তালিবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক! কেন চাইছে ভারত?

Taliban : ফোনালাপে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ী ও রোগীদের যাতে ভারত থেকে ভিসা দেওয়া হয় এবং ভারতে জেলবন্দি থাকা আফগানদের মুক্তি দিয়ে দেশে ফেরানো হয়।

গত ১৫ মে ঘটনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আফগানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ফোনালাপ হয়েছে। সে দিন সন্ধ্যেতেই জয়শঙ্কর এক্স-এ লেখেন, "সন্ধ্যেবেলায় ভারপ্রাপ্ত আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে খুব ভালো কথাবার্তা হলো।" ১৯৯৯ সালের পর ভারত সরকারের কোন মন্ত্রী তালিবান কোনো মন্ত্রীর সঙ্গে এরকম প্রকাশ্যে যোগাযোগ রাখেননি। কেন ভারতের সঙ্গে তালিবানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে? কোন প্রয়োজনে এই দুই দেশ কাছাকাছি আসছে?
দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক কতটা গভীর হওয়া সম্ভব?

১৫ মে জয়শঙ্কর এক্সে এও লিখেছিলেন, পহেলগাঁও হামলার পর আফগানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিন্দা জানানোকে ভারত গভীরভাবে সম্মান করে। এই পোষ্টের কিছুক্ষণের মধ্যেই মুম্বাইতে আফগান কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে এক্সে পোস্ট করা হয়- দু'দেশের সম্পর্ক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এবং কীভাবে দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো যায়- তা নিয়েও দু'দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ফোনালাপে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ী ও রোগীদের যাতে ভারত থেকে ভিসা দেওয়া হয় এবং ভারতে জেলবন্দি থাকা আফগানদের মুক্তি দিয়ে দেশে ফেরানো হয়। কীভাবে দু'দেশের মধ্যে ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়নের কাজ হতে পারে সেই নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, দুই দেশ কি পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির পথে এগোবে?

২৫ বছর আগে তালিবানের সঙ্গে  ভারত সরকারের রাজনৈতিক যোগাযোগ হয়েছিল। কাবুলে তখন ভারতের কোন দূতাবাস ছিল না তবুও সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশওয়ন্ত সিং তাঁর আফগান কাউন্টারপার্ট মুল্লাহু ওয়াকিল আহমেদ মুত্তাওয়াকিলকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছিল। তার কারণ হলো- ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান (আইসি ৮১৪) ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কান্দাহার এয়ারপোর্টে। সে সময় পণবন্দি করা ওই যাত্রীদের মুক্তি দিতে ছিনতাইদের সঙ্গে ভারতের আলোচনার মধ্যস্থতা করেছিল তালিবান। এছাড়া অতীতে ভারত তালিবানের সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহ দেখায়নি। তবে দু'পক্ষের মধ্যে টেকনিক্যাল ও কূটনৈতিক স্তরে একাধিকবার কথাবার্তা হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুবাইতে বৈঠক করেছেন। এরপর ১৫ ই মে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় ফের ফোনালাপ হলো ভারত এবং আফগানিস্তানের। পাকিস্তানই কী তবে দুই দেশের সম্পর্ক ভালো করেছে?

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভী মদান বিবিসি-কে বলেছেন, দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কথা বলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা আছে পাকিস্তানের। আসলে 'শত্রুর শত্রুই আমার বন্ধু'- এই ধরনের ভাবনা জিওপলিটিক্সের ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য। তিনি জানান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের মধ্যে যে ফাটল আছে, ভারত তাকেই কূটনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে, তাতে কোনা সন্দেহ নেই। তানভী মদানের কথায়, "পাকিস্তানের 'ম্যাসিভ অ্যাসিস্ট' বা বিরাট সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না।"

পাকিস্তান বহুদিন ধরে এই অভিযোগ করছে যে আফগানের তালিবান 'তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান' বা টিটিপি-কে মদত দেয়। তারাই এও দাবি করে যে, টিটিপি-র জন্য নাকি তালিবান আফগানিস্তানের ভেতরে কিছু মুক্তাঞ্চলে বানিয়ে দিয়েছে। টিটিপি পাকিস্তান সরকারকে উচ্ছেদ করতে চায় এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম করতে চায়। এর জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান আফগানিস্তানের ভেতরে আকাশপথে হামলাও চালায়। এই হামলায় ৫০ জন নিহত হয়েছিল। এরপর তালিবানও পাল্টা জবাব দিয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করছেন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের এই দূরত্বকেই ভারত কাজে লাগাচ্ছে। পহেলগাঁও হামলার পর আফগানিস্তানের তালিবানের শাসকরা যেভাবে এই হামলার নিন্দা করেছিল এতে দিল্লি ও কাবুলের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করার সুযোগ এসেছিল। আর সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে জয়শঙ্কর। অন্যদিকে, চীন-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর (সিপেক) আফগানিস্তানের দিকে ওয়াখান করিডরের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চলছে - এদিকেও ভারতের তীব্র নজর আছে। ফলে আন্দাজ করাই যায় যে আফগানিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনের তাগিদ ভারতের দিক থেকেও ছিল। আর পাকিস্তানের জন্য এই কথাবার্তা সম্ভব হয়েছে।

২০২১ সালে তালিবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে। সে সময় ওই দেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগে ব্যবসার জন্য, পড়াশোনার জন্য, চিকিৎসার জন্য আরও নানা কাজে আফগানরা নিয়মিত ভারতে আসতেন। দিল্লি ও কাবুলের মধ্যে রোজ তিনটি ফ্লাইটও চলত। গত কয়েক বছরে আফগান থেকে তারাই ভারতে আসতে পেরেছেন যাদের 'লং টার্ম ভিসা' ছিল। কাবুলের তালিবান নেতৃত্বরা ভীষণভাবেই চাইছেন যেন ফের ভিসা কার্যক্রম চালু হয়। আর তা কিছুটা হলোও। পহেলগাঁও হামলার পর থেকেই ভারত পাকিস্তানের আটারি-ওয়াগা সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। এতে আফগানিস্তান থেকে আসে পণ্যবাহী ট্রাক আটকে পড়ে। ফোনালাপের পর দিনই (১৬ মে) পাকিস্তানের আটারি সীমান্তে আটকে ছিল আফগানিস্তানের ১৬০ টি পণ্যবাহী ট্রাক। বিশেষ অনুমতি দিয়ে ভারতে সেগুলি ঢুকতে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান বা উজবেকিস্তানের মতো দেশ তাদের দেশের আফগান মিশনগুলি তালিবানের হাতে তুলে দিয়েছে। তবে ভারত কিন্তু এখনো এটা করেনি। বর্তমানে আফগানিস্তানে ভারতের কোন দূতাবাস চালু নেই। অন্যদিকে, দেড় বছর হলো দিল্লিতেও আফগান দূতাবাসের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে তালিবান মুম্বাইতে কনস্যুলেটে ইকরামউদ্দিন কামিলকে 'ভারপ্রাপ্ত কনসাল' হিসেবে নিয়োগ করেছিল। ভারত তখন কোন আপত্তি জানায়নি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের একটি সাম্প্রতিক স্টাডিতে বলা হয়েছে, কাতার, চিন বা তুরস্কের মতো দেশগুলির তালিবানের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত হলেও ভারতের সঙ্গে সেই সম্ভবনা নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের স্টাডিজের তালিকায় পাকিস্তানেরও ৫ নম্বরে নাম রয়েছে কিন্তু ভারতের নেই।

উল্লেখ্য, সময়ে সময়ে তালিবানদের বিরুদ্ধে নারীস্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ উঠেছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিলই। এখনও পর্যন্ত কোনো পশ্চিমা দেশ তালিবানকে তেমন একটা জায়গা দেয়নি। কারণ, সমাজে নারীদের ভূমিকা নিয়ে তালিবানের নীতি, যেমন- নারীদের ঘর থেকে না বেরোতে দেওয়া, শিক্ষায়-কর্মক্ষেত্রে-খেলাধুলায় যোগদান না করতে দেওয়া। সম্প্রতি ফার্স্ট পোস্টে-র সাংবাদিক পালকি শর্মা বলছেন, "আফগানিস্তানে নাগরিকদের মানবাধিকার বা নিরাপদ জীবনযাত্রা নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের কি কোন উদ্বেগ নেই? নিশ্চয়ই আছে।" তিনি স্পষ্ট করে বলেন, "কিন্তু ভারতের জনগণের নিরাপত্তা ও ভালো থাকাটা নিশ্চয়ই ভারতের কাছে বেশি গুরুত্ব পাবে। এটাই স্বাভাবিক আর এখন ঠিক এটাই হচ্ছে।" যদিও পালকি শর্মা ভারতের মুখপাত্র নন তবু তাঁর পর্যবেক্ষণ এখানে প্রণিধান যোগ্য।

More Articles