মহামারীরই আকার নিচ্ছে কোভিড পরবর্তী মানসিক অসুস্থতা, কেন!

কোভিডের পরে অনেকেরই মানসিক অবসাদ (Depression), দুঃশ্চিন্তা বা অ্যাংজা়ইটির (Anxiety) সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এই জাতীয় সমস্যা প্রকট না হলেও, কোভিডের পরে বেশিরভাগ রোগীই ব্রেন ফগের (Brain Fog) মত সমস্যায় ভুগছেন। ব্রেন ফগ হলে সাধারণ জিনিস বুঝতে না পারা বা পরিষ্কার করে ভাবনাচিন্তা না করতে পারা  এবং সাধারণ অঙ্কের হিসেব করতে না পারার মত সমস্যা দেখা যায়।

বেশিরভাগ রোগীরই বক্তব্য কোভিডের শারীরিক সমস্যাগুলির থেকে ধীরে ধীরে তারা সেরে উঠলেও, ডিপ্রেশন, অ্যাংজা়ইটি, বা ব্রেন ফগের মত সমস্যায় ভুগছেন কোভিড থেকে সেরা ওঠার দীর্ঘদিন পরেও। এই জাতীয় সমস্যা কারোর ক্ষেত্রে তিন মাসে সেরে যাচ্ছে, কারও কারও বা আট মাস অবধি থাকছে। এই ঘটনা ঘটছে যাদের মাইল্ড কোভিড হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও। যাদের মানসিক অবসাদ, অ্যাংজাইটির মত সমস্যা আগে ছিল, তাদের ক্ষেত্রে এই অবস্থার অবনতি ঘটছে; কারও বা বক্তব্য কোভিড হওয়ার আগে তাদের এই জাতীয়  সমস্যাই ছিল না। 

মাইল্ড কোভিডে নোভেল করোনাভাইরাস মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করে না, যা আবার দেখা যায় সিভিয়ার কোভিডের ক্ষেত্রে, যেখানে মস্তিষ্ক অবধি ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় ভাইরাস।

আরও পড়ুন-কতটা ভয়ঙ্কর করোনা ভ্যারিয়েন্ট নিওকোভ, জানা গেল নতুন গবেষণা থেকে

কিন্তু এই ঘটনাগুলি কেন ঘটছে, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের কাছেই তা অজানা। এই বিষয়গুলির পেছনে মূলত দায়ী আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং নিউরোকেমিস্ট্রি (Neurochemistry) অর্থাৎ নিউরোন (Neuron) ও মস্তিষ্ক থেকে ক্ষরিত একাধিক জৈবরাসায়নিক পদার্থ (Biochemical Substance)।

অনেকের ধারণা দৈনন্দিন ভাবে মহামারীর সঙ্গে লড়তে লড়তে, সামাজিক ভাবে আলাদা জীবনযাপনের কারণে, পাশাপাশি মৃত্যুমিছিল সামনে থেকে দেখতে দেখতে মানসিক প্রভাব পড়ার কারণে কোভিড-পরবর্তী নানান মানসিক অসুখ দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়গুলি তো মানসিক অবসাদ, দুঃশ্চিন্তার অন্যতম কারণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে এখানে আরও বেশ কিছু কারণ এসে জুড়েছে, যা কিন্তু হচ্ছে ভাইরাসের আক্রমণের কারণেই।

কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে এই মানসিক সমস্যাগুলির সূত্রপাত ঘটছে কিন্তু আমাদের শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করার সাথে সাথেই। কারণ আমাদের ইমিউন সিস্টেম তখন থেকেই কাজ শুরু করে। ইমিউন সেল সাইটোকাইন (Cytokine) নামের ছোট প্রোটিন অণু (Protein Molecule) ক্ষরণ করতে শুরু করে। শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করলেই, এদের বিরুদ্ধে লড়া শুরু করে বেশ কিছু প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন (Pro-inflammatory Cytokine), যাদের মধ্যে অন্যতম ইন্টারলিউকিন-আলফা (Interleukin-α/ IL-α) ইন্টারলিউকিন-ওয়ান বিটা (IL-1β), ইনট্রারলিউকিন–গামা (IL-γ), টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর (Tumour Necrosis Factor)  বা টিএনফ (TNF), ইন্টারলিউকিন-সিক্স (IL-6), ইন্টারলিউকিন-ফোর (IL-4) ইত্যাদি। এরা দ্রুত কাজ শুরু করে শরীরে ঢোকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।

 কিন্তু সাইটোকাইন ক্ষরণ হল শাঁখের করাতের মত - এরা ক্ষরিত না হলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়া সম্ভব না, কিন্তু ক্ষরিত হলে ইনফ্ল্যামেশনের (Inflammation) মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে রক্তের শিরা ও ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধা বা ব্লাড কোয়াগুলেশনের (Blood Coagulation) মত সমস্যা দেখা যায়।

প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন আরও একটি ক্ষতি করে - এরা ডিপ্রেশন, মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, অ্যাংজা়ইটি, বা ব্রেন ফগ ইত্যাদি দেখা যায়। এমনকী ডিমেনশিয়া ও অ্যালজা়ইমারের মত সমস্যাও দেখা যায়। এসবের জন্যে কিন্তু বিশেষভাবে দায়ী সেই ইন্টারলিউকিন-আলফা  ইন্টারলিউকিন-ওয়ান বিটা , ইনট্রারলিউকিন–গামা , টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর, ইন্টারলিউকিন-সিক্স, ইন্টারলিউকিন-ফোর।

দেখা যাচ্ছে কোভিড থেকে সেরা ওঠার মাসখানেক পরেও সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্ল্যুইডে এরা উপস্থিত থাকছে। সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্ল্যুইড আমাদের মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ড বা শিরদাঁড়ার আশেপাশে থাকে।

এই প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইনগুলি নার্ভকোশ এবং মস্তিষ্কে ইনফ্ল্যামেশন ঘটায়। একে নিউরোইনফ্ল্যামেশনও বলে। এছাড়াও আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষার জন্যে মসিষ্কের আশেপাশে যে প্রাচীর থাকে - যা ব্লাড-ব্রেন বেরিয়ার নামেও পরিচিত - তা-ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন। মস্তিষ্ক সংলগ্ন এই প্রাচীর ভেদ করে ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন ঢুকে পড়তে পারে একদম মস্তিষ্কে।

আমাদের আনন্দ, দুঃখ, অবসাদ, দুঃশ্চিন্তা, রাগ এবং অন্যান্য সমস্ত রকম অনুভূতির জন্যে দায়ী কিছু রাসায়নিক, যাদের বলা হয় নিউরোট্রান্সমিটার, তাদের ক্ষরণ এবং কাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইনের জন্যে। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাইপোথ্যালামিক - পিট্যুইটারি - অ্যাড্রেনাল অ্যাক্সিস বা এইচপিএ অ্যাক্সিসের কাজ। এইচপিএ অ্যাক্সিস মূল ভূমিকা পালন করে আমাদের আনন্দ, অবসাদ, দুঃশ্চিন্তার বা ভয়ের মত অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে। কারণ আমাদের নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ ও কাজও প্রাথমিক ভাবে  নিয়ন্ত্রণ করে এইচপিএ অ্যাক্সিস।

প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে সেরোটোনিনের ক্ষরণকে। এই নিউরোট্রান্সমিটার মূলত আমাদের আনন্দ, অবসাদ, অ্যাংজাইটি, রাগের মত অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। সেরোটোনিনের অভাব হয় কোভিড-পরবর্তী কালে, এই প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইনের প্রভাবেই। ফলে কোভিড-পরবর্তী মানসিক অবসাদ, অ্যাংজাইটি, রাগ ইত্যাদি অস্বাভাবিক নয়।

সাইটোকাইনের কারণে এইচপিএ অ্যাক্সিস অত্যন্ত বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই পাল্লা দিয়ে বেশ কিছু হরমোনের ক্ষরণ বাড়তে থাকে, যার মধ্যে অন্যতম কর্টিকোট্রপিন রিলিজি়ং হরমোন, অ্যাড্রেনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন, এবং কর্টিসল। কর্টিসলের ক্ষরণ বাড়লে অ্যাংজাইটি, অকারণ ভয়, ইত্যাদি বাড়তে থাকে। প্রথম দুটি হরমোন এদিকে কর্টিসলের ক্ষরণ বাড়াতে সাহায্য করে।

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কাজে প্রভাব ফেলে  প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন। শুরু করা যাক বেসাল গ্যাংলিয়া দিয়ে -   সহজ ভাবে বললে এটি থাকে মস্তিষ্কের মধ্যবর্তী অংশে। বেসাল গ্যাংলিয়া আমাদের মোটিভেশনের জন্যে দায়ী। এদিকে সাইট্রোকাইনের জন্যে অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে অ্যাঙ্গ্যুলার সিঙ্গুলেট কর্টেক্স। মস্তিষ্কের এই অংশ অ্যাংজাইটির প্রধান কারণ; খুব স্বাভাবিক ভাবেই এটি বেশি সক্রিয় হলে অ্যাংজাইটিও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, অ্যাঙ্গ্যুলার সিঙ্গুলেট কর্টেক্স মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনের সাথেও জড়িত।

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কোভিড পরবর্তী সময়ে শরীরের মত মনেরও যথেষ্ঠ যত্ন দরকার। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, শারিরীক ও মানসিক বিশ্রাম প্রাথমিক ভাবে দরকারি। তবে খুব বাড়াবাড়ি হলে দেরি না করে মনোবিদের সাহায্য নেওয়া অবশ্য কর্তব্য

More Articles