বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর অন্য নাম আজও হেপাটাইটিস, কতটা বিপজ্জনক এই রোগ?

হেপাটাইটিস রোগ কী এবং এর খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে মানুষের কাছে স্বচ্ছ ধারণা আজও নেই। চলুন জেনে নেওয়া যাক, এই রোগের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের দিকগুলি।

 

আজ বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। ২৮ জুলাই দিনটি বিশ্ববাসীর মধ্যে হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে পালন করা হয়। হেপাটাইটিস লিভারের প্রদাহজনিত একটি রোগ।মানুষভেদে এই রোগের প্রভাবও ভিন্ন হয়। সঠিক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অথচ টিকাকরণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র মতে, বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৩৪৫ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত এবং এঁদের বেশিরভাগই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আন্তর্জাতিক এই সংস্থার লক্ষ্য ২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন করে রোগাক্রান্তর সংখ্যা ৯০% এবং মৃত্যুর হার ৬৫% হ্রাস করা। তবে হেপাটাইটিস রোগ কী এবং এর খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে মানুষের কাছে স্বচ্ছ ধারণা আজও নেই। চলুন জেনে নেওয়া যাক, এই রোগের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের দিকগুলি।

হেপাটাইটিস কী?
সাধারণত ভাইরাস বা জীবাণুর সংক্রমণের কারণে, বা অন্যান্য কোনও ওষুধের দরুন বা যথাযথ জীবনযাপন না করলে অনেক সময়ে লিভারে প্রদাহ দেখা দেয়। একেই আমরা হেপাটাইটিস বলে থাকি। দূষিত খাবার বা জলের মাধ্যমেই এই রোগ মূলত ছড়িয়ে পড়ে। তবে রোগের বিস্তার না ঘটা পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায় না। মোট পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাস রয়েছে সেগুলি হল এ, বি, সি, ডি এবং ই। এর মধ্যে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস মারাত্মক রূপ নেয় ও লিভার সিরোসিস এবং ক্যানসারের রূপ নেয়। প্রাথমিক চিকিৎসা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: দিনে একটা কলা হয়ে উঠবে ক্যানসার থেকে হৃদরোগের রক্ষাকবচ, বলছে গবেষণা

হেপাটাইটিসের রকমফের
হেপাটাইটিস এ
এই ভাইরাস দূষিত খাবার এবং জলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে লিভার ফুলে যাওয়া, ক্ষুধামান্দ্য, জ্বর, বমি এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গর জয়েন্টে ব্যাথা অনুভব করেন আক্রান্ত ব্যক্তি।

হেপাটাইটিস বি
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস মূলত রক্ত এবং দেহ-নিঃসৃত তরলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালে একজন অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীর রক্তে প্রথম এই ভাইরাস পাওয়া যায়। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, বিশ্বের প্রায় ২৫৭ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলার থেকে ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে তাঁর সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার। তবে সামাজিক মেলামেশা যেমন হ্যান্ডশেক, কোলাকুলির মাধ্যমে এই ভাইরাস অন্য ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে পড়ে না।

হেপাটাইটিস সি
এ এবং বি ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক হেপাটাইটিস সি। এই ভাইরাসও আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত এবং দেহ তরল থেকে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীজুড়ে আনুমানিক ১৩০ থেকে ১৭০ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত।

হেপাটাইটিস ডি আক্রান্ত ব্যক্তির জিনিস ব্যবহারের মাধ্যমে এবং ই ভাইরাস দূষিত জলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।

হেপাটাইটিসের কারণ
দূষিত খাবার বা জলপানের মাধ্যমে এই রোগ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত এবং তার দেহনিঃসৃত তরল থেকেও সুস্থ ব্যক্তি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। হেপাটাইটিস এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে দেহে সঞ্চারিত হলেও অন্যান্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে এই রোগের।

অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে লিভারের ক্ষতি এবং প্রদাহ দেখা দিতে পারে। এটিকে অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস বলা হয়। অ্যালকোহল সরাসরি লিভারের কোশগুলির ক্ষতি করে। এছাড়াও বিষাক্ত কোনও পদার্থ, রাসায়নিক বা ওষুধের কারণেও হেপাটাইটিস রোগ হতে পারে। অটোইমিউন হেপাটাইটিস এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যেখানে আপনার শরীরের ইউনিয়ন সিস্টেম লিভারকে আক্রমণ করে। সঠিক কারণ জানা না গেলেও মনে করা হয়, এটি জিনগত কারণে বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে হয়ে থাকে।

হেপাটাইটিসের লক্ষণ
হেপাটাইটিসে আক্রান্ত বহু মানুষের কোনওরকম উপসর্গ থাকে না, ফলে তাঁরা জানেনই না যে, তাঁরা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে কিছু উপসর্গ দেখা যেতে পারে।

• জ্বর

• ক্লান্তি

• ক্ষুধামান্দ্য

• বমি-বমি ভাব

• পেটে ব্যথা

• গাঢ় রঙের প্রস্রাব এবং মলত্যাগ

• অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে ব্যাথা

• জন্ডিস হওয়ার ফলে আপনার চোখ এবং ত্বক হলুদ হয়ে যেতে পারে

তবে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ লিভারে ক্ষত এবং আরও বেশ কয়েক বছর পরে সিরোসিসের রূপ নেয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সিরোসিস-আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার অকার্যকর ও ক্যানসার, খাদ্যনালী ও পাকস্থলির শিরা স্ফীত হতে পারে, যার ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তির।

রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি
রক্ত পরীক্ষা এবং লিভারের বায়োপসি করে হেপাটাইটিস রোগ নির্ণয় করা হয়। রক্তে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি চিহ্নিত করতে অন্যান্য পরীক্ষাও করা যেতে পারে। হেপাটাইটিসের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জন্য নির্দিষ্ট রক্ত পরীক্ষা রয়েছে।

হেপাটাইটিসের নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। এক্ষেত্রে লক্ষণগুলি নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়। সঠিক সময় ধরা পড়লে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্রাম এবং ওষুধে ঠিক হয়ে যেতে পারে এই রোগ। মদ্যপান এবং ফ্যাটজাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকলে উপসর্গগুলি দ্রুত সেরে যায়। তবে প্রচণ্ড বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে, অর্থাৎ লিভার সিরোসিস বা লিভার ফেলিওরের সমস্যায় লিভার ট্রান্সপ্লান্টের দরকার পড়তে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো কিছু অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া শিশুদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ রুখতে আমাদের দেশে টিকাকরণের ব্যবস্থা রয়েছে।

 

 

More Articles