিজেদের ভাবনার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন বারবার। কিছু ক্ষেত্রে তা কমেছে। কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করেছ ইদানিংকালে। যেখানে সিনেমা, মৌলিক ভাবনা-বিনোদন ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছে একেবারে কেন্দ্রীভূত রাজনীতির আবহ আর কৌশলের অন্তরালে। কেন? এর কারণ হিসেবে অনেকেই বলছেন, একটা বড় অংশের দর্শককে সিনেমার মাধ্যমেই প্রভাবিত করা যায় বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন এবং তা করা যায় বলেই খানিকটা 'ব্রেনওয়াশ' করার ঢঙে সিনেমা তৈরি করে, সেই প্রভাব ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অপরিপক্ক ব্রেনে, যা দীর্ঘমেয়াদি লাভ দেয় রাজনৈতিক ভাবধারাকে অথবা রাজনৈতিক দলগুলোকে।
কিসসা কুর্সি কা (১৯৭৭)
ধরা হয়, ভারতবর্ষের সিনেমা ইতিহাসে এটিই প্রথম সিনেমা যা রাজনীতি এবং সিনেমার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল। যেখানে একজন মূক রাজনৈতিক দলের প্রধানের চরিত্র ঝড় তুলেছিল। ইন্দিরা গান্ধী-সঞ্জয় গান্ধী-জরুরি অবস্থার আবহে এই সিনেমা যে ইন্দিরা গান্ধীকে লক্ষ্য করেই, একথা শোনা যায় তখনই। এই সিনেমা সমালোচনার মুখোমুখি যেমন হয়, তেমনই ইন্দিরা-আবহে একটা বড় অংশের দর্শকের মধ্যে ইন্দিরা সংক্রান্ত ভাবনার খানিকটা পরিবর্তন ঘটায়।
বেশ কয়েক দশক রাজনৈতিক সিনেমা বা সিনেমার রাজনীতি নিয়ে খুব একটা জল্পনা তৈরি না হলেও দেখা যায় ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগেই এর প্রভাব বেড়েছে নিরন্তর। যেখানে অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বলা হয় 'উরি' সিনেমাকে।
আরও পড়ুন- ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’ বন্ধ হয়ে গেলে কার অসুবিধা সবচেয়ে বেশি?
উরি-দা সার্জিকাল স্ট্রাইক (২০১৯)
লোকসভা নির্বাচনের আগে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার প্লট, ভারতীয় সেনা এবং উরির জঙ্গি আক্রমণের বদলা হলেও এর মুক্তির সময় এবং সামগ্রিক ভাবনার দিক নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। কর্নেল কপিল যাদবের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অভিনেতা ভিকি কৌশল প্রশংসা কুড়োলেও এই ছবিতে নরেন্দ্র মোদির ভূমিকায় মহানতা প্রকাশ, কেন্দ্র এবং বিজেপির নৈতিক আদর্শ, ভাবমূর্তিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু উরির ঘটনার ব্যর্থতার দিকটি তুলে ধরা হয়নি। যা সামগ্রিকভাবে প্রশ্ন তুলে দেয় নবীন পরিচালক আদিত্য ধরের ভাবনার প্রকাশ কৌশলের উপর। সরকার এবং দুঃসাহসিক ভারতীয় সেনার তরফে টানটান অভিযানের আদলে মোদি এবং মোদি রাজের ছড়িয়ে থাকা যে ভোটের আগে প্রভাব ফেলেনি, একথা বলেননি কেউই।
দ্য অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার (২০১৯)
লেখক সঞ্জয় বারুর একটি উপন্যাস অনুযায়ী বিজয় গুট্টের এই সিনেমা রীতিমতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের 'ব্যর্থতা' প্রকাশ করেছিল। মূলত, সিনেমার প্লট এবং তার কাহিনির প্রকাশ ক্ষেত্র প্রশ্ন তুলেছিল মনমোহন জমানার গান্ধী নির্ভরতা নিয়ে যা একাধারে মনমোহন, কংগ্রেস এবং গান্ধীদের সার্বিক সরকারি ভূমিকা ব্যক্ত করেছিল। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি যে এই নীতিতে বিশ্বাস করেন না, মানুষের মধ্যে মোদির বিশেষত্ব বিস্তারে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল এই সিনেমা।
নরেন্দ্র মোদি (২০১৯)
উমং কুমারের পরিচালনায় এই সিনেমা মুক্তি পায় লোকসভা নির্বাচনের আবহে। বিবেক ওবেরয় অভিনয় করেন নরেন্দ্র মোদির ভূমিকায়। একটি সিনেমায় দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়। একের পর এক ক্ষেত্রে মোদির সাফল্যের কথা বলা হয় সিনেমায়। রাজনীতি এবং সিনেমার যে সার্থক মেলবন্ধন এই চলচ্চিত্র একথা স্পষ্ট হয়েছিল ছবির ভাবনার প্রকাশকাল থেকেই।
তানাজি (২০২০)
অজয় দেবগন অভিনীত এই ছবির পটভূমিকা ছিল মহারাষ্ট্রের তানাজি মলুসারের জীবনের কথা, মুঘল এবং এই মারাঠা শাসকের যুদ্ধ। সাফল্য এবং হিন্দুত্ববাদের এক তীব্র বিচ্ছুরণ প্রতিফলিত হয় এই ছবির ছত্রে ছত্রে। প্রশ্ন ওঠে এই ছবির গতিপথ এবং প্রকাশের রাজনীতি নিয়ে।
দা কাশ্মীর ফাইলস (২০২২)
বছরের শুরুর দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার আশেপাশে লোকসভা নির্বাচন না থাকলেও এই সময়ে দাঁড়িয়ে, রাজনীতি এবং সিনেমার বিস্তারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক বিতর্ক সৃষ্টি হয় এই ছবিকে ঘিরে। নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীর উপত্যকায় হিন্দু পণ্ডিতদের উপর মুসলমানদের অত্যাচার, তাদের বেঘর করার ভয়াবহ স্মৃতির প্রকাশ ঘটে ওই ছবিতে। যদিও অতুল অগ্নিহত্রীর এই সিনেমায় দেখানো সমগ্র ঘটনা যে সত্যি নয়, অতিরিক্ত ভয়াবহতার প্রকাশ- একথা বলেছিলেন কেউ কেউ। ছবিকে ঘিরে তৈরি হয় বিতর্ক। নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি শাসিত কেন্দ্রের সুবিধা করছে এই সিনেমা, কেউ কেউ বলতে থাকেন একথাও। যদিও দেশজুড়ে শোরগোল পড়লেও ভালোই ব্যবসা করে এই সিনেমা।
রামসেতু (২০২২)
অভিষেক শর্মা পরিচালিত অক্ষয় কুমার অভিনীত সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিকে ঘিরেও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। ফের প্রশ্ন উঠেছে রাজনীতি, ধার্মিক অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিতেই নাকি তৈরি হয়েছে এই ছবি। কেন?
এক নাস্তিক ইতিহাসবিদের রাম সেতুর অলৌকিকতা নস্যাতের দায়িত্ব পালন এবং ক্রমশ সেই দায়িত্ব পালনের মধ্যেই ফিরে পাওয়া আস্তিকতা এবং এক বিশ্বাসের আবহ তৈরি করেছে এই সিনেমা। যেখানে মূলত, রাম আবেগ এবং রামায়ণে বর্ণিত রাম সেতুর অনুষঙ্গে বয়ে গিয়েছে ভাবাবেগের স্রোত, অনুভূতির কথকতা। আর এখানেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। অনেকেই বলছেন, আসল কথা ভাবাবেগের প্রকাশ ঘটানোর জন্য একটি অপ্রমাণিত সত্যকে নিয়ে নাড়াচড়া করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কৌশল এই ছবি! যদিও এই সিনেমার দুর্বল চিত্রনাট্য এখনও পর্যন্ত খুব একটা ভাল সাড়া দেয়নি। কিন্তু হিন্দুত্ব, ইচ্ছা করে প্রোপাগান্ডার প্রভাব বিস্তারের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছেন বিস্তর।
রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং প্রোপাগান্ডা
কিসসা কুর্সি কা থেকে শুরু আজকের রামসেতু, মূলত সিনেমার মাধ্যমেই প্রভাবিত হয় একটা অংশের দর্শক (ব্যাপকার্থে জনতা)। আর সেই সূত্রেই সিনেমাকে ঢাল করে শাসক তার নীতিগত আদর্শের বিচ্ছুরণ ঘটানোর পন্থা খোঁজে সিনেমার হাত ধরেই, বলছেন সংশ্লিষ্ট মহলের বিশেষজ্ঞরা। ঠিক কী বলছেন তাঁরা?
প্রথমত, সিনেমা সমাজের দর্পণ। বরাবর সিনেমায় বর্ণিত যে কোনও কিছুর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সমাজের কথা, সামাজিক ভাবনা। কখনও রূপকে, কখনও সরাসরি। ঠিক এই অবস্থানে দাঁড়িয়েই নিজস্ব ভাবনার প্রকাশের বাহন বানানো যায় সিনেমাকেও।
দ্বিতীয়ত, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। সিনেমা বা থিয়েটার অথবা হাল আমলের ওয়েব সিরিজ, ধারাবাহিক- যেকোনও বিনোদনের মাধ্যম প্রভাব ফেলে। ভালো খারাপ অথবা মানবিক দুবিধার ক্ষেত্রে এই একটি প্রভাব থাকে। আর সেই সূত্রেই রাজনৈতিক কারবারিরা সিনেমার মাধ্যমেও মনের সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন। যা অতি সহজেই গল্প বলার মধ্যেই সফল করা সম্ভব।
বিপরীতমুখী সিনেমা এবং বিতর্ক
বারবার রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে সিনেমার বাড়বাড়ন্ত যতবার হয়েছে ততবার তার উত্তর দিয়েছে সিনেমা। যেমন, হিন্দু মুসলমান বিভেদের মধ্যেও বলিউডের একাধিক সিনেমা সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বললেও প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের কেদারনাথ সিনেমা এক অন্য চিত্রের প্রকাশ করে। ধর্ম, লভ জিহাদের আবহে এই সিনেমা খুব একটা বক্স অফিস সাফল্য না পেলেও সামগ্রিকভাবে স্পষ্ট করে সম্প্রদায়গত বিদ্বেষের। যদিও একাধিক সিনেমায় মোদি বন্দনার আবহে এমন ধারার সিনেমার উদাহরণ খুবই কম। আবার নোটবন্দির সময়ের বিভীষিকা নিয়েও ছবি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই ছবি নিয়ে উন্মাদনার ক্ষেত্র যেন খানিকটা কমেছে অচিরেই। একের পর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে একই ঘটেছে বারবার।
আরও পড়ুন- কুখ্যাত ২২ অক্টোবরের স্মৃতি আজও দগদগে! কোনও দিন কি ফুরোবে কাশ্মীরের ‘কালো অধ্যায়’?
সামাজিক সিনেমায় মোদি জয়গান?
'সুই ধাগা'। সামাজিক কথকতার সঙ্গেই মোদির মেক ইন ইন্ডিয়া, মিশন মিঙ্গল- একাধিক সিনেমা পরোক্ষে যে জয়গান করেছে মোদির, বলছেন অনেকেই।
'সিনেমা বদল করছে মনোভাব'
দ্য কুইন্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ডেইটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাইকেল পৎজ এই সংক্রান্ত বিষয়ে সমীক্ষা চালান। তিনি বলেন, নির্বাচন এবং সিনেমার বিস্তারের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে একটা অংশের নির্বাচককে সিনেমার মাধ্যমে প্রভাবিত করা যায়। অ্যাগ্রো এবং জিরো ডার্ক থার্টির মতো সিনেমা ২০-২৫ শতাংশ দর্শকের মন বদলে প্রভাব বিস্তার করেছিল, যা ক্রমান্বয়ে একটা অংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
এখানেই মনোবিদরা বলছেন, ২ থেকে ২.৩০ ঘণ্টার একটি সিনেমা শুধু নয়, যেকোনও দৃশ্যশ্রাব্য বিনোদন মানুষের অভ্যন্তরে যদি স্পর্শ করে, তার একটা প্রভাব থেকেই যায়। ধরা যাক, কোনও সিনেমা আপনাকে কাঁদাল, অর্থাৎ আপনি দুঃখ পেলেন, আত্মশুদ্ধি ঘটল আপনার। কিন্তু এর যে রেশ, তা আপনার দুঃখ যেমন কমাতে পারে, বিপরীতে আপনার দুঃখ বা বেদনাকে কয়েকদিন বাড়াতে পারবে না- এটাও নিশ্চিত নয়।
তাহলে রাজনীতি? মনের বদল? এখানে প্রায় একই কথা বলছেন সমাজতাত্ত্বিকরাও। তাঁদের দাবি, সমাজ খানিকটা প্রভাবিত করে মনকে। আর সেই সমাজের ঘটে চলা বিষয়বস্তু পরিস্থিতি যখন উঠে আসছে পর্দায়, ঠিক তখনই যে আপনিও খানিকটা প্রভাবিত হবে না, সেটাও বলা যায় না। তাই রাজনীতির সিনেমার মাধ্যমে কিছু অংশের মনবদল হতে বাধ্য।