নেই ব্রেনের অপরিহার্য অংশ, তবুও বহাল তবিয়তে এই মহিলা!

মানুষের মস্তিষ্ক সম্পর্কে আরও গূঢ় রহস্যের সমাধান অদূর ভবিষ্যতে করা যাবে।

২০১৬ সালে ম্যাসাচ্যুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির একদল বিজ্ঞানী মানুষের মস্তিষ্কের ওপর সংগীতের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সেই গবেষণা বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের কাছে একটি ই-মেল আসে। ই-মেলে লেখা, "আপনাদের গবেষণা নিয়ে পড়লাম। আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমার ব্রেনও কিন্তু খুবই ইন্টারেস্টিং। সবার কিন্তু এরকম হয় না।"

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পঞ্চাশোর্ধ্ব এই মহিলার মস্তিষ্কের ডানদিকের একটি নির্দিষ্ট অংশ অনুপস্থিত, খুব ছোটবেলা থেকেই। এই অংশটি বাম টেম্পোরাল লোব। এটি থাকে কানের ঠিক পিছন দিকে। মস্তিষ্কের এই অংশটি মানুষের ভাষাশিক্ষা, অর্থাৎ, এক বা একাধিক ভাষায় কথা বলতে, পড়তে, বুঝতে, লিখতে বা মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, বলা যেতে পারে, মস্তিষ্কে কোনও ভাষার শব্দভান্ডার গড়ে তোলার পিছনেও বা সেই শব্দগুলোর সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে জানার পিছনেও দায়ী বাম টেম্পোরাল লোব।

 

কিন্তু যেহেতু এটি ম্যাসাচ্যুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির এই গবেষকদের গবেষণার বিষয় নয়, তাই মহিলাকে পাঠানো হয় এভেলিনা ফেডোরেনকো-র ল্যাবে। তিনিও ম্যাসাচ্যুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষিকা। এভেলিনার গবেষণার বিষয় কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স। অর্থাৎ, ভাষাগত জ্ঞান কীভাবে মস্তিষ্কে নিয়ন্ত্রিত হয়, এভেলিনা সেই বিষয়ে গবেষণা করেন।

 

আরও পড়ুন: এই বিদেশিনীর হাতের ছোঁয়ায় ভোল বদলাচ্ছে ভারতীয় স্কুল, রইল অসাধ্যসাধনের গল্প

 

এভলিন জানতে পারলেন, টেম্পোরাল লোব না থাকার পরেও উক্ত মহিলা উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন, শুধু তাই নয়, নজর কাড়ার মতো পেশাতেও ভদ্রমহিলা নিযুক্ত ছিলেন। ইংরেজির পাশাপাশি তিনি রুশ ভাষাতেও পারদর্শী। রুশ ভাষায় তাঁর পারদর্শিতা এতটাই, যে তিনি রুশ ভাষাতেও স্বপ্ন দেখেন। কোনও ভাষাতে মানুষ তখনই স্বপ্ন দেখতে পারে, যখন সেই ভাষায় সে শুধু কথা বলতে বা লিখতে পারে এমনই নয়, সেই ভাষাতে সে ভাবতেও পারে।

 

সোজা কথায় ভদ্রমহিলার বাম টেম্পোরাল লোব না থাকার পরেও তিনি দু'টি ভাষাতেই অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। এবং ইংরেজি ও রাশিয়ান, এই দুই ভাষাতেই তাঁর আভিধানিক জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়।

 

১৮৮৭ সালে কোনও এক কারণে (যা তাঁর ভাষাগত এবং অন্যান্য জ্ঞানের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন) তাঁকে মস্তিষ্ক স্ক্যান করতে হয়। তখনই সেই বৃদ্ধা প্রথম জানতে পারেন, তাঁর বাম টেম্পোরাল লোব নেই বহুদিন ধরেই। ডাক্তাররা জানান, খুব ছোটবেলায় সম্ভবত ব্রেন স্ট্রোকের কারণে এই অংশ অবলুপ্ত হয় এবং স্ট্রোকটি যে ঘটেছে, সেই বিষয়ে মহিলা জানতেন না। একজন ডাক্তার তো জানিয়েই দেন যে, ভবিষ্যতে তাঁর মস্তিষ্কে জটিল সমস্যা দেখা দেবে। কিছু না হলেও, তাঁর ভাষাশিক্ষার পথে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বাম টেম্পোরাল লোবের অনুপস্থিতি।

 

মস্তিষ্কের সেই জায়গায় এখন কেবল সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড আছে। সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড একপ্রকার তরল অংশ, যা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, অর্থাৎ আমাদের মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ডকে ঘিরে রাখে।

 

এভেলিনা ফেডোরেনকো জানাচ্ছেন, ভাষার প্রক্রিয়াকরণ ঘটে মূলত মস্তিষ্কের বাম অংশ বা লেফট হেমিস্ফিয়ারে । কারও ক্ষেত্রে আবার ভাষার প্রক্রিয়াকরণের এই দায়িত্ব মস্তিষ্কের বাম ও ডান, দুই অংশই সমানভাবে নেয়।

 

খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভাষা প্রক্রিয়াকরণের এই জটিল কাজ বাম হেমিস্ফিয়ারের বদলে ডান হেমিস্ফিয়ারই করছে। এই ধরনের ঘটনা কেন ঘটে, বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও তা অজানা।

 

তবে যদি কোনও ব্যক্তি বাম-হাতি হয়, সেক্ষেত্রে তাঁর ভাষার প্রক্রিয়াকরণ হয় মস্তিষ্কের ডান হেমিস্ফিয়ারে, জানাচ্ছেন গ্রেটা টাকাটে, যিনি এই বৃদ্ধাকে নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

 

ভাষার প্রক্রিয়াকরণ মূলত বাম হেমিস্ফিয়ারের ফ্রন্টাল এবং টেম্পোরাল অঞ্চলে হয়। ফ্রন্টাল লোব মস্তিষ্কের একদম সামনের দিকে থাকে। অন্যদিকে টেম্পোরাল লোব থাকে কানের ঠিক পিছনদিকে, যা প্রতিবেদনের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের গঠন যখন শুরু হয়, তখন টেম্পোরাল লোব আগে গঠিত হয়। তারপর পাঁচ বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে ফ্রন্টাল লোব গঠিত হয়। ধারণা করা হয়, কোনও ভাষা বুঝতে পারা ও বলার উপযোগী যে গঠন মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়, মানুষের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর বয়সে সেই গঠনের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যায়।

 

আর যেহেতু এক্ষেত্রে এই মহিলার বাম টেম্পোরাল লোব অনুপস্থিত, গবেষকরা ভাবতে বসেছেন, টেম্পোরাল লোব কি আদৌ প্রয়োজনীয়, ভাষা শিক্ষার জন্য? না কি সেই কাজ ফ্রন্টাল লোব একাই করতে পারে?

 

তার সদুত্তরও পাওয়া গেল। দেখা গেল, টেম্পোরাল লোব ছাড়া ফ্রন্টাল লোব একা ভাষাশিক্ষার কাজ সম্পন্ন করতে পারছে না এই মহিলার ক্ষেত্রে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহিলার ফ্রন্টাল লোব যথেষ্ট কার্যকারিতার প্রমাণ দিল, যখন তাঁকে গাণিতিক সমাধান করতে দেওয়া হলো। আর যখন তিনি গাণিতিক সমাধান করতে ব্যস্ত, গবেষকরা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজো়নেন্স ইমেজিং বা এফ-এম.আর.আই. করে দেখলেন, মহিলার ফ্রন্টাল লোব যথেষ্ট কার্যকরী। অথচ, ভাষা ও শব্দভিত্তিক অনুশীলন করাকালীন যখন একইভাবে এফ-এম.আর.আই. করা হলো, তখন কিন্তু ফ্রন্টাল লোব কাজ করতে ব্যর্থ হল।

 

গবেষকরা তখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, এই মহিলার ক্ষেত্রে বাম টেম্পোরাল লোবের অনুপস্থিতির কারণে ভাষা প্রক্রিয়াকরণের পুরো কাজটি চালাচ্ছে মস্তিষ্কের ডান হেমিস্ফিয়ার।

 

এভেলিনা জানাচ্ছেন, মস্তিষ্ক যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা তার কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যায়, তখন কাজ চালানোর জন্য মস্তিষ্ক নিজেই কিছু গঠনগত পরিবর্তন আনে। বিশেষ করে যদি শৈশবে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেক্ষেত্রে এই গঠনগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তখন নার্ভকোশগুলি যেভাবে পূর্বে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন ও বার্তা পাঠানোর জন্য অন্তর্জাল বানিয়েছিল, সেই আন্তর্জালিক গঠনে আমূল পরিবর্তন আসে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য।

 

এভেলিনার ল্যাবের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, মানুষের মস্তিষ্ক সম্পর্কে আরও গূঢ় রহস্যের সমাধান অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা করতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য, এই বৃদ্ধার বোনের ডানদিকের টেম্পোরাল লোব অনুপস্থিত এবং তা সত্ত্বেও এই বৃদ্ধার মতোই তাঁরও কোনও সমস্যা কোনওদিন দেখা যায়নি। এই ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে, হয়তো জিনগত কারণেই, মস্তিষ্কের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ না থাকার পরেও তাঁদের কোনও সমস্যা হয়নি। মস্তিষ্কের গভীর রহস্য বোঝার জন্য, দুই বোনকেই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন এভেলিনা। দুই বোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নতির কথা মাথায় রেখে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেছেন।

 

 

More Articles