কেন নারীবিদ্বেষী তালিবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে দিল্লি?
At Jaishankar-Muttaqi meet in Delhi: এর আগের ১৫ মে-এর এস. জয়শঙ্কর ও আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ফোনালাপ শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি-র ভারত সফর ঘিরে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দিল্লিতে আফগান দূতাবাসে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করেন, কিন্তু সেখানে মহিলা সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তালিবান সরকারের কোনো মন্ত্রীর এটাই ছিল প্রথম ভারত সফর, তাই এই ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিতর্ক শুরু হতেই পররাষ্ট্র মন্ত্রক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, “গত কাল (১১ অক্টোবর) দিল্লিতে আফগান বিদেশমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের বিষয়ে বিদেশ মন্ত্রকের কোনো হাত নেই।” কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, তালিবানের নারীদের প্রতি কঠোর নীতির কথা আগে থেকেই জানা থাকলেও, ভারত কেন আগেভাগে এমন বৈষম্যমূলক অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেনি?
তালিবানের নারীবিরোধী নীতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো এখনও দূরত্ব বজায় রেখেছে। ভারত আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করলেও, এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারত বলছে, তারা একটি 'অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার' দেখতে চায়— যেখানে আফগান সমাজের সব গোষ্ঠীর মানুষ অংশ নেবে এবং নারীদের মৌলিক অধিকার রক্ষা পাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করেছে, “ভারতের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তালিবান সরকারকে এখনও আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি না।” তবে একই সঙ্গে ভারত বলছে, তারা বাস্তবতা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে চায় না। কারণ আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনও কখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিয়েও বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে এখনও স্বীকৃতি না দিলেও ভারত সম্প্রতি যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা দুই দেশের সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। ২০২১ সালে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ হওয়া কাবুলের ভারতীয় দূতাবাস এখন পুনরায় চালু হতে চলেছে। একই সঙ্গে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফর, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক, এবং বাণিজ্য-নিরাপত্তা-উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা— এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারত এখন এক বাস্তবমুখী কূটনৈতিক পথ বেছে নিচ্ছে।
আরও পড়ুন
তালিবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক! কেন চাইছে ভারত?
২০২১ সালে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ভারত কাবুলে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০২২ সালে সীমিত সংখ্যক কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি টেকনিক্যাল মিশন (technical mission) গঠন করা হয়, যার কাজ ছিল মানবিক সহায়তা ও যোগাযোগ বজায় রাখা। এখন সেই টেকনিক্যাল মিশন (technical mission) কে পূর্ণ দূতাবাসে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে ভারত সরকার।
এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কাবুলে নতুন প্রাণ ফিরে এসেছে ভারতীয় কূটনৈতিক কার্যক্রমে। ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দূতাবাস পুনরায় চালু হলে আফগানিস্তানে চলমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো ও মানবিক প্রকল্পগুলো আরও সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করা যাবে। এর পাশাপাশি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দিল্লি সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। সেখানে নিরাপত্তা, বাণিজ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং মানবিক সাহায্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দিল্লি কি তাহলে প্রকারন্তরে নারী বিরোধী মুসলিমসমাজের শর্তাশর্ত গিলতে বাধ্য হল?
তালিবান ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারীদের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। মেয়েদের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অনেক নারীকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারত আগে জাতিসংঘে বলেছিল, “বিশ্ব চুপ থাকতে পারে না যখন আফগান নারীদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।” তবুও এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে বা যৌথ বিবৃতিতেও নারীর অধিকার বা সংখ্যালঘুদের কথা একবারও উল্লেখ করা হয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নে মুত্তাকি শুধু বলেছেন, “প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আইন ও রীতি আছে।” তাঁর এই মন্তব্যে তালিবানের নারী-বিরোধী অবস্থান আরও পরিষ্কার হয়ে গেল।
তালিবান ক্ষমতা দখলের পর থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। নারীদের শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস, সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘন— এসব কারণে এখনও কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতও সেই অবস্থান বজায় রেখেছে। কারণ, তালিবানকে এখনই স্বীকৃতি দিলে ভারতের মানবাধিকারভিত্তিক নীতির সঙ্গে সংঘাত তৈরি হবে। বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, স্বীকৃতি না দিয়েও যোগাযোগ বজায় রাখার মধ্য দিয়ে ভারত দেখাতে চাইছে— তারা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছে না, বরং ধাপে ধাপে সম্পর্কের পথে এগোচ্ছে।
এখন ভারত ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক নতুন এক কূটনৈতিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। এর আগের ১৫ মে-এর এস. জয়শঙ্কর ও আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ফোনালাপ শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। পহেলগাঁও হামলার পর তালিবানের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি সমর্থন ও নিন্দা জ্ঞাপনকে জয়শঙ্কর প্রকাশ্যে প্রশংসা করেন, যা দিল্লি-কাবুল সম্পর্কের বরফ গলানোর ইঙ্গিত দেয়। তখনই আলোচনায় উঠে এসেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, ভিসা ইস্যু, ভারতে বন্দি আফগান নাগরিকদের মুক্তি এবং ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন প্রসঙ্গ।
এই যোগাযোগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৯৯ সালে কান্দাহার ছিনতাই সংকটের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশওয়ন্ত সিং তালিবান সরকারের সঙ্গে বাধ্য হয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। এরপর থেকে তালিবানের সঙ্গে ভারতের তেমন সম্পর্ক ছিল না। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ভারতের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, আফগান তালিবান টিটিপি (তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান)-কে আশ্রয় দিচ্ছে, এর জেরেই ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান আফগান ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালায়। এর পর থেকেই কাবুল ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ, আর দিল্লি সেই ফাঁকটিকেই কাজে লাগাতে চাইছে। অন্যদিকে, চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার চেষ্টাও ভারতের চিন্তার বিষয়।
প্রসঙ্গত, আফগানিস্তান ভারতের জন্য শুধু একটি প্রতিবেশী দেশ নয়, মধ্য এশিয়া ও ইরানের সঙ্গে যোগাযোগেরও একটি কৌশলগত পথ। চাবাহার বন্দর থেকে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় পণ্য পাঠানোর যে করিডর তৈরি হয়েছে, তা ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তালিবান সরকারের সময় ভারত বেশ কিছু মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছে— যেমন খাদ্য, ওষুধ, ভ্যাকসিন ও গম। এখন দূতাবাস পুনরায় চালু হলে এই সহায়তা আরও কার্যকরভাবে পাঠানো সম্ভব হবে। এছাড়া, আফগানিস্তানে বহু ভারতীয় প্রকল্প যেমন দেলারাম-জারাঞ্জ হাইওয়ে, আফগান সংসদ ভবন, এবং সালমা ড্যাম (ইন্ডিয়া-আফগান ফ্রেন্ডশিপ ড্যাম)— এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নেও ভারতের উপস্থিতি জরুরি।
আরও পড়ুন
রামরাজ্যের নারী ও নারীর রামরাজ্য
ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো আফগান ভূমি যেন কোনোভাবেই ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদে ব্যবহৃত না হয়। ৯০-এর দশকে আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন কাশ্মীরে সক্রিয় ছিল— সেই আশঙ্কা এখনও রয়ে গেছে। তালিবান যদি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, তাহলে ভারতের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই কারণেও ভারত কাবুলে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে।
আফগানিস্তানে শান্তি ফিরলে গোটা দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বাণিজ্য ও সংযোগের পথ অনেক বেশি মসৃণ হবে। ভারতও তা জানে। তাই স্বীকৃতি না দিয়েও, ভারত এখন তালিবানের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে— একদিকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, অন্যদিকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সহযোগিতার পথ খোলা রাখার জন্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ভারতের প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ, নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রাখা হচ্ছে।
এখানে বলা জরুরি, আরএসএস-এর প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্যে নারীকে 'গৃহিণী' ও পুরুষের অনুগত সঙ্গী হিসেবে দেখা হয়। আর তালিবানও নারীদের ঘরবন্দি করে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে। দু’ক্ষেত্রেই নারী স্বাধীনতা লঙ্ঘিত, এমনকি পুরুষের ছায়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে তাদের। পার্থক্য শুধু মাত্রায়— ভারতে এই চিন্তাধারা মতাদর্শের স্তরে সীমিত, কিন্তু আফগানিস্তানে তা রাষ্ট্রের নীতিতে রূপ পেয়েছে। দুটোই মূলত নারী-স্বাধীনতার পরিপন্থী পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। ভারত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়েও কূটনৈতিক যোগাযোগ, বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে তা ভারতের জন্য একধরনের পরীক্ষা। ভারত কি মানবাধিকার ও নীতির অবস্থান বজায় রেখেও বাস্তব রাজনীতির পথে অগ্রসর হতে পারবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ভবিষ্যতেই মিলবে। তবে আপাতত নিশ্চিতভাবে বলা যায়— ভারত আফগানিস্তানের দরজায় আবার কূটনৈতিকভাবে ফিরে এসেছে। স্বীকৃতি না থাকলেও, বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় কি তবে শুরু হয়ে গিয়েছে?

Whatsapp
