রামরাজ্যের নারী ও নারীর রামরাজ্য

Condition of Women in Ramrajya: তিনি শূদ্রবিদ্বেষী বা নারীবিদ্বেষী বিশেষত তখনই, যখন তিনি ‘রাজা’, যখন তৎকালীন রাজধর্ম পালন করছেন, রাজা হিসেবে তৎকালীন মূল্যবোধ রক্ষা করছেন।

রামরাজ্যের যে ধারণা বাল্মীকি বা তুলসিদাসের কাব্যে, রাজতন্ত্রের কালে তাকে রাজনৈতিক অভীষ্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন অনেক ঐতিহাসিক রাজা-রাজড়াই। না হলে কেনই বা থাইল্যান্ডের রাজাদের নাম রামের নামে হবে? স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রথম রামরাজ্যের বাস্তবায়ন চেয়েছিলেন গান্ধিজি। এই রামরাজ্য বাল্মীকির বা তুলসিদাসের থেকে আলাদা। যেমন, তুলসিদাসে আছে, ‘বরনা ম নিজ নিজ, ধরম নিরত।’ মানে, সকল বর্ণ নিজ নিজ বর্ণধর্ম অনুযায়ী সে'খানে কাজ করে। কিন্তু যে ‘রামরাজ’-এর কথা গান্ধিজি বলেন, সে'খানে অর্থনৈতিক বিভেদের মতোই জাতি, বর্ণ বা সম্প্রদায়ের বিভেদ নেই। তা অধুনা-আলোচিত হিন্দুরাষ্ট্র নয়, রাম-রহিম সকলের দেশ। তিনি বলেন,

I acknowledge no other God than the one God of Truth and righteousness. Whether Ram of my imagination ever lived on this earth, the ancient ideal of the Ramayana is undoubtedly one of true democracy in which the meanest citizen could be sure of swift justice without an elaborate and costly procedure. (Young Indians, 1934).

অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রায় একই সময়ে, ২ অগাস্ট, ১৯৩৪-এ লেখেন,

Ramayana of my dreams ensures equal rights to both prince and pauper.

যে কোনও ইউটোপিয়ায় থাকে সেই অমোঘ টান, যাকে ফ্রয়েড বলেন, ‘commonly felt nostalgia for a lost state of perfect wholeness’। প্লেটো ‘রিপাব্লিক’-এ 'আদর্শ দেশে'র ধারণা দিয়েছিলেন সক্রেটীয় কথোপকথনের মাধ্যমে। বাইবেলে ছিল স্খলনপূর্ব ইডেন উদ্যান। টমাস মুরের ‘ইউটোপিয়া’-য় ব্যক্তিগত মালিকানা বা স্বৈরাচার ন্যায়নীতিকে কলুষিত করেনি। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নিকটতম সমান্তরাল পাওয়া যায় ‘রামরাজত্ব’-এর ধারণায়।

এই যে ন্যায়নীতির ধারণা, এই যে মূল্যবোধ—তা যুগে যুগে বদলায়। তাই ধারণাগত ভাবে, গান্ধির রামরাজ্যকে তুলসিদাসের থেকে আধুনিক হতে হয়। কিন্তু সচরাচর কল্পদেশের কোনও মানচিত্রেই নারীর অবস্থানটি সুবিধার নয়। ‘গার্ডেন অফ ইডেনে’ স্খলন ও পতনের কারণ আদিমাতা ইভ। টমাস মুরের 'ইউটোপিয়া'য় নারীরা ‘for the most part deal in wool and flax, which suit best with their weakness.’ একই ভাবে ‘রামরাজ্যে'র স্বার্থে সীতা-ত্যাগ মান্য। এমনকি কম্যুনিস্ট ইউটোপিয়াতেও ছিল স্তালিনের বিবিধ নারী-বিরোধী নীতি। পুরুষের ইউটোপিয়া অতএব নারীর কল্পদেশ নয়।

রাম ও রামরাজ্য প্রসঙ্গে যদি মনোনিবেশ করি, তবে গোদাভাবে রামের বিরুদ্ধে দু'টি অভিযোগ আছে। একটি বর্ণবাদ-বিরোধী ঘরানা থেকে, অন্যটি নারীবাদীদের। বস্তুত, একজন কাল্পনিক চরিত্র কতটা নারীবিদ্বেষী, কতটা শূদ্রবিদ্বেষী, সে'টা উপজীব্য নয়। কাল্পনিক চরিত্র সেই মূল্যবোধই ধারণ করবেন, যা তৎকালীন সামাজিক মূল্যবোধ। যা প্রণিধানযোগ্য, তা হল, তিনি শূদ্রবিদ্বেষী বা নারীবিদ্বেষী বিশেষত তখনই, যখন তিনি ‘রাজা’, যখন তৎকালীন রাজধর্ম পালন করছেন, রাজা হিসেবে তৎকালীন মূল্যবোধ রক্ষা করছেন। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষা করেন বলেই তো তিনি ‘মর্যাদাপুরুষোত্তম’!

আরও পড়ুন: রামপাঁঠা, রাম ছাগল বোকারাম, হাঁদারাম বললে কি রামের অপমান হয়?

হরিশচন্দ্র সত্যরক্ষার্থে স্ত্রী-পুত্রকে বিক্রয় করেছিলেন। বলিরাজা সন্তানকে হত্যা করেছিলেন কথা রাখতে। পুত্রহত্যার রূপক আব্রাহামিক ধর্মেও পাওয়া যায়। অর্থাৎ, সে'যুগে স্ত্রী-সন্তানের কোনও নিজস্ব মত, ইচ্ছা, তর্ক, এজেন্সি নেই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতা মুখ্য। রাজা সেই সমাজব্যবস্থাকেই রক্ষা করেন।

রামের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। প্রজারা বিদ্রোহ করছে সীতা ‘অশূচি’ বলে। রাজা স্ত্রীকে গুরুত্ব দেবেন, না প্রজাকে? প্রজাকে। ব্যক্তি রামের গুহকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বা শবরীর এঁটো কুল খেতে আপত্তি নেই। কিন্তু যখন তিনি সমষ্টির নেতা? তখন, এক ব্রাহ্মণ রাজাকে তাঁর পুত্রের হঠাৎ-মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন। ব্রাহ্মণের সন্দেহ, নিশ্চয় কোনও শূদ্র মহাজ্ঞানী হতে চাইছে বলেই ব্রাহ্মণসন্তান মরেছে। অতএব জ্ঞানপিপাসু শম্বুককে খুঁজে শিরশ্ছেদ করলেন ‘রাজা’ রাম। নাহলে রাজধর্ম কলুষিত হয়।

এই হল রাম ও রামের সময়। পিতৃতান্ত্রিক। ব্রাহ্মণ্য-আধিপত্যে ভারাক্রান্ত। অতিমানবিক সত্যরক্ষার চাপে ন্যুব্জ। বাল্মীকির রামায়ণ কতজন বাল্মীকি লিখেছিলেন, জানি না৷ সাধারণত এপিক নানা যুগ থেকে হাড়মাস সংগ্রহ করে। মনে করা হয়, রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত। রামায়ণ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে─যেমন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰ, বাৎস্যায়নের কামসূত্ৰ, শ্ৰীমদ্ভগবদগীতা এবং মনুসংহিতা রচিত হয়। এর কিছু পরেই শুরু হয় ‘পুরাণ’গুলির রচনা। তাই ‘রামায়ণ’-এ পরবর্তী সংযোজিত অংশগুলি ‘অভিপৌরাণিক’, অর্থাৎ পুরাণে প্রতিফলিত সামাজিক মূল্যবোধ ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সন্ধান সে'খানে পাওয়া যায়। তাই এ'কালে যখন আলোচনায় বসব, তখন রামের ব্যক্তিগত স্খলন নয়, তৎকালীন মেইনস্ট্রিম রাষ্ট্রীয় আদর্শই (যাকে তখন ‘স্বাভাবিক’ ভাবা হয়েছিল, কিন্তু যাকে এখন আমরা ন্যায্যত ‘কাস্টিজম’ বা ‘মিসোজিনি’ নামে ডাকি) আলোচ্য হওয়া উচিত।

গান্ধিজির রামরাজ্যে বর্ণ বা ধর্মের সাম্যের কথা বলা হলেও, লিঙ্গসাম্যের উল্লেখ ছিল না। যেহেতু (আগেই বলা হয়েছে) মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতি যুগধর্ম অনুযায়ী অভিযোজিত হওয়াটাই সুস্থ, অতএব আমরা ইউটোপিয়ার পরবর্তী কাল্পনিক ধারণায় আশা করতে পারতাম উন্নততর কিছু, যে'খানে শ্রেণি-বর্ণ-ধর্মের মতো লিঙ্গের সাম্যও প্রতিষ্ঠিত।

তার বদলে, ‘পিছে মুড়’ ধ্বনি তুলে, কুচকাওয়াজ করে আমরা চলেছি পিছন পানে। সেই পথে পেরিয়ে এলাম ১৯৫০, মানে সাংবিধানিক মূল্যবোধের উৎসকাল। তারপর পেরোলাম ১৯৩০-এর দশক—মানে, গান্ধির ‘রামরাজ’-এর মূল্যবোধ উৎপত্তির সময়। আমরা থামছি না, কারণ সম্ভবত আমাদের গন্তব্য ওই খ্রিস্টপূর্বাব্দ সকল। আবার, কখনও কখনও মনে হচ্ছে, আমাদের তথাকথিত একবিংশ শতকীয় রামরাজ্যের নীল নকশা এমনকি বাল্মীকির যুগের সঙ্গেও মিলছে না! হয়ত পিথেকানথ্রোপাসের যুগে গিয়ে আমরা থামব।

****

২০২২ সালের স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লার ভাষণে নারী-সশক্তিকরণ নিয়ে অনেক কথা খরচ করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সে'দিন সাজা মকুব করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল গুজরাট দাঙ্গার কালে ধর্ষিতা বিলকিস বানোর গণধর্ষণ কাণ্ডে জড়িত ধর্ষকদের। সে'সময়ের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীই আজ প্রধানমন্ত্রী। সেই ধর্ষকদের নিয়ে প্রহসন আজও চলছে। সুপ্রিম কোর্ট তাদের সাজা মকুবের রায় খারিজ করার পর তারা হারিয়ে গেল। আবার তাদের খুঁজে পাওয়া গেল। পুনর্গ্রেফতারের অপেক্ষায় জাতি দিন গুনছে। রামরাজ্যে ধর্ষকদের প্রতি শাসকের সমর্থনের কথা রামায়ণের কোনও ভার্সনে শোনা যায়নি, ভাগ্যিস!

২০২৩ সালের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মেয়েদের নিয়ে তেমন কিছু বলা হয়ত সমীচীন মনে করেননি প্রধানমন্ত্রী। বরং, মণিপুর নিয়ে সংক্ষিপ্ত আশ্বাস দিলেও, মণিপুরের বিরল নারীনির্যাতন নিয়ে তাঁকে স্বাধীনতার পুণ্যদিনে মাথা ঘামাতে শোনা যায়নি। মণিপুরের কুকি মেয়েদের নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের আন্তঃপ্রজাতি দাঙ্গা সম্পর্কে দীর্ঘ ৭৯ দিনের মৌনতা ভঙ্গ করেছিলেন। ঘটনার নিন্দা করার সময় তিনি আরও বলেছিলেন এমন কিছু রাজ্যের নাম, যারা বিজেপি-শাসিত নয়, অথচ যেখানে নারী নির্যাতন হয়। আপাত দৃষ্টিতে ন্যায্য কথা। বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই যে শুধু নারী নির্যাতন হয়, তা নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা বা জম্মু-কাশ্মীরের কথা বলতে আবার ভুলে গেছিলেন, যে রাজ্যগুলি বিজেপি-শাসিত ও যেখানে বিজেপি-পোষিত ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিলও বেরোয়। বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মধ্যে, আশানুরূপ ভাবেই, তিনি শুধু মণিপুরেরই উল্লেখ করেছিলেন।

মৈতেই-কুকি দাঙ্গার জেরে ঠিক কতজন ধর্ষিত হল, তার সঠিক পরিসংখ্যান মেলা ভার। কিন্তু ভাইরাল ভিডিওতে কুকি নারীদের নগ্ন করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, গণধর্ষণের দৃশ্য দেখা গেছে। উক্ত ঘটনাটি ঘটেছিল এক 'ফেক নিউজ'-এর কারণে। নিজের বাবা-মা'র হাতে মৃত এক দিল্লির যুবতীর মৃতদেহের আবছা ছবি ছড়িয়ে, বিজেপির আইটি সেলের চিরাচরিত কায়দায়, প্রচার করা হয়েছিল, তা কোনও মৈতেই যুবতীর ধর্ষিত মৃতদেহের ছবি। নকল ধর্ষণের খবরে আসল ধর্ষণ ঘটাতে মৈতেইরা দেরি করেনি। প্রধানমন্ত্রী হিরন্ময় নিস্তব্ধতা পালন করেছেন।

আরও পড়ুন: রাম মন্দির: বিরোধী দলগুলিকে নগ্ন করে দিল নতুন ভারত

গণতন্ত্রের সার্কাসে নারীবিদ্বেষ ও লিঙ্গ-অসাম্যের ঢালাও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা সব দলই করে। ভোট এলে দেখা যায়, প্রার্থী নারীও বাদ যান না এর কোপ থেকে। এ'বিষয়ে বাম ডান নির্বিশেষে কেউই দোষমুক্ত নন। কিন্তু সবথেকে এগিয়ে নিঃসন্দেহে কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত শাসক দলটি। আতিশি হোক বা মহুয়া মৈত্র, সকলেই স্লাট শেমিং-এর শিকার হন। এমনকি নিজের দলের প্রার্থী শ্রাবন্তীকেও ‘নগরের নটী’ বলে ডাকেন তথাগত রায়। এদিকে, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ৪২৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫৩ জন মাত্র নারী ছিলেন (যার মধ্যে আবার প্রজ্ঞা ঠাকুরের মতো দাগী আসামীরা রয়েছে)।

কাঠুয়ায় আট বছরে আসিফাকে আটদিন মন্দিরে আটকে রেখে গণধর্ষণ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ আসিফা সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বালিকা। সেই ধর্ষকদের সমর্থনে বিজেপির নেতারা শুধু মিছিল করেননি, মিছিলে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা হয়েছিল। এ'নজির তুলসিদাস বা বাল্মীকিতে কই?

রাজপথে মাসের পর মাস ধর্না দিলেন নারীপুরুষ নির্বিশেষে আন্তর্জাতিক পদকজয়ী কুস্তিগীররা। ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং নারী কুস্তিগীরদের যৌন নির্যাতন করেন, এই ছিল অভিযোগ। বলাবাহুল্য, তিনিও বিজেপির প্রভাবশালী বিধায়ক। কিন্তু না, একদিনের জন্যও তাঁকে জেলবন্দি করা হয়নি। ক্ষোভে খেলা ছেড়েছেন অলিম্পিকজয়ীরা।

বিজেপির মতো একটি ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী দল অবশ্য আদর্শগতভাবেই নারীবিদ্বেষের বীজ বহন করে। মেয়েরা যে কেবল পুরুষের সন্তান উৎপাদন, যৌনসুখ প্রদান এবং গৃহকর্মের সাধনের জন্য, এই মনোভাব বিজেপির আদর্শগত উৎসমুখ আরএসএস কখনও গোপন করেনি৷ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দুর্গাবাহিনী, আরএসএস-এর যে মহিলা শাখা, বিজেপির মহিলা মোর্চা নারীর এই সনাতনী রূপকেই তার শক্তির উৎস বলে মানে।

প্রতিষ্ঠাতা ডঃ হেডগেওয়ারের পরে এম এস গোলওয়ালকর আরএসএস-এর পরিচালক হন। ১৯৬০ সালে গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন,

‘যে কোনও বর্ণের বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান অবশ্যই নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা জন্মগ্রহণ করা উচিত। তারপরে তিনি তার স্বামী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।’ আরএসএসের মুখপত্র 'অর্গানাইজার' পত্রিকাতে, ১৯৬১ সালের ২ জানুয়ারি, ৫ নম্বর পৃষ্ঠাতে এই ভাষণের খবর ও সার ছাপা হয়েছিল।

আরএসএস-এর বর্তমান প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, ‘ছেলেরা বিবাহ করে সুখ পাওয়ার জন্যে, আর মেয়েরা বিয়ে করে ছেলেদের সুখ দেওয়ার বিনিময়ে নিজেদের পেট চালানোর জন্য...মেয়েদের বাড়ির মধ্যেই থাকা উচিত ও বাড়ির কাজই করা উচিত।'

এই অতিহিন্দু গোষ্ঠী সংবিধানে ভরসা না রেখে মনুবাদী ভারত গড়তে চায়। মনুশাস্ত্রে নারী পুরুষের ইচ্ছাধীন যন্ত্র। সেই ভাবধারা মেনে, সাক্ষী মহারাজ থেকে সাধ্বী প্রজ্ঞা সবাই বলেন হিন্দু নারীকে অন্তত চার-পাঁচটি সন্তান উৎপন্ন করতে হবে মুসলমানদের ঠেকাতে। মোহন ভাগবত বলেন, ধর্ষণ হল বিদেশি সংস্কৃতি ও নারী-স্বাধীনতার ফল। কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন, ধর্ষণ ঠেকাতে নারীকে 'লক্ষণরেখা'র মধ্যে থাকতে হবে। একই কথা আদিত্যনাথের, 'মেয়েদের রক্ষা করতে হবে, স্বাধীনতা দেওয়া অবান্তর।…শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্র তাকে রক্ষা করবে।'

আদিত্যনাথের নিজের রাজ্য উত্তর প্রদেশে, অথচ, ধর্ষণ পরিসংখ্যান হাড় হিম করা। দলিত নারীর উপর যৌন নিগ্রহ আরও বেশি। উন্নাওতে বিজেপি এমএলএ নিজেই ধর্ষক। ধর্ষিতার বাপ, কাকাকে হত্যা করেও তিনি ক্ষান্ত হননি, ধর্ষিতাকে গাড়ি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উত্তর প্রদেশের হাথরসে দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে শিরদাঁড়া ভেঙে জিভ উপড়ে নিয়েছে উচ্চবর্ণের পুরুষ, আর যোগী আদিত্যনাথ সরকারের পুলিস দায়িত্ব নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে মৃতার শরীর রাতারাতি। এ'সবের বিহিত করার বদলে বিজেপি এনেছে লাভ জিহাদ অর্ডিনান্স, যা শুধু সাম্প্রদায়িক নয়, নারীর স্বাধীন সিদ্ধান্তের ধারণার বিরুদ্ধে। আজ মুসলমানকে বিয়ে করায় নিষেধ হলে, কাল অসবর্ণে বিয়ে না করার আইন আসা অসম্ভব নয়। শুধু সঙ্গী নির্বাচন কেন, নারীর পোষাকের স্বাধীনতায় সরকারি হস্তক্ষেপ এখন মান্য। মোহন ভাগবত বলছেন, পোষাকে পশ্চিমি প্রভাবের কথা। স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী তো আরও স্পষ্ট করেই বললেন, জিন্স পরলে রেপ হয়! উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী 'রিপড জিন্স'-এর অশালীনতা নিয়ে মুখর হন।

আরও পড়ুন: রামরাজ্যই সুখরাজ্য? বঙ্কিম থেকে আম্বেদকর, কী বলছেন ওঁরা?

এই ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক দলে মহিলারা তবু যোগ দেন, এই দলের হয়ে মহিলারা তবু ভোটে দাঁড়ান, এ বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়। মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানে বা বিহারে তো বিজেপির ভাল ফলের পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন মেয়েরা। ডোল ইকনমির মাধ্যমে মেয়েদের সাময়িক সমর্থন আদায় করা সহজ হয়ে যায় এমন সমাজে, যেখানে গৃহশ্রম অবৈতনিক, যেখানে সম্পদে নারীর অধিকার সুস্বীকৃত নয়, যেখানে ছুঁড়ে দেওয়া খুদ-কুঁড়োকে অনেক মনে হয়।

'উজ্জ্বলা যোজনা'য় 'মহিলা'রা প্রাথমিক ভাবে গ্যাস উনুন ও সিলিন্ডার পেয়েছিলেন বটে, তারপর গ্যাসে ভর্তুকি পেতে কতবার কগজপত্র নিয়ে লাইনে দাঁড়ালেন? পরিবারকে রান্নার গ্যাস দেওয়া 'মহিলাদের সম্মান' দেওয়াই বা কেন হবে? রান্নাঘরই কেন বিজেপির মতে মহিলাদের 'সম্মানের জায়গা'?

রয়টার্সের রিপোর্টে প্রকাশ, 'বেটি বচাও, বেটি পড়াও'-এর টাকার ৫৬% পাবলিসিটিতে খরচ হয়েছে। রাজ্যগুলো নির্ধারিত অর্থের মাত্র ২৪% পেয়েছে। বাকি ২০% অর্থ খরচাই হয়নি। ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর দেওয়াল লিখন হয়েছে এমনও─'যদি না বাঁচে বেটি/ কে বানাবে রুটি?' শুধু রুটি বানানোর জন্যই কি মেয়েদের বাঁচানো হবে? এ কোন যুগে প্রত্যাবর্তন? কিংবা বিজেপি নেতারা হিন্দু জনসংখ্যা বাড়াতে এই যে বারবার নারীকে গর্ভধারণ করতে বলছেন, তাতে যে তাদের রক্তাল্পতায় মৃত্যুও ঘটতে পারে, তা কি তাঁরা বোঝেন না? বিজেপির ভারতে মেয়েদের রক্তাল্পতা বা অপুষ্টি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেন?

***

তেইশ বছর আগে সমাজকর্মী ও পরবর্তীকালে মাওবাদী নেত্রী অনুরাধা গান্ধি 'ফ্যাসিজম, ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড পেট্রিয়ার্কি' নামক প্রবন্ধে কিছু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। তিনি তখনই বলেছিলেন—

১) বিজেপি নয়, আসল শত্রু আরএসএস।

২) ফ্যাসিজমে সংখ্যাগুরু নারী হল সংখ্যাগুরুর মর্যাদা রক্ষায় ক্রীড়নক মাত্র। তাকে ঘরে বেঁধে ফেলা হবে।

৩) ফ্যাসিজমে সংখ্যালঘু নারী হল সংখ্যালঘুর আব্রু। সংখ্যাগুরু তাকে ধর্ষণ করতে চাইবে। আর অন্যদিকে তাকে ঘরে রুদ্ধ করতে হবে— এই হবে সংখ্যালঘুর মত।

৪) ফ্যাসিজমে ব্যক্তিগত সম্পর্কে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সর্বাত্মক হবে।

৫) ইউনিয়ন সিভিল কোড আনা হবে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের আনা ইউনিয়ন সিভিল কোডে নারীর কোনও লাভ হতে পারে না। এইখানে মনে রাখতে হবে, তিনি লিখছেন ২০০১ সালে, যখন বামপন্থী নারীবাদীরাও অনেকে ইউনিয়ন সিভিল কোড সমর্থন করতেন। তখনই তাঁরা বুঝতে পারবেন যে সে আসলে সংখ্যাগুরুর ষড়, সেই যুগ আসেনি। কিন্তু অনুরাধা সে'টাও অনুমান করছেন। এখন নারীবাদীরা মুসলমান বা হিন্দু বা ক্রীশ্চান পারিবারিক আইনের আলাদা আলাদা সংস্কারের কথা বলেন, ইউনিয়ন সিভিল কোড চান না।

অনুরাধা বলেছিলেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো প্রতিটি চরম ফান্ডামেন্টাল বহিঃপ্রকাশের আগে ঘটবে চরম নারী নির্যাতন, যেমন ওই ক্ষেত্রে ঘটেছিল রূপ কানোয়ারের সতীদাহ। মজার ব্যাপার হল, অনুরাধা প্রবন্ধটি লেখেন ২০০১ সালে—যখন এক মহামহিম গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হতে চলেছেন, সেই উপলক্ষে। শয়ে শয়ে বিলকিস বানো ঘটার পরেও আমরা সেই ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছি। ফলত, আরও শয়ে শয়ে দলিত ও সংখ্যালঘু নারী, এবং অন্য নারীরাও, তাঁর শাসনকাল নিপীড়িত হয়েছে, হচ্ছে। এবং অনুরাধার ফর্মুলা মেনে প্রতি ফান্ডামেন্টালিস্ট নারী নির্যাতনের পরে এসেছে ফান্ডামেন্টালিস্ট নরমেধও, তা গুজরাত দাঙ্গার কালে হোক বা দিল্লি দাঙ্গার কালে।

***

সেই যে বলছিলাম, মূল্যবোধ যুগে যুগে বদলানোই সুস্থ— সেই বদল আসে ভাবনার দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমে। হেগেলের থিসিস আর অ্যান্টিথিসিসের সংঘাত, তার থেকে নতুন সিন্থেসিস! অথচ এ কোনও বহির্জাগতিক আমদানি নয়, এর চর্চা ভারতেই সর্বাত্মক ভাবে ছিল। রাম ও রামায়ণের প্রেক্ষিতেও তার উদাহরণ অপ্রতুল নয়।

আড়াই হাজার বছর ধরে মূল্যবোধের নানা পরিবর্তনকে ধরে রাখা আছে রাম-সীতা-রাবণ কেন্দ্রিক নানা মহাকাব্যে, কবিতায়, লোকগাথায়, নাটকে—প্রায় তিনশত রামায়ণ জুড়ে। বহুত্বই আমাদের ঐতিহ্য। এ কে রামানুজনের যে প্রবন্ধটি দিল্লি ইউনিভার্সিটির সিলেবাস থেকে বাদ পড়ল, তা রামায়ণের প্রতি কিছুমাত্র অবজ্ঞাসূচক ছিল না। স্রেফ তিনশ ভারতীয় রামায়ণের বহুত্বে বিস্ময়বিহ্বল ছিল। কোনও রামায়ণ নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা—যেমন চন্দ্রাবতীর রামায়ণে সীতা-ত্যাগী রামকে সটান ‘পাপিষ্ঠী’ বলা হয়। কোনও রামায়ণে ব্রাহ্মণ্যবাদ ঘিরে উষ্মা—যেমন জৈন রামায়ণে রাবণ ব্রাহ্মণদের দ্বারা অপমানিত হয়ে খলনায়ক। আবার মূল রামায়ণে (অভিপৌরাণিক অংশে যদিও ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধিপত্য) রাবণও কি ব্রাহ্মণসন্তান নয়? ব্রাহ্মণকেও কি নারীহরণ করলে শাস্তি পেতে হয় না? এই বহুত্বই ভারতীয় ঐতিহ্য। এ'দেশে ‘রামায়ণ-রা’ ছিল নিজেদের মধ্যে সংলাপে রত।

আরও পড়ুন: রামমন্দির: গণতন্ত্রের কবরে ধর্মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা

সে'খান থেকে পিছিয়ে, আমরা বিজেপির একমাত্রিক রামায়ণ ও বিজেপির রাজনৈতিক রামের থেকে কী নিতে পারি এই যুগে? এই কি গ্রহণ করব যে, শূদ্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা চলে, কিন্তু তাকে আলোর অধিকার, প্রতিস্পর্ধার অধিকার দেওয়া চলে না? সে'ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদণ্ড অবধারিত? নাকি আমরা একবিংশ শতকে এই নীতি গ্রহণ করব যে, রাষ্ট্র স্থির করবে নারীর চরিত্র? নাকি আমরা তার থেকেও পিছিয়ে যাব এবং ধর্ষক-নির্যাতকদের পরিয়ে দেব বিজয়মালা, যেমন পরানো হয় বিলকিস বানোর ধর্ষকদের, বা ব্রিজভূষণকে?

এ'কথা বিজেপিকে প্রায় বলতে শোনা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার কালেকটিভ মেমোরিতে রাম আছেন। ভিয়েতনাম থেকে ইন্দোনেশিয়ায় তাঁর গাথা গাওয়া হয়। কিন্তু কোন রাম? তিনশত রামের মধ্যে কোন রাম বিজেপির রামের সঙ্গে মেলে? তিনশ রামের মধ্যে কোনও রামই কি বিজেপির রামের সঙ্গে আদৌ মেলে?

হিন্দু মহাসভার অন্যতম প্রাণপুরুষ বি এস মুঞ্জে ইটালি ঘুরে, মুসোলিনির সঙ্গে বৈঠক করে, জানিয়েছিলেন অতিহিন্দুদের, হিন্দু জাগরণের জন্য কী কী করণীয়। তিনি বলেছিলেন, বহু দেব নয়, হিন্দুদের এক দেবতার অধীনে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। যে কোনও বহুত্ব ফ্যাসিজমের পক্ষে প্রতিকূল। তারপর থেকে তিলে তিলে যে রাম রাজনৈতিক স্বার্থে নির্মাণ করা হল, তা লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্মগত সংখ্যাগুরুর স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নিবেদিত ক্রীড়নক মাত্র। তার কোনও রাজ্য নেই, সে রাজ্যবিস্তারের হাতিয়ার।

More Articles