এই বিদেশিনীর হাতের ছোঁয়ায় ভোল বদলাচ্ছে ভারতীয় স্কুল, রইল অসাধ্যসাধনের গল্প

সরকারের পক্ষ থেকেও মারিয়ার কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সরকারও মারিয়ার সংস্থার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নতির লক্ষ্যে।

জীবনে বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ অন্যদের সাহায্য করা- এমনটাই মনে করতেন মাদার টেরেসা। ভারতের গরিব মানুষদের দুঃখে পীড়িত হয়ে নিজের দেশ ছেড়েছিলেন কিশোরী অ্যাগনেস। কলকাতাবাসী এই অ্যাগনেসকে সকলে চেনেন 'মাদার টেরেসা' নামে। বাকি জীবনটা ছোট্ট অনাথ শিশুদের ঢাল হয়ে সামলেছেন তিনি। প্রথম বিশ্বের ঝাঁ চকচকে জীবন ছেড়ে পরবর্তী সময়েও বহু মানুষ ভারতের মাটিতে পা রেখেছেন। সকলেই নিজের মতো করে চেষ্টা করেছেন গঠনমূলক কাজ করতে। তাঁদের কর্মকাণ্ড চিরতরে বদলে দিয়েছে কোনও গ্রামের মানুষের জীবন। তেমনই এক নাম মারিয়া ক্যাসেলম্যান। কেরলে এখনও পর্যন্ত ২২টি সরকারি স্কুলের খোলনলচে বদলে দিয়েছেন মারিয়া। কীভাবে এই কাজ করতে পারলেন তিনি, তা এক দারুণ ঘটনা।

 

ভারতের রাজ্যগুলিতে ছয় বছরের কম বয়সি শিশুদের পর্যাপ্ত খাবার ও শিক্ষাদানের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি স্কুল চালু রয়েছে। তবে এই অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারগুলোর হাড়গিলে অবস্থার কথা মাঝে মাঝেই সংবাদের শিরোনামে জায়গা করে নেয়। কোথাও মাথার ওপর ছাদ নেই ,আবার কোথাও পানীয় জল ও বাথরুমের সঠিক ব্যবস্থা নেই। ইচ্ছে থাকলেও প্রান্তিক গ্রামের বাবা-মায়েরাও তাঁদের সন্তানকে পাঠান না এই স্কুলগুলোতে। পরিকাঠামোগত এই সমস্যা চোখ এড়িয়ে যায়নি জার্মান থেকে ভারতে ঘুরতে আসা মারিয়ারও।

 

স্কুল চত্বরে প্রাথমিক সুযোগসুবিধার অভাব দেখে চমকে ওঠেন মারিয়া। তিনি নিজে পেশায় একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক। মারিয়ার কথায়, "আমি হল্যান্ডের একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। পরবর্তী সময়ে ফোটোগ্রাফির নেশায় বিশ্বের নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। ২০০০ সাল নাগাদ আমার পশ্চাৎদেশে অসুবিধার কারণে অপারেশন করাতে হয়। তখন থেকে ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়। ততদিনে অবশ্য আমি জার্মানিতে থাকতে শুরু করি এবং ভালোভাবে চলাফেরা করতেও পারতাম না শারীরিক অবস্থার কারণে। সেই সময় আমার কেরলের এক যোগা শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর কাছে যোগার কৌশলগুলো শিখে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠি। উনিই আমাকে চিকিৎসার কারণে ভারতে আসার কথা বলেন।"

 

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ-ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, ভালবাসার ৫৮ দিন

 

গুরুর কথামতোই ২০০৮ সালে চিকিৎসা করাতে কেরলের কোভালাম জেলায় পা রাখেন মারিয়া। রাস্তায় যাওয়ার পথে ত্রিশূরের কাছে এক অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলের ভগ্নপ্রায় অবস্থা দেখে ভেতরে ঢুকে আসেন তিনি। ফুটো সিলিং, ভাঙা বেঞ্চ এবং চলটা ওঠা দেওয়াল চোখের সামনে দেখতে পান মরিয়া। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত পানীয় জল, বাথরুম, ফ্যান, লাইট কিছুই নেই স্কুলে। মারিয়া বলেন, "তাঁদের অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই এঁদের জন্য কিছু করার।" কিছুদিন পরেই বাচ্চাদের জন্য খেলনা, স্কুলের পোশাক, বইখাতা এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে আসেন মারিয়া। এরপর নির্ধারিত সময়ের আগেই ট্রিপ শেষ করে ফিরে যান জার্মানি। মনের মধ্যে এই বাচ্চাগুলোর জন্য আরও ইচ্ছা নিয়েই দেশে ফিরতে হয়েছিল মারিয়াকে। ফিরে নিজের সঙ্গীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন এই অভিজ্ঞতার কথা। পাশাপাশি জানান, তিনি ফান্ড জোগাড় করে এই স্কুলগুলিকে ঠিক করতে চান।

 

সেই বছরই অর্থ জোগাড় করার জন্য জার্মানিতে ক্যাম্পেন শুরু করেন মারিয়া। সেখানকার অধিবাসীদের থেকে জোগাড় করা ফান্ড নিয়ে ভারতে ফেরেন তিনি। তারপর সম্পূর্ণ ভোল বদলে যায় সেই ভাঙা স্কুলবাড়িটির। সিলিং মেরামত করে নতুন রং করা হয় স্কুলবাড়ির দেওয়ালে। সঙ্গে নতুন বেঞ্চ, লাইট, ফ্যান, পানীয় জল ও বাথরুমের ব্যবস্থা- সব নিজেই করেন মারিয়া। এভাবেই কাজ শুরু হয় মারিয়ার। ত্রিশূরের সেই স্কুল ঠিক করতেই এলাকার আরও তিনটি ভগ্নপ্রায় স্কুল বাড়ির খোঁজ পান তিনি। মারিয়া বলেন, "আমি দেখি ছোট্ট শিশুরা মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে আসত পড়াশোনা করতে। চিন্তা করে দেখি, এদের জন্য সুন্দর স্কুলবাড়ি উপহার দেওয়া ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারি না।"

 

এই কাজের জন্য আরও অর্থ জোগাড় করতে শুরু করেন তিনি । মারিয়ার গলায় শোনা যায়, "একটা ছোট্ট উদ্যোগ থেকে পুরোদস্তুর ক্যাম্পেন শুরু করি। সেই সময় 'পজিটিভ পাওয়ার ফর চিলড্রেন ইভি' নামক একটি এনজিও শুরু করি। আমাদের প্রধান কাজই সরকারি ভগ্নপ্রায় অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলবাড়িগুলোকে মেরামত করা।" তিনি আরও বলেন, "এখনও পর্যন্ত ২২টি স্কুল মেরামতির কাজ আমরা করেছি। প্রতিটা স্কুলে প্রায় ৪০ জন করে পড়ুয়া আছে। তাই বলা যায় এই মুহূর্তে আমরা ৮০০ জন পড়ুয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। অন্যান্য বেসরকারি স্কুলের সুযোগ-সুবিধার মতো সরকারি স্কুলে ব্যবস্থা নেই। তাই সরকারি স্কুলের পাশে দাঁড়াতে আমি উদ্যোগী।"

 

সরকারের পক্ষ থেকেও মারিয়ার কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সরকারও মারিয়ার সংস্থার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নতির লক্ষ্যে। প্রথমদিকে কাজ করতে সমস্যা হলেও এখন সরকারের তরফ থেকে সাহায্য মেলে, তা মারিয়া নিজেই স্বীকার করেছেন। তিরুবনন্তপুরমের আদিমালাথুরা অঙ্গনওয়াড়ির শিক্ষিকা সিন্ধু বলেন, "আমি গত পাঁচ বছর ধরে এই স্কুলে কাজ করছি এবং এর অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। সরকার স্কুলের বাড়ি ভাড়ার জন্য ১০০০ টাকা দিত কিন্তু আমরা ২৫০০ টাকার নিচে কোনও বাড়ি ভাড়া পাইনি। স্কুল চালু রাখার জন্য বাড়তি ১৫০০ টাকা আমি আমার বেতন থেকে দিয়েছি।"

 

সিন্ধু আরও জানিয়েছেন, "আমরা যখন মারিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করি, তখন তাঁদের কাছে যথেষ্ট ফান্ড ছিল না এবং আমরা একটা জায়গাও খুঁজছিলাম স্কুলবাড়ি তৈরির জন্য। অবশেষে ২০২১ সালে ৬ সেন্ট অর্থ দিয়ে জমি কিনে দিলে মরিয়া স্কুলবাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। মারিয়াকে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্কুলের একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা বানিয়ে দেওয়ার জন্য। এছাড়াও তিনি নতুন বেঞ্চ, স্কুলের পোশাক ও পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি দিয়েও সাহায্য করেছেন।" করোনা কাটিয়ে ২০২২ সাল থেকে নতুন এই বাড়িতেই স্কুল চালু হয়েছে শিশুদের জন্য। নতুন এই ঠিকানায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও যথেষ্ট ভালো। পরিকাঠামোর উন্নতির কারণে স্কুলের পড়ুয়ার সংখ্যাও ১৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০।

 

মারিয়া ফান্ড জোগাড় করে ৮টি নতুন স্কুলবাড়ি তৈরি করেছেন। মারিয়া বলেছেন, "এই স্কুলগুলির সবক'টিতেই ছোট খেলার মাঠ রয়েছে, যা বাচ্চাদের বিকাশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তবে বেশিরভাগ সময়েই ফান্ডের অভাব দেখা দিয়েছে। তখন বেছে নিতে হয়েছে, কোনটির জন্য টাকা খরচ করা বেশি প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন কাজ।" উদাহরণ হিসেবে মরিয়া বলছেন, "অনেক সময় কোনও স্কুল পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস চেয়েছেন আমাদের কাছে। আবার ওই সময়েই দেখা গেল, খবর এসেছে দু'টি স্কুলের ছাদ উড়ে গেছে ঝড়ের কারণে।তখন অবশ্যই ছাদ ভেঙে পড়া স্কুলবাড়ি ঠিক করার কাজেই আমরা সাহায্য করেছি।"

 

শুধু তো প্রাথমিক শিক্ষা নয়, মারিয়ার তৈরি অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলে নিজেকে রক্ষা করার কৌশলও শেখানো হয়। তিরুবনন্তপুরমে কোচ রেখে ১৫-১৭ বছরের মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হয়। মারিয়া জানিয়েছেন, "বর্তমানে কোভিড ও ফান্ডের সমস্যার কারণে বন্ধ রয়েছে এই উদ্যোগ। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি আবার চালু করতে পারব।"

 

More Articles